‘আমার কি পরীক্ষা দেওয়া হবে না?’ মাকে জিজ্ঞাসা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছোট্ট মেয়েটির। অশ্রুসজল চোখে মেয়েটির প্রশ্নের মুখে মা-ও বাক্রুদ্ধ। ছোট্ট মেয়েটির জিজ্ঞাসার কোনও জবাব নেই মায়ের মুখে। নিদারুণ দারিদ্রের মাঝেও অন্যের কাছ থেকে এটা ওটা সাহায্য সহায়তা নিয়ে বই খাতা জোগাড় করে আজ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। দিন দশেক বাদে শুরু হবে পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষায় বসাটাই এখন ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে। এই সময় মেয়েটির প্রশ্নের কি জবাব দেবে বাবা মা!
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসারের। অভাব অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। বাবা-মা দুজনেই দিনমজুর। খোয়াইয়ের পূর্ব সোনাতলা কলোনি গ্রামে বাড়ি। নিদারুণ দারিদ্রের সাথে অহরহ চলে অসম যুদ্ধ। তবু একমাত্র মেয়েটির পড়াশোনার খরচ জোগাতে প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছেন বাবা মা দুজনেই। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে দিন হাজিরার কাজ। মেয়েটিও পড়তে চায়। সোনাতলার অশোকবন কলোনি হাই স্কুলের পরীক্ষার্থী সে।
এখন তাদের সবাই বাড়িঘর ছাড়া। বৃহস্পতিবার ভোট গণনার দিন থেকে তাদের আস্তানা এখন সিপিআই(এম)’র খোয়াই মহকুমা কমিটির অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে। জয়ের আনন্দে গ্রামের বিশটা বাড়িতে বেপরোয়া সন্ত্রাস চালায় বিজেপি’র দুষ্কৃতীরা। বাদ যায়নি গরিব দিনমজুর পরিবারটিও। ঘরের টিনের বেড়া থেকে শুরু করে দরজা জানালা আর সব আসবাবপত্র ভেঙেচুরে একাকার। রেহাই পায়নি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বই খাতা কাগজ কলম সহ তার জামা কাপড় সবকিছু।
চোখের সামনে বইপত্র নষ্ট হতে দেখে বিজেপি দুষ্কৃতীদের কাছে আকুতি করে, ‘আঙ্কেল, আমি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবো। এগুলো আমার বই খাতা। আমার স্যার দিদিমণিরা আমাকে দিয়েছে এগুলো। আমাকে মারো কিন্তু আমার বই খাতা শেষ করে দিয়ো না।’ মেয়েটির কাতর আর্তনাদেও মন গলেনি গেরুয়া সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত বাহিনীর। চোখের পলকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় পুরো বাড়িটিকে। চুরমার করে দেয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েটির সব সাধ আহ্লাদ সহ ভবিষ্যতের লালিত স্বপ্নকে।
তাদের আস্তানা এখন সিপিআই (এম)’র অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে। একাধিক শিবিরে এধরনের শত শত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এখন কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলছে। কঠোর পরিশ্রম আর পড়াশোনা সব ব্যর্থ হতে চলেছে। আশ্রয় শিবিরে দেড়শো দুশো লোক এখন সতরঞ্চির ওপর গাদাগাদি করে রাত কাটায়। দু’বেলা খিচুড়ি অথবা আলু সেদ্ধ ভাত। পড়াশোনার পরিবেশ কোথায়! বই খাতা কাগজ কলম কিছুই তো নেই।
শুধু কি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী? বিভিন্ন স্কুলের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির পাঠরত আরও অনেক পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদেরও এখন আশ্রয় এধরনের শিবিরে। এক দুই দিনের মধ্যেই শুরু হবে ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা। তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। ক’জন আর বসতে পারবে পরীক্ষায়! আশ্রয় শিবিরে বই খাতা নিয়ে এলেও সন্ত্রাসের আবহের মাঝে পড়াশোনা করার সুযোগ কি আছে! সেকেন্ডে সেকেন্ডে আসছে আগুন সন্ত্রাস ভাঙচুর লুটপাটের খবর।
সিপিআই(এম) নেতাদের মোবাইল বেজে চলছে সারাক্ষণ। মোবাইল ফোনে ভেসে আসছে আতঙ্কিত আর ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের আর্ত চিৎকারের আওয়াজ। সারা রাত শুধু পুলিশ ভ্যান আর দমকল বাহিনীর গাড়ির সাইরেন। ভেসে আসছে অসহায় মানুষের বাঁচাও বাঁচাও আর্ত চিৎকার আর আর্তনাদের হাহাকার। সঙ্গে বাইক বাহিনীর পৈশাচিক উল্লাসের শব্দ।
সন্ত্রাস কেড়েছে মাধ্যমিক আর দ্বাদশ পরীক্ষার্থী সহ স্কুলগুলোর পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বাড়িতে চেয়ার টেবিল কিংবা তক্তপোষের মধ্যে বসে যাদের এখন পরীক্ষার প্রস্তুতির শেষ পর্বের ব্যস্ততার চূড়ান্ত সময় পার করার কথা, তারা এখন অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে বড়দের সঙ্গে শতরঞ্চির ওপর শুয়ে বিনিদ্র রজনী পার করছে। কেন তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার? কে দেবে তার উত্তর!
BJP tripura
‘আঙ্কেল আমাকে মারো, বইপত্র নষ্ট করো না’ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর আকুতিতেও নির্বিকার ওরা
×
Comments :0