HANDLOOM CRISIS SHANTIPUR

সুরাটের ‘ভেজাল’ কাড়ছে শান্তিপুরী শাড়ির কদর

রাজ্য

Weavers cotton handloom sarees শান্তিপুরের ঢাকাপাড়ায় তাঁতশ্রমিকদের সঙ্গে সৌমেন মাহাতো।

‘‘এই কাজ কইর‌্যা ভাত খাওনের উপায় নাই। মজুরি নাই, কাজ নাই। তাঁত খারাপ হইতে পারে, সুতা ছিঁড়তে পারে। গেলে তো আমার।’’

ঢাকাপাড়ায় তাঁতযন্ত্রের সামনে বসে আক্ষেপ এমনই ষাটোর্ধ্ব হরিপদ দাসের। হতাশা যদিও তাঁর একার নয়। তাঁতের শাড়ির বিখ্যাত কেন্দ্র নদীয়ার শান্তিপুরে এমনই মন্তব্যের ভিড় এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়। হাতে চালানো, যন্ত্রে চালানো ঘরোয়া তাঁত তো বটেই, সমস্যায় পড়ছে মাঝারি যন্ত্রচালিত ইউনিটও।

তাঁতশিল্পী প্রদীপ দেবনাথের স্বরে জালিয়াতির অভিযোগ স্পষ্ট। অভিজ্ঞ দেবনাথ বলছেন, ‘‘সুরাট থেকে মাল আসছে শান্তিপুরে। তার ওপর মেশিনে কাজ হচ্ছে। বলা হচ্ছে শান্তিপুরী শাড়ি। সুরাটের শাড়ি দেশের সব জায়গায় তাঁতিদের সর্বনাশ করে দেবে। আসামের মেখলাশিল্পীদের পথে বসিয়েছে।’’

হাতে চালানো যন্ত্রে কাপড়ে মাড়।

নদীয়া জেলা তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক সৌমেন মাহাতোর ক্ষোভ, ‘‘হস্তশিল্পীদের তৈরি পণ্যে সরকারি সিলমোহর থাকার কথা। সে সব নেই। আগে মিলনমেলায় সরকারি বিজ্ঞাপনে বলা হতো হস্তচালিত তাঁতের কাপড় বিক্রি হবে। এখন তৃণমূল সরকারের বিজ্ঞাপনে হস্তচালিত আর বলা হয় না। সরকারি সহায়তা ছাড়া হস্তশিল্প বাঁচবে না। খুবই কঠিন অবস্থায় কোনও রকমে টিকে আছেন তাঁত শ্রমিকরা।’’

ঢাকাপাড়ায় দীর্ঘশ্বাস। দেশভাগের পর এই এলাকায় বসত গড়েন ঢাকার উদ্বাস্তুরা। প্রবীণরা বলছেন, একসময়ে শান্তিপুরে ট্রেন থেকে নামতেন শ্রমিকরা। ঘরে ঘরে কাজ হতো। এখন কোথাও কোথাও খটাখট শব্দ ওঠে, কাজের সেই দমক আর নেই। কমবয়সীরা আর তাঁতের কাজ শিখতে চায় না। তাঁতশ্রমিক পরিবারের কেউ কেউ ‘র‌্যাপিয়ার’ মেশিন ইউনিটে কাজ করে। তাও খুব বেশি না।

এ পাড়ায় আছে ‘ঢাকেশ্বরী সমবায় সমিতি’। কেবল নামেই টিকে আছে। ছোট তাঁতশ্রমিক বা উৎপাদকদের বদলে মালিকের দেখানো ‘পকেট সমবায় পাচ্ছে সরকারি বরাত। স্কুলের পোশাকের কাপড় তৈরির বরাত যাচ্ছে বড় মহাজনের কাছে। সুতো দেওয়ার জন্য কঠিন সরকারি শর্ত, জিএসটি- সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে।

বাগানিপাড়ায় সুতো হাতে, কাপড় বোনার আগে তাঁতশিল্পী। 

নবীন সিপিআই(এম) কর্মী অয়ন প্রামাণিক বোঝাচ্ছেন এলাকার অবস্থা। বলছেন, ‘‘দলে দলে পরিযায়ী হয়ে যাচ্ছে। হবে না কেন বলুন। তাঁতশ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১১০ টাকা থেকে ক’বছরে নেমে গিয়েছে ৭০ টাকায়। তার চেয়ে রাজমিস্ত্রির জোগারের কাজে বেশি আয়!’’

হরিপদ দাসের সঙ্গেই কাজ করেন রঞ্জিত বিশ্বাস, মিঠুন মণ্ডলরা। প্রদীপ দেবনাথ বলছেন, ‘‘এঁরা যতদিন করবেন ততদিন চলবে ইউনিট। তারপর কী হবে জানি না।’’

সুরাটের শাড়িই হাতে চালানো তাঁত, এমনকি ছোট পাওয়ারলুমের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। শান্তিপুরে এখন দাপট ‘র‌্যাপিয়ার’ যন্ত্রের। তাতে মাকু থাকে না, কেউ কেউ বলেন ‘হাওয়া মেশিন’। একেকটা যন্ত্রে ১৬ থেকে ১৮টা কাপড় বেরিয়ে আসছে। চব্বিশ ঘন্টা কাজ হচ্ছে। একেকটি মেশিনে একেকজন বারো ঘন্টা করে। মাইনে মাসে, দক্ষতা অনুযায়ী, ৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার। হাতে চালানো তাঁতে একজন শিল্পী বারো হাত কাপড় বোনেন সাত দিনে পাঁচটি।

বাগানিপাড়ায় তাঁতশিল্পীরা সুরাটের কাপড়ের পাশাপাশি সরব ওই হাওয়া মেশিন নিয়ে। এক কমবয়সীর দেখা মিলল, মেহবুব মণ্ডল। ত্রিশের কম বয়স। কাপড় বোনেন না, তাঁর কাজ ‘ড্রাম’-ও সুতো জড়িয়ে দেওয়া। বিদ্যুতে চলে ছোট্ট যন্ত্র। ‘‘তাঁতশিল্পীরা এই ‘ড্রাম’ থেকে কাপড় বোনেন’’, বললেন মেহবুব। সব মিলিয়ে আয় মাসে হাজার ছয়েক। মেহবুব মণ্ডল বললেন, ‘‘সুরাট থেকে শাড়ি ঢুকছে। কাজ চলে যাচ্ছে সবার।’’  

তাঁতযন্ত্রে শান্তিপুরী শাড়ি। 

মুসলিম বাগানিপাড়াতেই ছোট পাওয়ারলুম, মানে বিদ্যুতে চালানো তাঁতযন্ত্র আজিজ শেখের। এক যন্ত্রে দিনে বড়জোর হয় তিনটি কাপড়। ‘‘ সব বাদ দিয়ে তিন কাপড়ে দিনে বড়জোর ১২০ টাকা থাকে। এই জায়গা দেখছেন, আগে ২০-২২ জন লোক কাজ করত। এখন আমি একা।’’, বলছেন শেখ। আলাপ হলো মোজত মণ্ডলের সঙ্গেও। ছিলেন একসময় মহাজন। বললেন, ‘‘র‌্যাপিয়ার এসে সব শেষ করে দিয়ে গেল।’’

কেমন এই র‌্যাপিয়ার? ডাবরেপাড়ায় বড় কারখানায় তিনটে যন্ত্র গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে কাপড় তৈরি করছে। ঘরে দুই যুবক দেখভালের দায়িত্বে। হাজার খানেক নকশা ধরা রয়েছে। হাতের যত্নে তিল তিল করে তৈরি সাবেক শান্তিপুরী জামদানি হয় সুতি দিয়ে। সেই সুতো যন্ত্রের কড়া ধমক সইতে পারে না, ছিঁড়ে যায়। এখানে কাজ হয় সিন্থেটিক মিলিয়ে।  

এই র‌্যাপিয়ার। আরও বড় বিপদ যদিও সুরাটের ‘জাল’ শাড়ি।

মালিক ষাটোর্ধ্ব নবকুমার সাধুখাঁ। নিজে তাঁতশিল্পী ছিলেন। একেকটা যন্ত্র কিনেছেন ১৮ লক্ষ টাকায়। কিন্তু বাজারের সঙ্কট তাঁরও। সাধুখাঁ বলছেন, ‘‘বাজারে অর্ডার খুব কম। আমাদের যে মালে খরচ ৯০০ টাকা, সুরাটের কাপড়ে তৈরি হলে জামদানির দাম পড়বে ৬০০ টাকা। তার সুতো আলাদা। অনেকেই বোঝেন না। শান্তিপুরী শাড়ি বলে বিক্রি হচ্ছে।’’

শহরের শেষ প্রান্তে বর্ধামান আর হুগলির সীমানায় বাড়ি মৃণাল মাহাতোর। স্ত্রী সোমা মাহাতো, বাবা বিনয় মাহাতো সবাইকে নিয়ে শাড়িতে মাড় দিয়ে শুকিয়ে ভাঁজ করে মহাজনদের ফেরত দেন। পরিবারের হাতে মাসে থাকে হাজার পনেরো টাকা। সাবুর আঠা দিয়ে মাড় দেন হাতে চালানো যন্ত্রে। শান্তিপুরী শাড়ির নামে জাল কাপড়ে ক্ষোভ এই ঝুমুরশিল্পীরও।

‘‘এই ক্ষোভ কেবল শান্তিপুরে নয়, ফুলিয়া বা ধনেখালিতেও পাবেন’’, বলছেন সৌমেন মাহাতো। এই সিপিআই(এম) নেতা বলছেন, ‘‘শান্তিপুরী কাপড়ের কদর রয়েছে বিশ্বে। অথচ সুরাটের কাপড় জাল করে নাম ভাঁড়িয়ে চালানো হচ্ছে। সরকার সিলমোহর দেয় না। এই জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে।’’ তাঁর ক্ষোভ, তাঁতিদের ঋণ দেয় না। তাঁত দেওয়ার নামেও দুর্নীতি করে তৃণমূল, ধরাও পড়ে। সমবায় বাঁচাতে হবে, বরাত দিতে হবে। মালিকের তৈরি ‘পকেট সমবায়’-কে নয়। রপ্তানির জন্য প্রশিক্ষণ। জাতীয় স্তরে ‘মহাত্মা গান্ধী বুনকর’ প্রকল্প ছিল। তুলে দিয়েছে চালু করতে হবে।’’

 

Comments :0

Login to leave a comment