বই — মুক্তধারা, বর্ষ ২
মার্কসবাদের সম্প্রসারিত রূপ লেনিনবাদ
সুবিনয় মিশ্র
মাত্র ৫৪ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনকাল ছিল লেনিনের। ঐ সময়কালে মার্কসবাদের বিজ্ঞানসম্মত সৃজনশীল বিকাশের মর্মবস্তু
আত্মস্থ করেছিলেন লেনিন। তদুপরি তাঁর নিজের সময়কালে মার্কসবাদকে রুশ বিপ্লবের বিজয়ের উপযোগী করে
তুলেছিলেন। সেকারণেই তিনি বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তুলতেও কৃতকার্য হয়েছিলেন।
মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশ্তেহার রচনার সময় এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিক বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা
বলেছিলেন। তখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পৌঁছায়নি। পরে লেনিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে গবেষণা করেন। তৈরি করেন
‘সাম্রাজ্যবাদের নোট বুক’। শেষ পর্যন্ত তাঁকে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘ইম্পেরিয়ালিজম ইজ দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব
ক্যাপিটালিজম’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা লিখতে হয়। কার্যত যা বিপ্লবের ইশ্তেহারে পরিণত হয়ে যায়। পুঁজিবাদ
সাম্রাজ্যবাদের স্তরে এসে পৌঁছালে লেনিন দেখালেন যে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বল জায়গায় আঘাত হেনে পরিস্থিতি
পালটানো যায়। এর মধ্য দিয়ে মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগে তিনি যে কত সিদ্ধহস্ত ছিলেন তা
বিশ্ববাসীর কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যায়। সারা পৃথিবীতে বিপ্লবী আন্দোলনের সামনেও তা পথনির্দেশ হয়ে দাঁড়ায়।
আজ মার্কসবাদ নিয়ে আমাদের হয়তো কথা বলার সুযোগই থাকতো না, যদি লেনিন না থাকতেন। তিনি উপলব্ধি
করেছিলেন যে রুশ দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের গঠন বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বৈপ্লবিক
সংগ্রামকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে প্রেরণা জোগাবে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালও এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, বিশ্বের প্রায়
প্রতিটি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে সহায়তা করেছিল এবং বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে দেশীয় জনগণের
অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের সংযুক্তি সাধনেও সহায়তা করেছিল, যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
কিন্তু মার্কসবাদের পিছনে মানুষের এত জমায়েত কেন এই প্রশ্ন যখন অনেককেই ভাবাচ্ছিল তখন ‘জনগণের বন্ধুরা
কারা...’ প্রবন্ধে লেনিন লিখেছিলেন, যে শত সহস্র শ্রমজীবী মানুষ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এই কারণেই যে
মার্কসবাদ হচ্ছে সেই দর্শন যেখানে বিপ্লব ও বিজ্ঞানের দুটি অভিব্যক্তিই সমন্বিত অবস্থায় বিরাজমান। এবং লেনিনই প্রথম
তাঁর নিজের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী মার্কসবাদকে বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে হৃদয় দিয়ে অনুভব ও প্রয়োগ করেছিলেন এবং
পরবর্তীকালে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়ে তার তত্ত্বগত সম্প্রসারণও করেছিলেন। তাঁর এই মৌলিক অবদানের অপর নাম
হলো লেনিনবাদ। স্তালিন সেই লেনিনবাদকে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা যুগের মার্কসবাদ বলে অভিহিত করেছিলেন।
দেখতে দেখতে লেনিনেরও মৃত্যুর একশত বছর অতিক্রন্ত হয়েছে। এই সময়কালে লেনিনবাদ লেনিনবাদের উদ্ভব ও
বিকাশ নিয়ে আলোচনার খুবই প্রয়োজন রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলায় এই আলোচনাকে উসকে দিতে অমিতাভ
চক্রবর্তীর লেখা ‘দীর্ঘজীবী লেনিনবাদ’ গ্রন্থটির সৌজন্যে। বইটিতে লেনিনবাদের রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে
তেমনি সমকালীন লেনিনবাদ বিরোধী তত্ত্বগুলিরও বাস্তবতা খণ্ডন করে দেখানো হয়েছে। আজকের দিনেও লেনিনবাদ কি
অপরিহার্য? এর উত্তরে বলা যায় লেনিনবাদ হলো প্রকৃতি ও সমাজের বিকাশ ও বিবর্তনের একটি বিজ্ঞান বিশেষ। সংক্ষেপে
মার্কসীয় মতাদর্শে লেনিনের যে অবদানসমূহ ঐ আদর্শকে পুষ্ট করেছে লেনিনবাদ হচ্ছে তারই স্বীকৃতিবিশেষ। মূলত তিনটি
অধ্যায়ে বইটি সজ্জিত— ১। লেনিন : জীবনের শেষ দশক, ২। ট্রটস্কির লেনিনবাদ বিরোধিতা, ৩। ওই পার্টিটা ওখানে ছিল :
এখানে নেই। এছাড়া রয়েছে লেনিনের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি ও নির্দেশিকা।
বইটির প্রথম অধ্যায়ের আলোচনা যেখানে তাঁর জীবনের শেষ দশকের কথা বলা হয়েছে সেটাই তাঁর জীবনের সেরা সময়।
মার্কসবাদকে হৃদয়ঙ্গম করে এই সময়ে তিনি এই বোঝাপড়ায় এসে পৌঁছেছিলেন যে রুশ বিপ্লব’সহ কোনও বিপ্লবই
বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন ও দ্বন্দ্বের যথাযথ বিশ্লেষণের সাথে সাথে দেশীয় পরিস্থিতি এবং দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ ছাড়া সফল হতে পারে না।
বৈশ্বিক স্তরে পুঁজিবাদের বিকাশের পথ অনুসরণ করে লেনিন মার্কসের পুঁজির পর্যবেক্ষণ ও প্রবণতার দিক উল্লেখ করে
বলেছিলেন, পুঁজিবাদ বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে পুঁজির কেন্দ্রিভবন ও সঞ্চয়নের প্রবণতা একটা নতুন স্তরে পৌঁছে একটা
গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর দিকে পরিচালিত হচ্ছে। মার্কস তাঁর নিজের সময়ের শেষদিকে পুঁজির একচেটিয়া প্রবণতার কথা
উল্লেখ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে এঙ্গেলস মার্কসের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে
গিয়েছিলেন। লেনিন দেখালেন যে, বিংশ শতকের শুরুতে, বিকশিত একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুজির শাসন
সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে এসে সামগ্রিক দাসত্বের স্তরে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। যে স্তরকে তিনি সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়
মনে করতেন। এর ফলে সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্বগুলি তৈরি ও প্রকট হয়েছিল তার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করে তিনি
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে বর্তমান স্তরের সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র বিশ্বকে শৃঙ্খলিত করে ফেলেছে ঠিকই, তবে
সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তার দুর্বলতম যোগসূত্রটিকে ছিন্ন করা সম্ভব— যে কাজ মানব সভ্যতার
ইতিহাসে প্রথম রুশ দেশেই সম্ভব হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট অবস্থার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রুশ দেশের জনতার উদ্দেশে
শেষে তিনি শান্তি, রুটি ও জমির দাবিকে সামনে রেখে জনতার আন্দোলনকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী
দ্বন্দ্বকে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে) তিনি গৃহযুদ্ধে পরিণত করার ডাক দিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত রুশ বিপ্লবী
আন্দোলনকে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরে লেখক আলোচনা করেছে ট্রটস্কির ভূমিকা নিয়ে। কেন
ট্রটস্কি লেনিনবাদের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, লেনিনের সঙ্গে তাঁর কি আদর্শগত প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ছিল? তিনি কি
সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলেন ইত্যাদি।
যাঁরা লেনিনবাদ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পেতে চান তাঁরা বইটি থেকে উপকৃত হবেন।
দীর্ঘজীবী লেনিনবাদ।
অমিতাভ চক্রবর্তী। বহুবচন প্রকাশনী। হালিশহর, বাণীমন্দির, উত্তর ২৪ পরগণা। ৫৫০ টাকা।
Comments :0