গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ভবনের পাঁচতলায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটির শুনানি বসেছিল। সেখানেই শাসক তৃণমূলের অন্যতম মুখ, এসএসকেএম হাসপাতালের পিজিটি অভীক দে’র বিরুদ্ধে ৩২ দফা অভিযোগ সামনে আসে। সেই তদন্ত কমিটির সামনে অভীক দে’র বিরুদ্ধে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে উত্তরাখণ্ডে মৃতদেহ পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে।
গত ৪ অক্টোবর তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা করে স্বাস্থ্য দপ্তরে। তারপর কুড়িদিন পেরিয়েছে। সরকারি তদন্ত কমিটি রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে হুমকি সংস্কৃতির দাপটের ভয়াবহ চেহারাকে সামনে এনে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষের পাশে দাঁড়ানোর মতোই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আক্ষরিক অর্থেই হুমকি সংস্কৃতিকে বৈধতা দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য ভবনের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই তদন্ত কমিটি কেন গঠন করা হয়েছিল, সেই রিপোর্ট কেন বাইরে এল, সেই রিপোর্টে কেন রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অভীক দে’র নেতৃত্বে পরীক্ষা কারচুপি থেকে হুমকি সংস্কৃতি চলছে বলে স্বীকার করা হয়েছে। এর জন্য খোদ নবান্নের প্রশ্নের মুখে স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকরাই। সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, তদন্ত রিপোর্টে যা সামনে এসেছে তার ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, সরকার যদি অভিযুক্তকেই বৈধতা দেয়, তাহলে আর জি করের ঘটনার পরেও আরও জাঁকিয়ে বসবে হাসপাতালের অভ্যন্তরে অপরাধমূলক কাজকর্ম, হুমকি সংস্কৃতি।
চার সদস্যের তদন্ত রিপোর্টে এমনকি বলা হয়েছে, একাধিক গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অভীক দে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য শুধু নয়, ওয়েস্ট বেঙ্গল ফার্মেসি কাউন্সিলে সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি হিসাবেও রয়েছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
সেই রিপোর্টে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মর্গ থেকে মৃতদহ উত্তরাখণ্ডে পাচারের অভিযোগও রয়েছে অভীক দের বিরুদ্ধে। যদিও কমিটির শুনানিতে সেই অভিযোগ না কি অস্বীকার করেছে অভীক দে! বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগে ২০২৩’র নভেম্বরে মৃতদেহ পাচারের ঘটনা ঘটে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তা জানতে পেরেই পুলিশে জানায়। অ্যানাটমি বিভাগের দুই ডোম এবং ফরেন্সিক মেডিসিনের অধীনে এক ডোমকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। যে দুটি মৃতদেহ পাচার হচ্ছিল তা আটকানো হয়। অ্যানাটমি বিভাগে এখনও রাখা আছে।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, কল্যাণী জেএনএম, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও রামপুরহাট সরকারি মেডিক্যাল কলেজ- এই পাঁচটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে অভীক দে’র নেতৃত্ব চলত থ্রেট কালচার। যে কোনও সময় যে কোনও মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে হুমকি দেওয়া, তাঁর কথা না শুনলে ব্যবস্থা নেওয়া, পরীক্ষা আটকে দেওয়া এমনকি ইনভিজিলেটর হিসাবে পরীক্ষা হলে ঢুকে নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র দিয়ে দেওয়া, সিনিয়র চিকিৎসকদেরও হুমকি দেওয়া— এই তৃণমূলী চিকিৎসক হুমকি রাজত্ব তৈরি করেছিল। ৩২টি অভিযোগকে ১৫টি ভাগে ভাগ করে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধভাবে এসএসকেএমে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকা, রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত সম্পূর্ণ না করা, এসএসকেএমে না থেকে ৯ আগস্ট সকালে ঘটনাস্থলে থাকা, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থ্রেট কালচার চালানো, পরীক্ষায় কারচুপি, অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ, অভীক দেকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল।
অথচ অভীক দে এতটাই ‘প্রভাবশালী’ যে চার তলার সেমিনার রুমের ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে তার ছবি দেখা গেলেও তাকে আড়াল করতে ময়দানে নামে খোদ কলকাতা পুলিশ! গত ৯ আগস্ট সকালের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ক্রাইম সিনে অর্থাৎ চারতলার সেমিনার রুমে যখন ওই চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহ পড়ে রয়েছে সেই সময়ে একাধিক মানুষের ভিড়। ‘ক্রাইম সিন’র একটি ছবি প্রকাশ্যে আসে তাতে লাল জামা পরা এক ব্যক্তিকে দেখায় যায়। কলকাতা পুলিশ তাঁকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ বলে চালিয়ে দিয়েছে। পরে জানা গিয়েছে, লালা জামা পরা ব্যক্তির নাম অভীক দে। তিনি এসএসকেএম হাসপাতালের পিজিটি, ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ নন। অথচ এমনকি খোদ আইএমএ প্রশ্ন তুলে বলেছিল, এই অভীক দে আবার ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ হলেন কবে! শুধু তাই নয়, নবান্নের সভাঘরে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালীন অভীক দে-বিরূপাক্ষ, আশিস পাণ্ডের নাম উঠতেই মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাতেই স্পষ্ট এই হুমকি সংস্কৃতির মদত মিলছে কোথা থেকে!
Avik Dey
অভীক দে’র বিরুদ্ধে উত্তরাখণ্ডে দেহ পাচারের অভিযোগও রয়েছে
×
Comments :0