Salil Chowdhury

সলিলের গানের বাণীর অন্দরে

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

দীপায়ন ভট্টাচার্য

অনন্য সঙ্গীত প্রতিভা সলিল চৌধুরির জন্মশতবর্ষ সামনেই। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯নভেম্বর। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, তাঁর সুরারোপিত গান রয়েছে হিন্দি, মালয়ালম, ওড়িয়া, অসমীয়া, তামিল, তেলুগু, মারাঠি, কন্নড়, গুজরাটি প্রভৃতি ভাষার চলচ্চিত্রেও। জনমনে জায়গা খুঁজে পাওয়া যে কোনও শিল্পীর একটা প্রাথমিক লক্ষ্য তো বটেই, তবে সলিল চৌধুরি সেই সাফল্য ছুঁয়েছেন জনগণের হৃদস্পন্দনকে শুনে, অতি-সাধারণ মানুষের জীবনের ঝড়ঝাপ্টা, চড়াই-উৎরাই, মধুর-বিধুর মুহূর্তকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে। এই দেখার অভ্যাস তিনি রপ্ত করেছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘর প্রবহমান ধারায়। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরি ছিলেন আসামের লতাবাড়ি চা-বাগানের চিকিৎসক। গানের প্রতি প্রারম্ভিক অনুরাগ বাবার কাছ থেকেই তাঁর পাওয়া। সেই অনুরাগ আরও প্রসারিত হয়েছিল জ্যাঠতুতো দাদা নিখিল চৌধুরির কাছে। ১৯৪৪ সালে সলিল চৌধুরি যখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্যে কলকাতায় চলে আসেন তখন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর সংযোগ। গণসঙ্গীতে তাঁর উৎসাহ জাগলো কার থেকে সেই খোঁজে নেমে ‘গণনাট্য ৭০ স্মারকগ্রন্থে’ অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা গেল — ‘‘কথা প্রসঙ্গে সলিল দা বললেন, দ্যাখ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র মাটি না কোপালে সলিল চৌধুরির জন্ম হতো না ’’ 
সলিল চৌধুরির সঙ্গীতের জয়যাত্রা শুরু হয়ে ধীরে ধীরে জনমানসে প্রভাব ছড়িয়ে দিতে শুরু করল। অনেক বছর আগে সঙ্গীতের প্রাণসত্তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি সুগ্রথিত অভিমত এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। ‘সঙ্গীত চিন্তা’ গ্রন্থে তিনি বলেছিলেন,‘‘সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’’ সলিল চৌধুরির সঙ্গীতচারণার মধ্যে সেই প্রাণশক্তি এসে পৌঁছেছিল জনতার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে। এই ঢেউয়ের মাথায় তিনি সওয়ার হতে পেরেছিলেন গণসঙ্গীত সৃষ্টির সুবাদে। এই সৃষ্টির দুই ধাপ– গণসঙ্গীতের বাণী রচনা এবং তাতে সুরারোপ। একাধারে গীতিকার ও সুরকার আধুনিক বাংলা গানে কম হলেও বাংলা গণসঙ্গীতে কিন্তু ততটা দুর্লভ নয়। যাক সে কথা– সলিল কিন্তু গানের সলতে পাকানোর কাজটা বেশ নিবিষ্টমনে করছিলেন বাঁশি, এসরাজ, বেহালা, সেতার, পিয়ানো, গিটার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে নিজেকে নিপুণ করে তুলতে তুলতে। একযোগে গণনাট্যের সৃষ্টিকর্মে জনসংযোগের সঞ্চয় তো বাড়ছিলই। জনজীবনের সমস্যা ও সংগ্রাম থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা শিল্পী সলিলকে যে সমৃদ্ধ করে তুলেছে তার আঁচ পাওয়া গেছে অনেক পরে ১৯৮৮ সালে কলকাতার মৌলালি যুব কেন্দ্রে গণসঙ্গীত কর্মশালায় সলিল চৌধুরির উপস্থাপিত বক্তব্যে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘প্রত্যক্ষভাবে যারা গণআন্দোলনে জড়িত নন, গণআন্দোলনকে যারা নিজের করে নিতে পারেননি, তাদের কাছে গণসঙ্গীত তাত্ত্বিক কচকচি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মাঠে-ময়দানে, কলে-কারখানায় বিভিন্ন গণআন্দোলনের শরিক হিসাবে যে শিল্পীরা কাজ করেন তাদের গলায় যে সঙ্গীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, আধুনিক সঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, পাশ্চাত্য প্রভাবিত সঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, তার বক্তব্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর সংগ্রামের ( যে সংগ্রাম সে করছে) ছবি ফুটে ওঠে। গণআন্দোলনের শরিক যে শিল্পী সে যখন সেই গণআন্দোলনের কথা বলতে পারে, বলতে চায়, তখন তার হাতে যদি তার আঙ্গিকের দক্ষতা থাকে, শব্দচয়নের দক্ষতা থাকে– তাহলে যে গণসঙ্গীত হয়– তা উৎরে যায়।’’
এই অভিজ্ঞতার সঞ্চয় থেকে তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুরের ছোঁয়া দিয়ে গড়ে তুললেন ‘রানার’ বা ‘অবাক পৃথিবী’ আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় সুরের জাদুকাঠি ছুঁইয়ে সৃষ্টি করলেন ‘পাল্কীর গান’ প্রভৃতি কালজয়ী গানের সম্ভার। কিন্তু সে তো সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরির কীর্তিস্তম্ভ। এখান থেকে বাঁক নিয়ে আমরা চলব গীতিকার সলিল চৌধুরির বাণীর অন্দরে উঁকি মেরে তার অন্তর্লীন বিষয়ের সন্ধান। গণসঙ্গীতে বাণীর গুরুত্ব বিষয়ে 'গণসঙ্গীত প্রসঙ্গে' পুস্তিকায় ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির এই অভিমত প্রকাশিত হয়েছে— ‘‘এই সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে, সর্বহারা শ্রেণি সাধারণ মানুষের সামনে তার সমগ্র বক্তব্য শিল্পীতভাবে উপস্থিত করতে চায় এবং তার নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি ও যুক্তি ব্যাপক মানুষের চিত্তে সঞ্চারিত করতে চায়। মানুষকে তার ডেকে বলার কথা অনেক— তাই গণসঙ্গীতে সে বাণীকে এত গুরুত্ব দিয়েছে।’’ এবার এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সলিল চৌধুরির সৃষ্টি থেকে সুপরিচিত কিছু গান বাছাই করে সেগুলোর অন্তর্নিহিত বার্তা জনমানসে কীভাবে সংগ্রামের উদ্দীপনা জাগাতে পেরেছিল তার কিছু আলোচনা এখানে করা যাক।
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Culture, শব্দের নিহিতার্থ বলতে ‘চাষ করা’ শব্দটিকেও নির্দেশ করেছেন – কেন না Cultivation থেকেই এসেছে Culture শব্দটি। কর্ষণজীবী অর্থাৎ কৃষকের প্রধান উৎপাদিত খাদশস্য হলো ধান। সলিল চৌধুরির ‘হেই সামালো ধান হো’ গানটিতে সেই ধান সামলে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কেন? এক সময় এই বাংলাতেও কৃষকেরাই ধান রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফসল কাটার পরও পাকা ধান গিয়ে উঠত কিন্তু জমিদার-জোতদারদের ঘরে। সেই ভূস্বামীরা নানারকম প্যাঁচ-পয়জার, হিসাবপত্র কষে চাষিদের যা দিত তাই নিয়েই এদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। যার অনিবার্য ফল কৃষকদের ঘরে ঘরে অভাব-অর্ধাহার-অনাহার। এই সীমাহীন বঞ্চনা নিয়ে ক্ষোভ জমতো বঞ্চিতদের মনে। সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়েছিল মহল্লায় মহল্লায় তেভাগার মরণপণ লড়াইয়ে। এই গানে ‘হো' ডাক দিয়ে মিশে আছে কৃষকদের পরস্পরের কাছে একজোট হয়ে লড়াইয়ে নামার সেই আহ্বান —‘জান কবুল আর মান কবুল/ আর দেব না আর দেব না/ রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।’
কেউ কেউ বলেন, কেরালায় বিচারের মাধ্যমে কাইয়ুর কৃষকদের ফাঁসিতে শাস্তিদানের প্রতিবাদে সলিল চৌধুরির কলম থেকে ঝরে পড়েছিল এই গান ‘‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা –/আজ জেগেছে সেই জনতা/ তোমার গুলির তোমার ফাঁসির/ তোমার কারাগারের পেষণ শুধবে তারা ওজনে তা – এই জনতা।’’ আসলে শুধু বিশেষ কোনও বিচারপ্রক্রিয়ায় নয়, রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে যারা জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করেন, তাদের অপকীর্তির মূল্যায়ন করবার উপযোগী চেতনা তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই জনমনে সঞ্চিত হচ্ছে। তা দিয়েই একদিন জনতা ছিনিয়ে আনবে সুবিচার– সলিল ব্যক্ত করতে চেয়েছেন সেই আশা। তবে কি জাদুমন্ত্রবলে দেশের সবখানে সবকিছু  ঠিকঠাক হয়ে যাবে? না– তা তো নয়। অন্য একটি গানে সলিল তাই লিখলেন–‘আমার ভিটেয় চরল ঘুঘু ডিম দিল তোমাকে/ সেই আজব ডিমের আজব শিশু খাস দিল্লিতে থাকে।’ গানটি বিদ্রূপাত্মক– বিষয় স্বাধীনতার বিষক্রিয়া। এই স্বাধীনতার স্বপ্ন কত অশ্রুভেজা চোখে নতুন উৎসাহের দীপ্তি এনে দিয়েছিল, অনেক স্বজনহারানোর বেদনাকে সয়েও পথ চলার প্রেরণা জুগিয়েছিল, সেকি বিদেশি লুণ্ঠকদের সরিয়ে দেশীয় পুঁজিপতি-ভূস্বামীদের মসনদে আসীন করবার জন্যে? ব্যঙ্গ-বিদ্রূপেও সলিলের প্রতিবাদী কলম নানা জায়গায় ঝলসে উঠেছে। যেমন, এই গানটাই বেছে নেওয়া যাক –‘ও ভাইরে ভাই/ মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই।’ 
আত্মপ্রচারসর্বস্ব, ছদ্ম দেশপ্রেমিক এইরকম ভোগবাদী নেতারা মুখে দেশের নাম জপ করে তলে তলে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করে গেছে, তবুও প্রসাদকামী মিডিয়াকুলের কাণ্ড –‘আমি কি দিয়ে ভাত খাই/ আর কোথায় কোথায় যাই/ ওরা ছাপে আমার পাঁচড়া হলে কী মলম লাগাই।’ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সলিল এমন ছদ্মবেশীদের মুখোশে নির্ভীকভাবে টান মারতে পারতেন, আর এখনকার কতিপয় নাগরিকের কি সমতুল্য প্রচারপিপাসু, সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকদের চোখে পড়ে না, নাকি তারা শাসক বলেই ঘাঁটাতে দ্বিধায় পড়ে যান? সলিল তখনই বুঝেছিলেন মানুষেরা নড়বে, আর শাসকেরা ঝরে পড়বে – নিশ্চিতভাবেই তা হবে না। শকুনির মত তারাও চাল চালবে। এরকম করেই তো এদেশে ধর্ম বা জাতপাতের আফিম জনগণকে খাইয়েও তারা বিভেদের ভ্রষ্টাচার চালাবে। তাতে জনগণের একাংশ যে অনেকবার দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তা-ও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সলিলও সে সঙ্কট দেখেও না দেখার ভান করেন নি। ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে’ গানটির অন্তরায় তিনি লিখেছেন –‘তোমারই সন্তান মোরা তোমারই সন্তান/ তুচ্ছ বিভেদ-বিষে কত হয়েছি হয়রান/ তখন / দেখি নি মা ঘরে ঘরে কেঁদে কাটাও কাল/ আর / গোপনে মরণে কাটে সর্বনাশের খাল।’
এই গান অবিসংবাদিতভাবে দেশপ্রেমের গান। আর সলিল নিঃসন্দেহে পালন করেছেন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কর্তব্য। কেন না, নিখাদ দেশপ্রেম দেশের আশু বিপদকে উপেক্ষায় পাশ কাটিয়ে যায় না, তার সঙ্গে লড়তে নামে আর দেশবাসীকেও সে সম্পর্কে বিপদসঙ্কেত দেয়। সেদিনের সেই সতর্কবার্তা যে কত প্রাসঙ্গিক ছিল তা তো এখন আমরা আরো গভীরভাবে বুঝতে পারছি। তখন খাদ্যসঙ্কট, দুর্ভিক্ষ  নিয়েও মানুষের বিপন্নতা উপলব্ধি করেছিলেন সলিল চৌধুরি। তাঁর গানে ছিল সেদিনের অভিজ্ঞতার আতঙ্ক – ‘ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী/ এলো পিশাচেরা এলো রে/ শতপাকে বাঁধিয়া নাচে তাথা তাথিয়া/ নাচে তাথা তাথিয়া নাচে রে।’ 
এ শুধু গান নয়, স্বাধীনোত্তর বাংলায় মুনাফাবাজদের কূটচালে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের হাহাকার, সলিলের দরদি মন তা শুনতে পেরেছিল, বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকেও এমন দরদ ছিল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বাগত’ কবিতাতেও ছিল। আর আমরা – একালের মানুষ – হাল আমলের শাসকদের ‘মেলা-খেলা- রেলা’ দেখে সেই দুর্বহ স্মৃতি কি বিসর্জন দিয়ে দেব? শাসকদের সুবিধের জন্যে রণাঙ্গন ফাঁকা করে দিয়ে পিছু হটে যাওয়া লড়াকু জনতার কাজ না । তাঁরা শুধু নিজের জন্যে নয়, সমষ্টির সার্বিক  মঙ্গলের জন্যেও লড়াই জারি রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । সলিল বহুদিন আগেই গানে গানে সে আহ্বান জনতার দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন। আমি, আপনি অনেক সময়ই সে গান নিয়ে সমবেতকণ্ঠে গুণগুণ করি –‘আহ্বান, শোন আহ্বান/ আসে মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে/ দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে বন্যার মতো বেরিয়ে।/ যুগ সঞ্চিত সুপ্তি দিয়েছে সাড়া, হিমগিরি শুনলো কি সূর্যের ইশারা/ যাত্রা শুরু, উচ্ছল রোলে, দুর্বার বেগে তটিনী...’। 
তটিনীর নির্মাণ তো সলিল দিয়েই। আর জনতার সঙ্গী সলিলের এ আহ্বান যূথেরই উদ্দেশ্যে। সেই যূথ – যারা আঁধার রাতেও দৃঢ় সঙ্কল্পে আলোর পথযাত্রী হতে চায়, যারা কোরাস গানে সংগ্রামী সাথিকে জাগ্রত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে – সলিলের গান লেখা, সুর দেওয়া, গান গাওয়া তো তাদের জন্যেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment