আর জি কর হাসপাতালে সেদিন রাতে ডিউটিতে থাকা একাধিক জুনিয়র ডাক্তারকে এর আগে দফায় দফায় জেরা করেছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকরা। তবে সুপ্রিম কোর্টে পরবর্তী শুনানির ছয়দিন আগে আর জি করেরই দুই মহিলা পিজিটি’কে মঙ্গলবারের জেরা ঘটনার তদন্তে নতুন মোড় এনে দিয়েছে বলে খবর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
এই দুই মহিলা পিজিটি আর জি করে কর্মরত অবস্থায় খুন-ধর্ষণের শিকার ছাত্রীর সহপাঠী ছিলেন। সেদিন রাতে তাঁরা ছিলেন হাসপাতালে। এদের মধ্যে একজন আর জি করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদে নেতা, হাউসস্টাফের ঘনিষ্ঠ। সেদিন রাতে তিনিও ছিলেন ঘটনাস্থলে। যদিও ৯ তারিখ সকালের পরে তাঁকে আর দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে দাবি ৯ তারিখে হাসপাতাল ছেড়ে একটি গেস্ট হাউসে উঠেছিলেন তিনি। তারপর থেকে তাঁর হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না। একাধিকবার তলবে পরে এদিন আর জি করের সুপারের সঙ্গেও সিজিও কমপ্লেক্সে আসেন ওই দুই মহিলা পিজিটি। সেদিন রাতের ঘটনার অনেক বিবরণই এদিনের দফায় দফায় জেরায় উঠে এসেছে বলে জানা গেছে।
সেদিন রাতে টিভিতে অলিম্পিকে নীরজ চোপড়ার জ্যাভলিন থ্রো দেখার পরে অনলাইনে খাবার আনিয়ে দু’জন জুনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে সেই খাবার খেয়ে রাত আড়াইটা নাগাদ নাকি ওই চিকিৎসক পড়ুয়া সেমিনার রুমে বিশ্রাম নিতে যান। তার কিছু পরেই ঘটনাটি ঘটে। আর জি করের ঘটনার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই বিবরণ মিলেছিল পুলিশের তরফে। অথচ সময় যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হয়েছে এই বিবরণ হাসপাতাল ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের নির্মিত সাজানো বয়ান। সত্যের থেকে বহুদুরে এই বিবরণ। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ইতোমধ্যে সন্দীপ ঘোষের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ও গাড়ি চালকের বয়ানে স্পষ্ট হয়েছে সেদিন ভোর রাতে দুই ঘণ্টা দশ মিনিটের জন্য ছুটে এসেছিলেন সন্দীপ ঘোষ। চারটে দশ মিনিটে এসেছিলেন। তার আগেই ঘটনা ঘটেছিল। খবর পেয়েই তিনি এসেছিলেন তথ্য প্রমাণ লোপাটের সলাপরামর্শে। সেই সময়তেই ছিল হাসপাতালে সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ হাউসস্টাফ ও পিজিটি’রা। সেই সূত্রেই মেলা নতুন তথ্যের ভিত্তিতেই এই দুই মহিলা পিজিটিকে জেরা করে সিবিআই।
সিবিআই’র একটি সূত্রে খবর, এর মধ্যে একজনের সঙ্গে সেদিন রাতে কথা হয়েছিল খুন হওয়া পড়ুয়া চিকিৎসকের। সামান্য বচসাও। এদের মধ্যে একজন ওই পড়ুয়া চিকিৎসককে ডেকে নিয়ে যায় অন্যত্র। সেটি চারতলায় চেস্ট মেডিসিনের সেমিনার রুম নয়। অন্যত্র। ঘটনাস্থল আদৌ চার তলার সেমিনার রুম নয়, তা ইতোমধ্যেই তদন্তের গতিপথেই স্পষ্ট। কেন ওই পড়ুয়া চিকিৎসককে অন্যত্র ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ওই মহিলা পিজিটি? সেখানে কারা ছিল? ঘটনার পর তাঁরা কেন অন্তর্ধানে চলে গিয়েছিল এমন নানান প্রশ্নের উত্তরই জানতে চাইছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ওই দুই চিকিৎসক-পড়ুয়ার বয়ানও রেকর্ড করে সিবিআই।
মঙ্গলবার দুপুরে ফের সিবিআই’র তলবে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দেন ময়নাতদন্তকারী দলের অন্যতম চিকিৎসক অপূর্ব বিশ্বাস। তিনি নির্যাতিতার দেহের ময়নাতদন্ত করেছিলেন। এদিন প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলেন সিজিওতে। এর আগেও দু’বার তাঁকে তলব করা হয়েছিল। গত রবিবার সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই জেরা শেষে বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি তিনি দাবি করেছিলেন, মৃতার দেহের দ্রুত ময়নাতদন্ত করার জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ দেওয়া হয়েছিল। মৃতার কাকা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি এই চাপ দিয়েছিল। ‘তাড়াতাড়ি ময়নাতদন্ত না-হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব।’ -এমন হুমকিও তাঁকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। নির্যাতিতার সেই কাকু আসলে আর জি করে ধর্ষণের পরে খুন হওয়া চিকিৎসকের প্রতিবেশী, স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জীব মুখার্জি। পানিহাটি পৌরসভার তরফে যে শবদাহের ঘাট সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছিল তাতে নিহত তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মা বা পরিবারের কারো স্বাক্ষর ছিলনা,ওই তৃণমূল নেতা সঞ্জীব মুখার্জির সই ছিল সেখানে। যদিও সাধারণভাবে শ্মশানে শেষকৃত্যের সময় রক্তের সম্পর্ক বা পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিরাই শ্মশানে শেষকৃত্যের সময় সেই ফরমে সই করেন। যদিও এদিন তিনি সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। ময়নাতদন্তকারী ওই চিকিৎসককে চেনেন না বলেই দাবি তাঁর।
সিবিআই সূত্রের ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়ায় একাধিক অসঙ্গতি দেখা গেছে এমনকি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ তৈরি করার অভিযোগও সামনে আসে। তার ভিত্তিতেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কারা চাপ দিয়েছিলেন, কোন প্রভাব খাটানো হয়েছিল কিনা, কেন সূর্যাস্তের পরে ময়নাতদন্ত করতে হলো তড়িঘড়ি তা নিয়েও চলে জেরা। হাসপাতালের তরফে ৯ আগস্ট যে ময়নাতদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছিল তাতে ছিলেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেরই ফরেন্সিক মেডিসিনের অধ্যাপক অপূর্ব বিশ্বাস, সহকারী অধ্যাপক রিনা দাস এবং এন আর এসের সহকারী প্রফেসর মলি বন্দ্যোপাধ্যায়।একটি সূত্রে জানা গেছে ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পরেই তিন সদস্যদের চিকিৎসকে দলকে খোদ সন্দীপ ঘোষ চাপ দিয়েছিলেন যাতে ‘ফোর্সিবলি পেনিট্রেশন’ শব্দবন্ধ না থাকে। যদিও সেই দাবি মানতে অস্বীকার করেন ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা। সেই প্রসঙ্গেই সামনে এসেছে আর জি করের ফরেন্সিক বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর দেবাশিস সোমের নামও। ৯ তারিখ প্রথম থেকেই আর জি করে এবং ঘটনাস্থলেও দেখা গিয়েছিল দেবাশিস সোমকে।
এদিন আর জি করের তৎকালীন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠকেও জেরা করা হয় ফের। এর আগেও তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি তাঁকে একাধিকবার জেরাও করেছিল সিবিআই। হাসপাতালের বর্তমান সুপারও সপ্তর্ষি চট্টোপাধ্যায়ও এদিন এসেছিলেন সিজিও’তে।পরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন- ‘আমাকে কিছু নথি জমা করতে বলা হয়েছিল। সে সব নথিতে আমি সই করলাম। দুই পিজিটিকে কেন আসতে বলা হয়েছিল, তা বলতে পারবো না।
RG Kar
সঙ্গী দুই পিজিটি’কে জেরায় নতুন মোড়
×
Comments :0