Supreme Court

অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতরদের জন্য সংরক্ষণ বৈধতা পেল

জাতীয়

সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছে। ভর্তি ও সরকারি পদে এই সংরক্ষণের আওতার বাইরে থাকবেন তফসিলি জাতি, তফসিলি আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর অংশের দুর্বলতর মানুষ। এক কথায়, শুধু সাধারণ বর্গের জন্যই এই সংরক্ষণ প্রযোজ্য হবে। ২০১৯ সালে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনীতে এই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাকে চ্যালেঞ্জ করে যে আবেদন জমা পড়েছিল তা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। 
তবে, প্রধান বিচারপতি ইউইউ ললিতের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের বিচারপতিরা এই প্রশ্নে একমত হননি। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের (ইডব্লিউএস) সংরক্ষণকে বৈধ বলে রায় দিয়েছেন বিচারপতি দীনেশ মাহেশ্বরী, বেলা এম ত্রিবেদী এবং জেবি পরদিওয়ালা। বিচারপতি ললিত নিজে এবং এস রবীন্দ্র ভাট বলেছেন, এই সংরক্ষণ সংবিধানের মৌলিক ধারণার বিরোধী। বিচারপতি ললিতের প্রধান বিচারপতি হিসাবে সোমবারই ছিল শেষ দিন। 
সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের তরফে রায় পড়েন বিচারপতি মাহেশ্বরী। তিনি যুক্তি দেন, সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে এগনোর জন্য সংরক্ষণ রাষ্ট্রের তরফে একটি সক্রিয় পদক্ষেপ। শুধু সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পশ্চাৎপদ অংশের জন্য এই হাতিয়ার নয়। ইডব্লিউএস-দের জন্য সংরক্ষণে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করে গেলেও তা সংবিধান লঙ্ঘন করে না কেননা ওই সীমা অনমনীয় নয়। বিচারপতি ত্রিবেদী বলেন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশকে একটি শ্রেণি হিসাবে চিহ্নিত করা অযৌক্তিক নয়। বিচারপতি ত্রিবেদী ও পারদিওয়ালা অবশ্য বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই সংরক্ষণ হওয়া উচিত, চিরকালের জন্য নয়। 
এই অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিচারপতি ভাট বলেন, অর্থনৈতিক মাপকাঠি হলেই তা সংবিধান লঙ্ঘন করছে, এমন না। কিন্তু এক্ষেত্রে দুর্বলতর অংশ থেকে তফসিলি জাতি ও তফসিলি আদিবাসী অংশের মানুষকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থান সংবিধানের ধারণার বিরোধী। অন্যান্য সামাজিক অংশকে বাদ দেওয়া চূড়ান্তভাবেই সমতার ধারণার বিরোধী। এই অংশের জন্য সংরক্ষণ আছে এই যুক্তি দেখিয়ে এই অংশের দরিদ্রতরকে বাদ দেওয়া সংবিধানে অনুমোদনযোগ্য না। এতে তাঁদের শুধু সেই সংরক্ষণের পরিধিতেই বেঁধে রাখা হচ্ছে। অর্থনৈতিক মাপকাঠি যুক্ত করেও তাঁদের সেই মাপকাঠিতে গণ্য করা হচ্ছে না। জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণ থেকে অর্থনৈতিক সংরক্ষণে যাবার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের দারিদ্রের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে না। বিচারপতি ভাট এই অবস্থানকে ‘অরওয়েলিয়ান’ বলে অভিহিত করেছেন। 
বিচারপতি ভাট স্পষ্টই বলেন, ৭০ বছরে এই প্রথম সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিচ্ছে যা কাউকে বাদ দেবার জন্য, বঞ্চনামূলক। তফসিলিদের জন্য সংরক্ষণ আছে তাই তাঁরা সুবিধাপ্রাপ্ত এই ধারণা তৈরি করা হচ্ছে। অথচ সংরক্ষণের ধারণাই তার বিরোধী। সমতার ধারণার মর্মে আঘাত করছে। 
বিচারপতি ভাট একটি পরিসংখ্যানও পেশ করেন। তিনি বলেন, ২০১০-এর জুলাইয়ে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে দেশে ৩১.৭ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে (বিপিএল)। তার মধ্যে ৭.৭৪ কোটি তফসিলি জাতি, যা মোট তফসিলি জাতি জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ। বিপিএল তফসিলি আদিবাসীর সংখ্যা ৪.২৫ কোটি যা মোট আদিবাসী জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ। বিপিএল ওবিসি জনসংখ্যা ১৩.৮৬ কোটি যা মোট ওবিসি জনসংখ্যার ৩৩.১ শতাংশ। বিপিএল জেনারেলের জনসংখ্যা ৫.৫কোটি যা এই অংশের মোট জনসংখার ১৮.২ শতাংশ। তাহলে অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে তফসিলি জাতি-আদিবাসীদের বাদ দেওয়ার যুক্তি কী? 
এই রায়ের পরে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিজেপি দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রী দেশের গরিবদের জন্য কাজ করছেন, এই রায়ে তা প্রমাণিত হলো। আবার, কংগ্রেস দাবি করেছে মনমোহন সিংয়ের সরকার ২০০৪-০৫ সালে এই সংরক্ষণের জন্য প্রক্রিয়া চালু করেছিল। ২০১৪-তে বিল তৈরিও হয়ে যায়। মোদী সরকার পাঁচ বছর কালক্ষেপ করেছে। 
অন্যদিকে, তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য শতাব্দীব্যাপী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি আঘাত। তামিলনাডুতে প্রথম সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সংবিধান সংশোধন হয়েছিল। দেশজুড়ে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামরত সমস্ত শক্তিকে সোচ্চার হবার আবেদন জানাচ্ছি। 
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম এই রায়ের প্রেক্ষিতে বলেছেন, আর্থিক বিচারে দুর্বল অংশকে সহায়তা করছে না আইন। আইনের জন্য আনা বিলের বিরোধিতা প্রায় কেউ করেনি সংসদে। কিন্তু তার প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। প্রকৃত দরিদ্র অংশ বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। দলিত শোষণ মুক্তি মোর্চার সাধারণ সম্পাদকের প্রশ্ন, আর্থিক বিচারে দুর্বলদের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে উচ্চবিত্তদের। প্রয়োগের সময় এভাবে ঠিক হচ্ছে আয়ের সীমা। ফলে দুর্বলরা বঞ্চিতই থাকছেন। আইনের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে যে যে শর্ত রাখা হয়েছে এই সংরক্ষণের জন্য তা কোনভাবে একজন আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের পক্ষে যায় না। লোকসভায় যে আইন পাশ করানো হয়েছে তাতে বলা হয়েছে বছরে ১০ লক্ষ টাকার নিচে আয় পাঁচ একরের কম জমি হলেই সংরক্ষণের আওতায় পড়বে। সরকারের এই শর্তাবলি প্রমাণ করে দিচ্ছে এই আইন কোনভাবে আসল লক্ষ্য পূরণ করছে না। এসসি, এসটি, ওবিসিদের সংরক্ষণ যাতে কোনভাবে ব্যাহত না হয় সেই দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। সামাজিক এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া উভয়ের সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করার জন্য ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সরকারকে তাই করতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment