Adani Group's NDTV

আদানিদের গ্রাসে এনডিটিভি

জাতীয়

Adani Groups NDTV

বেশি দিনের ঘটনা নয়। ২০১৭  সালে দিল্লি প্রেস ক্লাবের  সাংবাদিকদের এক বিক্ষোভ সভায় এনডিটিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা প্রনয় রায় বলছেন, ‘ওরা বোঝাতে চায় , তুমি নির্দোষ হলেও তোমাকে আমরা বিপদে ফেলবো। আমাদের এর বিরুদ্ধে লড়তেই হবে। 

 

এটা গোটা ভারতের স্বাধীন প্রেসের কাছে একটা সংকেত।’ এই বিক্ষোভ সভা ও প্রনয় রায়ের এই বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে বর্তমান ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এক প্রতিবেদনে। ‘কী ভাবে ভারতের সংবাদ মাধ্যম ক্ষমতাসীন সরকারকে সাহায্য করে’ শিরোনামে প্রতিবেদনের লেখক হলেন পরাঞ্জয় গুহঠাকুরতা, সৌরদীপ্ত সান্যাল ও আবীর দাশগুপ্ত। মিডিয়া জগতে নির্ভীক স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে বোঝাতে এনডিটিভির উপর নানা হেনস্তার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। 


এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৭ সালে ৪৮ কোটি টাকার লেনদেনে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে প্রণয় রায়ের বাসভবনে তল্লাশি চালায় সিবিআই। নানা ভাবে হেনস্তা করে। এই সময়ে দেখা গেছে, বেছে বেছে সরকার বিরোধী সাংবাদিকদের উপর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর নানা হেনস্তার ঘটনাও সামনে উঠে আসছিল। সাংবাদিকেরা দিল্লি প্রেস ক্লাবে এতে বিক্ষোভ দেখালে তাতে উপস্থিত থেকে যে আক্রমন নেমে আসছে সাংবাদিকদের উপর তার বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন রায়। 

 

 

একই প্রতিবেদনে পরাঞ্জয় ঠাকুরতা কর্পোরেটের দুর্নীতির সংবাদ ফাঁস করায় তাঁর নিজের হেনস্তার অভিজ্ঞতা জানান। তিনি ইকনমিক পলিটিক্যাল উইককলি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কর্পোরেট আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি ফাঁস করায় তাকে মালিকের বিরাগভাজন হতে হয়। ২০১৭ সাল থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ১৫মাস ধরে টানা লড়াই করার পর তাঁকে সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। ঘটনা ছিল আদানির কর ফাঁকি সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে সংস্থার মালিকের নির্দেশে সেই দুর্নীতির প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশ করেন পরাঞ্জয়। তাতে মামলা হয়। মামলার চাপে শেষে আদানির সঙ্গে রফা করে মালিক। রফার শর্তে তাঁকে ইস্তফা দিয়ে সংস্থা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

 

 


মিডিয়ার ভূমিকা কী, তার কোন সামাজিক দায়িত্ব পালন করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা বহু হয়েছে। তার একটা স্পষ্ট ধারনা সাংবাদিকদের  অনেকের আছে। তা ভিন্ন আলোচনা। তবে এখন কর্পোরেট মালিকরা আজন্ম লালিত ও বেড়ে ওঠা স্বাধীন মিডিয়ার ধারনাকে অপ্রয়োজনীয় বলে দেগে দিয়ে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। তারা মিডিয়ার চলার পথের নতুন ধারা ঠিক করে দিয়েছে। মোদী জমানায় তাঁর ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটরা এখন মিডিয়ার চলার পথ ঠিক করে দিচ্ছে। আদানির মতো আরেক ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট রিলায়েন্স মিডিয়াকে আগে তার ধারার নতুন পথ দেখিয়েছে। ঠিক ১০ বছর আগে ২০১২ সালে নেট ওয়ার্ক ১৮ এরসঙ্গে মিডিয়া কারবারে নামে মুকেশ আম্বানির  রিলায়েন্স।

 

 

 ২০১৪ সালে তা পুরো কিনে নেয় রিলায়েন্স। এর পর থেকে একের পর এক চ্যানেল কিনে নেয়। বর্তমানে নেট ওয়ার্ক ১৮ সংস্থায় ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ রিলায়েন্সের। দুই বছর আগেই মুকেশ আম্বানি জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমানে ৭২টা চ্যানেলের মালিক রিলায়েন্স। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ টিভি দর্শক রিলায়েন্স গোষ্ঠীর কোন না কোন চ্যানেলের দর্শক। রিলায়েন্সের মিডিয়া ওয়েব সাইটের গ্রাহকও বেড়ে চলেছে। রিলায়েন্স মিডিয়া ওয়েব সাইটের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। আম্বানির জিও  প্লাটফর্মের মাধ্যমে মিডিয়া নেটওয়ার্ক চলছে। ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ সংস্থা জানাচ্ছে, রিলায়ন্সের নেটওয়ার্ক ১৮ দেশের এক নম্বর  মিডিয়া নেটওয়ার্ক। এর পরেই রয়েছে এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টিভি, নিউজ ন্যাশন্যাল, নিউজ ২৪। 

 

 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এক দশক আগে একে একে সব চ্যানেল কিনে নেওয়ার সময় মিডিয়া হাউসগুলিতে চলে নির্বিবাদে ছাঁটাই। মিডিয়ার কাজে এক নতুন ধারার পর্ব  শুরু হয়। কর্মীদের কাছে এই ছাটাই রোধের কোন পথ ছিলনা। কার্যত রিলায়েন্সের মিডিয়া দখল অভিযানে খড়ের কুটোর মতো উড়ে যায় ছাটাই কর্মীদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাবনা। এই ছাঁটাই হওয়া সাংবাদিকরা একসময় সংসদে এনিয়ে সাংসদদের সরব হওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাদের কিভাবে বিভিন্ন চ্যানেলে বিনা নোটিশে পিঙ্ক স্লিপ ধরিয়ে বিদায় করা হচ্ছে সেটাই সংসদে বামপন্থী সাংসদদের দিয়ে তোলানোর কথা ভেবেছিলেন কিছু সাংবাদিক। পরে তাঁরা সরে আসেন। তাঁরা জানান যদি সংসদে বিষয়টি নিয়ে শোরগোল হয় তাতে বিদায় দেওয়া সাংবাদিকদের পরিনাম হবে আরো  ভয়াবহ। 

 

 

খবর রটানো হয়, মিথ্যা অপরাধের অভিযোগে দাগিয়ে দিয়ে ছাঁটাই করা হবে। যাতে ভবিষ্যতে কোন জায়গায় সেই সাংবাদিকের আর চাকরি মিলবে না। আতঙ্কে নীরব থেকে গেছে সাংবাদিক ও সংবাদ কর্মীদের সেই প্রতিবাদ। রিলায়েন্সের মিডিয়া দখল বুঝিয়ে দেয় গণতন্ত্রে তার এখন চতুর্থ স্তম্ভের ভূমিকা পালন করার কাজ কিছু নেই। কর্পোরেটের পাহারাদারী করে চলাই তার আসল এবং একমাত্র কাজ। 

 


মোদীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট গৌতম আদানি এবারে মিডিয়ার ভূমিকা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মোদীর বদান্যে এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী  হয়ে উঠেছেন আদানি। তিনি এবারে মিডিয়ার কারবারে নামছেন। রিলায়েন্স অনেকটা মিডিয়া দখলের পর বাকিটা দখল নিতে আদানি নেমেছেন। এনডিটিভি কেনা কাটা করার মধ্যেই চলছে আরো মিডিয়া দখলের অভিযান। মিডিয়াকে তিনি কোন কাজে ব্যবহার করতে চান তা বলায় কোন রাখঢাক থাকেনি। তিনি স্পষ্টই মিডিয়ার  গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে যে ভুমিকা রয়েছে তাকে পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছেন। এনডিটিভি কিনে নেওয়ার প্রক্রিয়া সারতে গিয়ে আদানি বলেছেন, মিডিয়ার আসলে সরকারের মুখপাত্র হয়েই কাজ করা উচিত। মিডিয়ার ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে এক বাণিজ্যিক দৈনিকে সাক্ষাৎকারে তাঁর এই মতামত জানিয়েছেন আদানি। মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘‘মিডিয়ার স্বাধীনতার অর্থ হলো সরকার ভুল করলে তা যেমন মিডিয়া বলবে, একই সঙ্গে সরকার প্রতিদিন যে সঠিক সব কাজ করে চলেছে তা সরাসরি বলার মতো তার (মিডিয়ার) সাহস থাকতে হবে।

 

 

 আপনাকে (মিডিয়াকে) প্রতিদিন সেই কাজের (সরকারের সঠিক কাজ) কথা বলতেই হবে।’’ আদানির কথায়, মিডিয়ার বড় কাজ হলো সরকারের কাজ তুলে ধরা। বস্তুত, দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় মিডিয়ার নিরপেক্ষ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা গ্রহণের যে কাজ, তা বেমালুম উড়িয়ে দিতে চাইছেন আদানি। সরকার দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় দায়িত্বশীল ভুমিকা নিচ্ছে কিনা, মিডিয়া নজরদারি কুকুরের ভুমিকা নিচ্ছে কিনা, সরকার কর্পোরেটের স্বার্থ পূরণ করতে সাধারন মানুষের স্বার্থ বিরোধী কাজ করছে কিনা, সেখানে মানুষের প্রতিবাদ দমনে রাষ্ট্র সক্রিয় হয়ে পরছে কিনা এতে নজর রাখা মিডিয়ার মূল কাজ। এভাবেই গণতন্ত্রকে রক্ষার কাজ করবে মিডিয়া। অথচ আদানি বলে দিচ্ছেন মিডিয়ার এসব আসল কাজ নয়। তার আসল কাজ সরকারকে রক্ষায় পাহারা দেওয়া। গণতন্ত্রকে পাহারা দেওয়া নয়। আর মিডিয়ার পাহারা দেওয়া সেই সরকারের কাজ হলো কর্পোরেটের মুনাফার স্বার্থ দেখা। জনস্বার্থ দেখা নয়। এভাবেই কর্পোরেটে নয়া পথে চালিত হচ্ছে মিডিয়া। আদানির এই মিডিয়ার নয়া পথের ফতোয়ায় স্বাভাবিক ভাবে কর্পোরেট বন্ধু মোদীর সিলমোহর পরে গেছে।   

 

 


প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, খনি, রেল, তৈল শোধনাগার, সরকারি পরিকাঠামো— সর্বত্র কারবার বাড়িয়েছে আদানি। ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর মদতে বিপুল উত্থান ঘটেছে আদানির। মাত্র আট বছরে তাঁর সম্পদের পরিমাণ আরেক কর্পোরেট মুকেশ আম্বানির সম্পদকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ১৮.২লক্ষ কোটি টাকা। বিশ্বের অন্যতম বড় ধনী বলে পরিচিত আদানি গোষ্ঠী। এই সম্পদের পাহারাদার রাখা এবং ধান্দার কর্পোরেট হয়ে সম্পদ কামানোর প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতেও মিডিয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাই দেখা গেল পুরোন টাটা বিড়লার বদলে এখন আম্বানি আদানিরা মিডিয়া দখলে নেমেছে।  

 

 


মিডিয়া নিয়ে কর্পোরেট আদানি তার নিজস্ব পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ভারতে আন্তর্জাতিক মানের কোনও মিডিয়া নেই। আমি সেই লক্ষ্যেই নেমেছি। এনডিটিভি তো ব্যবসা করার জন্য কিনিনি, দায়িত্ব পালনের জন্য কিনেছি।’’ কী দায়িত্ব পালন তা অবশ্য পরিষ্কার জানান আদানি। সরকারের কর্মসূচি প্রচার করাই হবে মিডিয়ার প্রধান দায়িত্ব পালন, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন আদানি। ফলে মোদীর প্রচার যে আরও বিকট আকার নেবে তা বলাই বাহুল্য। 

 

 


এদিকে এনডিটিভি ছেড়েছেন ম্যাগসেসে পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক রবীশ কুমার। এক অভ্যন্তরীণ ই-মেলে বর্ষীয়ান এই সাংবাদিকের চ্যানেলের সিনিয়র এগজিকিউটিউ এডিটর পদ থেকে ইস্তফার খবর জানানো হয়েছে। এনডিটিভির নতুন প্রোমোটার গ্রুপ আরআরপিআর হোল্ডিং প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ইস্তফা দিয়েছেন প্রণয় রায় ও রাধিকা রায়। সংস্থার পরিচালন পর্ষদের বোর্ড থেকে প্রণয়-রাধিকার ইস্তফার ফলে আদানি গোষ্ঠীর পক্ষে এনডিটিভি’র পরিচালন ভার হাতে নেওয়ার পথ কার্যত পরিষ্কার হয়ে যায়। এনডিটিভি’র পরিচালন পর্ষদে নতুন করে ডিরেক্টর হিসাবে জায়গা পেয়েছেন সুদীপ্ত ভট্টাচার্য, সঞ্জয় পুগলিয়া এবং সেন্থিল সিননিহা চেনগালভারায়ন।

 

 


এনডিটিভি’র প্রোমোটার সংস্থা আরআরপিআর হোল্ডিং-এর পক্ষ থেকে গত বুধবারই স্টক এক্সচেঞ্জকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, শেয়ার হস্তান্তরের ফলে এনডিটিভি’র ২৯.১৮ শতাংশ শেয়ার আদানি গোষ্ঠীর হাতে যাবে। এর পাশাপাশি আরও ২৬ শতাংশ শেয়ার হাতে নেওয়ার জন্য আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তাব রাখবে আদানি গোষ্ঠী। গত আগস্ট মাসেই ঘুরপথে এনডিটিভি’র ২৯.১৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিল আদানি গোষ্ঠী। সেই প্রস্তাবে এই মাসের শুরুতে অনুমোদন দেয় স্টক এক্সচেঞ্জ। যার অর্থ, এনডিটিভি’র সিংহভাগ মালিকানা আদানি গোষ্ঠীর হাতে যাওয়া কেবল এখন সময়ের অপেক্ষা। তার আগেই এনডিটিভি’র নতুন বোর্ডের বৈঠকে ডিরেক্টর পদ থেকে রায় দম্পতির ইস্তফা পত্র গ্রহণ ও আদানি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসাবে নতুন বোর্ডের ডাইরেক্টর পদে তিনজনের নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলো।


নতুন বোর্ড থেকে ইস্তফা দিলেও এনডিটিভি নিউজ চ্যানেল বোর্ডের সদস্য পদে থাকছেন প্রণয় রায় ও তাঁর স্ত্রী রাধিকা রায়। সেখান থেকে এখনও তাঁরা ইস্তফা দেননি। এনডিটিভি’র নিজস্ব প্রোমোটিং সংস্থায় এখনও রায় দম্পতির ৩২.২৬ শতাংশ (প্রণয় রায়ের ১৫.৯৪শতাংশ এবং রাধিকা রায়ের ১৬.২২শতাংশ) শেয়ার রয়েছে। এনডিটিভি সুত্রে খবর, ২০০৯ সালে প্রণয় রায় সংস্থায় বিনিয়োগে রিলায়েন্সের থেকে বিনা সুদে ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেন। পরে রিলায়েন্স সেই ঋণের স্বত্ত্ব বিশ্বপ্রধান কমার্সিয়াল প্রাইভেট লিমিটেড সংস্থার কাছে বিক্রি করে এবং তা এনডিটিভির শেয়ারে রূপান্তরিত করে। তা এনডিটিভি’র ২৯.২ শতাংশ শেয়ারে দাঁড়ায়। আদানি গোষ্ঠী সেই ২৯.২শতাংশ শেয়ার পুরোটাই কিনে নেয়। এরপরেই এনডিটিভি’র নিয়ন্ত্রক প্রোমোটিং সংস্থা হিসাবে তা পুরো কেনার উদ্যোগ নেয় আদানি গোষ্ঠী। 

 

 

এনডিটিভি প্রথমে এনিয়ে আইনি প্রশ্ন তুলে বাধা দিলেও পরে তারা সরে আসে। এরপরেই এনডিটিভি’র আরও ২৬ শতাংশ শেয়ার কেনার জন্য খোলাখুলি দর দিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। শেয়ার বাজার সূত্রে খবর, ভালো দর দেওয়ায় তা কেনার পর্ব প্রায় চুড়ান্ত হওয়ার পথে। এনডিটিভি’র নিয়ন্ত্রণে নয়া বোর্ড গঠন করেছেন আদানি। এই সময়ে নতুন বোর্ড থেকে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রায় দম্পতি। খোলা দরে শেয়ার বিক্রি শেষ হলে আদানির এনডিটিভি’তে শেয়ারের অংশ দাঁড়াবে ৫৫শতাংশ। আন্দাজ করা হচ্ছে, ডিসেম্বরেই পুরো মালিকানা চলে যাবে মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি আদানির দখলে। 

 

 


মিডিয়া জগতে এক নতুন ধারার সাংবাদিকতা  নিয়ে আসেন এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতা প্রণয় রায়। ১৯৮৮ সালের ২৫ নভেম্বর ওয়ার্ল্ড দিস উইক  সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল  এনডিটিভির। ৩৪ বছর কেটে গেছে নতুন ধারার সাংবাদিকতা জনমানসে প্রবল সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কর্পোরেটের দখলে মিডিয়া চলে যাওয়ার পর সেই ধারার অবসান ঘটে গেছে। সংবাদ এখন বিনোদনের  মাধ্যম। যে সংবাদ আজ থেকে দুদশক আগেও বাজারী বিনোদন পত্রিকার গুজব কলমে স্থান পেতো তা এখন কর্পোরেট দৈনিকের প্রথম পাতার লিড খবর হয়ে যাচ্ছে। অভিনেতা অভিনেত্রী কার কোথায় মান হলো বা অভিমান হলো কে কোন মুখ্যমন্ত্রীর কোমর ধরে নাচলেন সেটাই মূল খবর হয়ে গেছে। কর্পোরেট মিডিয়ার এই পরিবর্তনের দিকটি পরিষ্কার করেই জানিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথ। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, কর্পোরেট মিডিয়া রাজনৈতিক ভাবে মুক্ত হলেও সে এখন মুনাফার জেলে বন্দি। তিনি এপ্রসঙ্গে টাইমর অব ইন্ডিয়ার মালিক বেনেট কোলম্যান সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যানের বক্তব্য উল্লেখ করেন।

 

 

 

 তিনি বলেন, ভাইস চেয়ারম্যান বলছেন আমরা সংবাদপত্রের ব্যবসায় নেই। আমরা বিজ্ঞাপনের ব্যবসায় আছি। কত সংবাদপত্র বিক্রি হলো তাতে সাংবাদপত্র চলে না। কত বিজ্ঞাপনে আয় হলো তাতে আমাদের সংবাদপত্র চলে। অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের ব্যবসাটাই আসল। আর সবটাই নকল। সাইনাথ বর্তমান ও অতীতের মিডিয়া ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো পত্রিকা মিডিয়া বাজারের বড় অংশ দখল করে থাকতো। এখন কর্পোরেটের এক কোনে চলছে মিডিয়া হাউস। তার মূল কাজ হলো কর্পোরেট ব্যবসার স্বার্থে দেখা। তার বাইরে মিডিয়ার কোন কাজ নেই। 
মিডিয়ার এই পরিবর্তনের আরো নির্মম ভাবে তুলে ধরেছেন সাংবাদিক রবীশ কুমার।আদানি  এনডিটিভি দখলের পর ইস্তফা দিয়ে ইউটিউবে এক সাক্ষাৎকারে রবিশ কুমার ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন, ‘আজকে যুবসমাজে অনেকে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সাংবাদিক হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন তাঁরা এক সময়  দালালির কাজ করতে বাধ্য হবেন। আর যারা সাংবাদিকতার পেশায় এখনো আছেন তাঁদের আরো দুর্ভোগে পড়তে হবে। সাংবাদিকদের অনেকেই এই সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পরেছেন। অনেকে সাংবাদিকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা এর মধ্যেও এই কাজ করে চলেছেন তারা বলছেন এই কাজে আর কোন আগ্রহ নেই।’ রবীশ কুমারের সাফ কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন  দালালি করা ছাড়া আর কোন ভবিষ্যৎ নেই সাংবাদিকতার। পশ্চিমবঙ্গে কর্পোরেট মিডিয়ার এই দালালির ভুমিকা রাজনৈতিক জমানা বদলের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেছে।

 

 


এদিকে ভারতে মিডিয়ার এই অধঃপতনের  কথা স্পষ্ট করেছে ২০২২ সালের গ্লোবাল প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রেস ফ্রিডমে ভারতের স্থান  ১৫০ টি দেশের মধ্যে একেবারে নিচের দিকে। ১৪২ তম স্থানে। কর্পোরেট আদানি গণতন্ত্র রক্ষায় মিডিয়ার চতুর্থ স্তম্ভ লোপাট করে তাকে নতুন কর্পোরেটের দোরগোড়ায় বসিয়ে দিয়েছেন। 
======  
১) ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর মদতে বিপুল উত্থান ঘটেছে আদানির। মাত্র আট বছরে তাঁর সম্পদের পরিমাণ আরেক কর্পোরেট মুকেশ আম্বানির সম্পদকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ১৮.২লক্ষ কোটি টাকা। বিশ্বের অন্যতম বড় ধনী বলে পরিচিত আদানি গোষ্ঠী। এই সম্পদের পাহারাদার রাখা এবং ধান্দার কর্পোরেট হয়ে সম্পদ কামানোর প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতে তাঁদের মিডিয়ার প্রয়োজন রয়েছে।   

 

 


২) ‘আজকে যুবসমাজে অনেকে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সাংবাদিক হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন তাঁরা এক সময়  দালালির কাজ করতে বাধ্য হবেন। আর যারা সাংবাদিকতার পেশায় এখনো আছেন তাঁদের আরো দুর্ভোগে পড়তে হবে। সাংবাদিকদের অনেকেই এই সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পরেছেন। অনেকে সাংবাদিকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা এর মধ্যেও এই কাজ করে চলেছেন তারা বলছেন এই কাজে আর কোন আগ্রহ নেই।’- রবীশ কুমার
 ২) সরকারের কর্মসূচি প্রচার করাই হবে মিডিয়ার প্রধান দায়িত্ব পালন, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন আদানি। ফলে মোদীর প্রচার যে আরও বিকট আকার নেবে তা বলাই বাহুল্য। 
 

Comments :0

Login to leave a comment