যে দেশে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হবার আগেই অথবা অপরাধ প্রমাণ হবার আগেই এনকাউন্টারের মাধ্যমে খুন করে তাৎক্ষণিক সাজা দেবার প্রবণতা বাড়তে থাকে এবং কোনও অভিযুক্ত অপরাধী প্রমাণিত হবার আগেই প্রশাসন যদি সাজা ঘোষণা করে দিয়ে অভিযুক্তের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে গোটা পরিবারকে রাস্তায় নামিয়ে দেয় তাহলে সেদেশে আইনের শাসন বলবৎ আছে কিনা তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। মোদী জমানায় বিজেপি শাসিত বিভিন্ন বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আইনের শাসন যেন বিচার প্রক্রিয়াকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে প্রশাসনের কর্তারা যে বুলডোজার বিচার চালু করেছে তাকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরাসরি সংবিধানবিরোধী নৈরাজ্যের শাসন বলে অভিহিত করার পর এটা নির্দ্ধিধায় বলা যায় আরএসএস-বিজেপি যে শাসন মডেল চালু করছে তা আদতে সভ্য মানবিক সমাজ বহির্ভূত জঙ্গলের রাজত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। বুলডোজার বিচার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট স্রষ্টা করে দিয়েছে এইভাবে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে গায়ের জোরে স্বেচ্ছাচারী শাসন কোনও অবস্থাতেই বরদাস্ত করা যাবে না।
ভারতের সংবিধান শাসন ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থার এক্তিয়ার ও ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে আলাদা করে দিয়েছে। প্রশাসনকে প্রতিটি পদক্ষেপে সংবিধানের নির্দেশ এবং আইনে প্রতিটি ধারা উপধারা অনুসরণ করে চলতে হয়। প্রশাসনের কাজ কোনও অভিযুক্তকে ধরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তথ্য প্রমাণাদি জোগাড় করা। অভিযুক্তের বিচার করা বা সাজা দেবার কোনও এক্তিয়ার বা অধিকার প্রশাসনের নেই। সেটা একান্তভাবেই আদালতের অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। শাসন পরিচালনার এই অতি সাধারণ জ্ঞানটুকু অর্জন না করেই সঙ্ঘ অনুগত গেরুয়া নেতারা কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসনের ক্ষমতা দখল করে আছেন। আধুনিক সভ্য সমাজে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অ, আ, ক, খ টুকু আয়ত্ত করার আগেই যদি কেউ ক্ষমতার রাজনীতির উদ্ধত প্রশাসক হয়ে ওঠে তাহলে যা হবার সেটাই হচ্ছে। এহেন আইন ও সংবিধান বিরোধী নৈরাজ্যের শাসনের মুখ্য উদ্গাতা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং মধ্য প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। দু’জনেই সাফল্যের সঙ্গে এমন কুকীর্তি স্থাপনের জন্য গেরুয়া পরিমণ্ডলে যথাক্রমে ‘বুলডোজার বাবা’ এবং ‘বুলডোজার মামা’ রূপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতে ধাপে ধাপে ময়দানে নামেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী, উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রীরা। অত্যুৎসাহে অমিত শাহ-র দিল্লি পুলিশও একসময় বুলডোজার নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল বাড়ি ভাঙতে।
আপাত দৃষ্টিতে জাত-ধর্ম সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে অভিযুক্তের বাড়ি তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে বাড়ি ভাঙছে প্রধানত সংখ্যালঘু মুসলিমদের এবং অবশ্যই দরিদ্র দলিতদের। হিন্দুত্ববাদীদের মতাদর্শগত শত্রুরাই প্রধানত লক্ষ্য বস্তু হয় বুলডোজারের। ঘৃণার রাজনীতি, বিদ্বেষের রাজনীতি, বিভাজনের রাজনীতিকে পুষ্ট করতেই এই বুলডোজার বিচারের আয়োজন অমানবিক স্বৈরাচারী শাসকদের সুপ্রিম কোর্ট সারা দেশের জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দিয়ে এই রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে এমন বেআইনি কাজ যে সরকারি কর্তাদের হাত দিয়ে হবে দায় নিতে হবে তাদের। ভাঙাবাড়ি পুনর্নির্মাণ ও ক্ষতিপূরণের অর্থ নেওয়া হবে তাদের বেতনের টাকা থেকে।
Anarchists rule the jungle
নৈরাজ্যবাদীদের জঙ্গলের রাজত্ব
×
Comments :0