Microfinance AIDWA

সুদের হার ৩০-৩৫%, ক্ষুদ্রঋণের জালে বন্দি মহিলাদের জন্য চলছে লড়াই

রাজ্য

সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্মেলনে সর্বভারতীয় সভাপতি মারিয়াম ধাওলে। ছবি: অরিজিৎ মণ্ডল

পূজা বোস

মুর্শিদাবাদের রাধারহাট গ্রামে ছেলেকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য ঋণ নিয়েছিলেন এক গরিব মা। তারপর টাকা শোধ করতে না পারায় বাউন্সার বাড়ি গিয়ে প্রতিবেশীদের সামনে হেনস্তা করে ওই মহিলাকে। নির্যাতনের জেরে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন মহিলা ও তাঁর পরিবার। 
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্মেলনে যোগ দিতে এসে এই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন মুর্শিদাবাদের মহিলা আন্দোলনের নেত্রী কৃপালিনী ঘোষ। জানালেন এমন মর্মান্তিক ঘটনার কথা। মাইক্রো-ফাইনান্স সংস্থার থেকে ঋণ নিয়ে বিপদে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমনি বহু ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে মহিলা সমিতির কর্মীদের। 
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের অভিজ্ঞতা জানালেন সংগঠনের নেত্রী সুচিত্রিতা বসু। নারীরাও চান নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে, স্বনির্ভর হতে। নিজেদের প্রচেষ্টায় কিছু করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রান্তিক থেকে মধ্যবিত্ত সব মহিলারাই তা চান। প্রয়োজন টাকার। 
সুচিত্রিতা বসু বললেন, ‘‘পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়েও বহু মহিলাই জড়িয়ে পড়েন এই ক্ষুদ্রঋণের জালে। একবার এই ঋণচক্রে জড়িয়ে পড়লে তা থেকে বেরোনো মহিলাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। কারণ তৈরি সামগ্রীর বাজার নেই। তাকে নষ্ট করে দিয়েছে সরকার।’’
এই মহিলা নেত্রী বলছেন, ‘‘বহুবার নিজেদের উৎপাদিত মাল বিক্রির জন্য বাজারের বন্দোবস্ত এবং ঋণে সুদের হার কমানোর মতো দাবিতে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে মেলেনি কোনও সাড়া।’’ 
তিনি আরও জানিয়েছেন যে ঋণ নিয়ে কেউ শাড়ির ব্যবসা, হাতের কাজের বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেন। এমনকি বিড়ি শ্রমিকদের মতো পেশায় থাকা মহিলারাও প্রয়োজনে এই ঋণ নেন। কোনো নথি লাগে না। তাই স্বল্প শিক্ষিত এমনকি নিরক্ষর মহিলারাও প্রথমে আগ্রহের সাথে ঋণ নিয়ে বসেন। কিন্তু প্রত্যেক মাসে ঋণ বাবদ যে পরিমাণ টাকা সুদ দিতে হয় ব্যবসার করে সেই পরিমাণ বিক্রি হয় না। 
সুচিত্রিতা ঘোষ বলেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের সরকারের সময়ে মেলাগুলিতে এই ধরণের সামগ্রী বিক্রি হতো। কিন্তু এখন টাকা না থাকলে সরকারি মেলায় স্টল দেওয়া যায় না। ফলে সুদের টাকা ফেরত দিতে গিয়ে আবার অন্য ঋণ নিয়ে বসেন মহিলারা। এইভাবেই তারা জড়িয়ে পড়েন ক্ষুদ্র ঋণের জালে।’’
মহিলা নেত্রীরা বলছেন, টাকা পরিশোধ না করতে পড়লে বাড়িতে আসে বাউন্সার, টিভি থেকে ঘটিবাটি সবই নিয়ে যায় তারা। মহিলাদের আপত্তিকর মন্তব্য করা তো আছেই। এমনকি মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি চলে শারীরিক নির্যাতনও। তাঁরা বলছেন, ২০১১ সালের আগে স্ননির্ভর গোষ্ঠী চালাতো বাম সরকার। তখন ওই গোষ্ঠীর মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য বিভিন্ন কাজ যেমন শেখাতো সরকার, তেমনই মহিলাদের বানানো বিভিন্ন দ্রব্য বিক্রির ব্যবস্থা ও করা হতো। কিন্তু তৃণমূল সরকার তেমন উদ্যোগ নেয় না। 
একই সমস্যার কথা উঠে আসে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কৃপালিনি ঘোষ এবং বাঁকুড়া থেকে আসা অঞ্জু সরকারের কথাতেও। তাঁরা বললেন, ‘‘বন্ধন ব্যাঙ্কের মতো কিছু সংস্থা প্রলোভন দেখিয়ে মহিলাদের ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে। কিন্তু আসলের ওপরে যে ৩০-৩৫ শতাংশ সুদের বোঝা তা জানতেই পারে ননা মহিলারা। কোনভাবে প্রথম কিস্তির টাকা দিলেও অনেকেই পরের কিস্তিগুলো সময়মতো দিতে পারেননা। দিতে না পারা সুদের উপরে আরোও সুদ চাপানো হয় তখন। 
মাইক্রো-ফাইন্যান্সের জাল থেকে মহিলাদের বাঁচাতে মহিলা সমিতির বেশ কয়েকটি পদক্ষেপে নিয়েছে বলে জানালেন মহিলা সমিতির মুখপত্র 'একসাথে' পত্রিকার সম্পাদক এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ঈশিতা মুখার্জি। তিনি বলেন, "মহিলারা ব্যাপকভাবে এই ঋণের দায়ে জড়িয়ে পড়ছে। এটা প্রশাসনিক সমস্যা। প্রশাসনকেই এর সমাধান করতে হবে। তবুও আমরা এই বিষয়টি দেখার জন্য জেলা শাসকদের ডেপুটেশনে দিয়েছি। সুদের হার কমানো, বাউন্সার পাঠিয়ে নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে হাওড়া, বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় সই সংগ্রহ ও প্রতিবাদ সভাও করেছে মহিলা সমিতি।"

Comments :0

Login to leave a comment