BOOK TOPIC — BHODOR BAHADUR | SOURAV DUTTA — NATUNPATA — 1 MAY 2024

বইকথা — ভোঁদড় বাহাদুর | সৌরভ দত্ত — নতুনপাতা | ১ মে ২০২৪

ছোটদের বিভাগ

BOOK TOPIC  BHODOR BAHADUR  SOURAV DUTTA  NATUNPATA  1 MAY 2024

বইকথা

আলোআঁধারির ছায়া ঘেরা স্বপ্নময় রূপকথার মাধ্যম : ভোঁদড় বাহাদুর
সৌরভ  দত্ত

নতুনপাতা

গ্রীষ্মের গলদঘর্ম দুপুরে খসখস লাগানো চিলেকোঠায় সঙ্গী বলতে বই আর কুঁজোয় রাখা জল।খড়খড়ির ভিতর দিয়ে যতদূর চোখ যায় সামনের পুষ্করিণী ও প্রাচীন আমগাছের পত্রমর্মের শব্দ,ধূ-ধূ রাস্তা দিয়ে আইসক্রিম বিক্রেতার চলে যাওয়া।এর ফাঁকেই বিছানায় তেরছাভাবে শুয়ে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বইয়ের ভিতর টুক করে ঢোকে পড়া।যাকে বলে এন্ট্রি আর কি!এই ছিল ছেলেবেলার বই পড়ার নেশা।এখন যদিও চিত্রটা বেশকিছুটা বদলেছে।গুগল এর দৌলতে বই পড়া কমলেও মুঠোফোনের হাতছানি এড়িয়ে নিদাঘ দুপুরে একটা অদ্ভুত সুন্দর বই হাতে আসে।বইটির নাম ভোঁদড় বাহাদুর।বইটির রচয়িতা–গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।বইটির রচনাকাল ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।ছাপা হয়েছিল–সিগনেট প্রেস থেকে।বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন সত্যজিৎ রায়।ভিতরের ছবি এঁকেছেন বিরথ দত্ত।রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা চিনি রঙ্গ-ব্যঙ্গ ও কার্টুন চিত্রের শ্রষ্টা হিসাবে।মূলত লিথোগ্রাফে আঁকা তাঁর বঙ্গীয় ঘরানার কার্টুন চিত্রের সিরিজ গুলি এক কথায় অনন্য।যা শিশুদের মনের মধ্যেও এক রসের আবেদন সৃষ্টি করে।ভোঁদড় বাহাদুর।বইটির নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অনাবিল হাস্যরস।পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বইয়ের ছবিগুলি বেশ ভিন্নমাত্রা যোগ করে।বইয়ের সূচনা হচ্ছে এইভাবে–"আজ নবমী পুজোয় পাড়ার মল্লিকবাবুদের বাড়িতে ভয়ানক ধুম।বোমা,দুদমা,ঢাক,ঢোল,সানাই আর তিন দল ইংরেজি বাজনার বেজায় আওয়াজে অনেক রাত অবধি ঘুম এল না"--অর্থাৎ ধুমধাম করে বাবুদের বাড়ি দুর্গাপুজো হচ্ছে।সেখানেই ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে লেখক দেখেছেন–"আমাদের চৌতলায় ছাতের বুড়ো ভোঁদড় খুব জমকালো মখমলের সাজ-গোজ পরে আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সিগার ফুঁকছে।"অনেকদিন পর তাকে দেখে কথক খুশি হয়েছেন।ভোঁদড়কে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন–"মল্লিকবাবুদের বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল বুঝি?"ভ‍োঁদড় তার উৎকন্ঠার কথা বলেছেন–"ছেলেপিলে নিয়ে ওখানে আর থাকতে সাহস হয় না।"তার ছেলে নিচুয়া চিৎকার করে বলে–"বাবা,অন্ধকারে তুমি এই জানোয়ারকে চিনতে পারনি?ও আমাদের চিরকালের শত্রু।সেই চুটুপালু বনের দু-মুখো রাক্ষস,এখন বেড়ালের রূপ ধরে শহরে উৎপাত করতে এসেছে।'ভোঁদড় লাঠির কানে কানে বলেছে–"লাঠিভায়া,দুষ্টুরাক্ষসকে একবার তোমার তাল-বেতালি কারদানিটা বেশ ভালো করে দেখিয়ে চট্ করে আমার হাতে ফিরে এস।"এরপর লাঠি তার থেকে ছিটকে গিয়ে কিভাবে দু-চার ডিগবাজির পর তাল ঠুকে রাক্ষসের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।ঠিক তখনই–"রাক্ষসের চারদিকে ঘুরতে আরম্ভ করলে,অমনি তার মাথা দিয়ে লাল-নীল-সবুজ রঙের আগুন দপদপিয়ে জ্বলে উঠল।"এভাবেই আগুনের আগুনের বেড়াজাল রাক্ষসের পালাবার পথ বন্ধ করে দিয়ে রাক্ষসকে নাস্তানাবুদ করে তুলল।গোটা রচনার মধ্যে ম্যাজিক রিয়্যালিজম আপাদমস্তক বিন্যস্ত রয়েছে।যা শিশুদেরকে বেশ কৌতূহলদ্দীপক করে তোলে।মল্লিকবাড়ির বাবুদে পাঁচতলার উপর থাকা এক পাগলাঘন্টির কথা এসেছে।ঘন্টিটা রক্ত চক্ষুতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার পর কিভাবে যেন ঘড়িটা মানুষের মতো ঘুমিয়ে পড়ল।অখ্যানের ভিতর এক অদ্ভুত আয়নার বর্ণনার ছবি অঙ্কিত হয়েছে–"আমার সামনের বড় আয়নার ভিতর থেকে মোটা-সোটা হ্যাট কোট-পরা একটা কুকুর,একটা লাল কাঠের ঘোড়ায় চড়ে,টগবগ করে বেড়িয়ে আমার সামনে এসে রাশ টেনে তার ঘোড়া থামাল।"তারপর কুকুরটি সেলাম ঠুকে জানায়–"আমার নাম বকমল,আমি ভোঁদড় মহারাজের প্রধান সেনাপতি।"লেখক অন্ধকারে সিঁড়ি ভেঙে ছুটে গিয়ে দেখেছেন–"হাজার-হাজার ভোঁদড়, বড়-বড় কেঁদো বেড়াল,নানারকমের খরগোশ আর কাঠবেড়ালীতে আমাদের ছাত একেবারে ভরে গেছে।"রচনায় এসেছে বহু আকর্ষণীয় চরিত্র।যেখানে দেখা যায় শেয়াল ঢোল বাজিয়ে নাচতে-নাচতে নাপিত-ভায়ার বাড়ির দিকে চলে গেল।" বুদ্ধিমন্তর কপালে একটি লাল দাগ লক্ষ্য করে তাকে কথক বলেছেন–"তোমার কপালে ওটা কিসের দাগ হে?"বুদ্ধিমন্তর বলে চলে–"অনেক কাল আগে আমি কুসুমবতী নগরীর অধিপতি ছিলুম।আমার চার মহিষী ছিল।জগদীশ্বর আমাকে নানা জনপদের অধীশ্বর করে অসংখ্য প্রজাগণের হিতাহিত-চিন্তার ভার দিয়েছিলেন।"রচনার শেষার্ধে রয়েছে বুড়িমার অন্তর্ধানের কথা।তারপর কথকরা কিভাবে নীল পাখির গীতে অভিভূত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন সেই প্রসঙ্গ।সবশেষে দেখা যায়–"পাড়ার বুড়ো পূর্ণবাবু হুঁকো হাতে আমার সামনে একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ কোলে করে ঢুলছেন।"সমগ্র "ভোঁদড় বাহাদুর"--কথাকাহিনিতে চিত্রকর গগেনেন্দ্রনাথ শিশুর মনোজগৎ এর উপযোগী এক অনুপম স্বপ্নময়তার চলচ্ছবি এঁকেছেন।কিছুটা ননসেন্স ভার্সের বর্ণময় মিশেলে রূপকথার পরতে পরতে জমা হয়েছে রহস্যের মায়াবীচিহ্ন যা খুদে পাঠককে সহজেই আকৃষ্ঠ করে।বিশেষত গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে সাজানো শৈল্পিক সাদাকালো রেখাগুলি এক অনবদ্য।যার মধ্যে ঢোলক কাঁধে ভোঁদড় বাহাদুরের কল্পচিত্রটি খুব সুন্দর।

গ্রন্থনাম : ভোঁদড় বাহাদুর
লেখক : গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর 
প্রকাশক : সিগনেট প্রেস
প্রচ্ছদপট : সত্যজিৎ রায়
সহায়তা করেছেন : পীযূষ মিত্র 
ছবি : বিরথ দত্ত 
প্রকাশকাল : ১৩৩৩

Comments :0

Login to leave a comment