Potato farmers in crisis

রাজ্য সরকারের নীতির কারণে সংকটে উত্তরবঙ্গের আলু চাষীরা

রাজ্য

রাজ্য সরকারের অদূরদর্শী ও বিজ্ঞানসম্মত নীতির অভাবে উত্তরবঙ্গের আলু চাষ এবং এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা আজ গভীর সংকটের মুখে। অভিযোগ, আলুর দাম সামান্য বৃদ্ধি পেলেই ভিনরাজ্যে আলু রপ্তানির উপর রাজ্য সরকার অযৌক্তিক কড়াকড়ি শুরু করে। এই আন্তঃরাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক বাধা-নিষেধের ফলে উত্তরবঙ্গের আলু এখন তার চিরাচরিত বাজার—অসম, বিহার এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে উত্তরপ্রদেশের আলু।

​এই বছরের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। বাজারের তথ্য বলছে, সরকারি কড়াকড়ির ফলে বাংলার উপর নির্ভরতা কমাতে আসাম সরকার এখন তাদের রাজ্যের আলু চাষিদের নানা সুবিধা দিচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, আসাম জুড়ে এবার 'আগরি পোখরাজ' আলুর বীজের বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছে। আসামের নগাঁও, সোনিটপুর, বরপেটা, গোয়ালপাড়া থেকে তিনসুকিয়া পর্যন্ত আলু চাষের হিড়িক পড়েছে।

ব্যবসায়িক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবছর আসামে আলু চাষের এলাকা প্রায় তিনগুণ বাড়ছে। এর ফলে আগামী মরসুমে উত্তরবঙ্গের আলুর বাজারে বড়সড় ধস নামার আশঙ্কা করছেন এই চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সকলে।
ধূপগুড়িকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বড় গাড়ি আলুবীজ উত্তরবঙ্গ ও আসামের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিক্রি হয়। মূলত পঞ্জাব থেকে আগত আগরি পোখরাজ প্রজাতির বীজই এর বড় অংশ। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, এবার প্রায় পাঁচ–ছয়শো গাড়ি আগরি বীজ বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
​উত্তরবঙ্গ আলু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোপাল পাল এই প্রসঙ্গে সরাসরি সরকারের নীতির সমালোচনা করে জানান, “আলু রপ্তানিতে আন্তঃরাজ্য সীমান্তে প্রশাসনিক কড়াকড়ির ফলে আসাম সরকার এখন বাংলার উপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। তাই সেখানে চাষিদের নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছর যেখানে শতাধিক গাড়ি আলুবীজ যেত, এবছর তা বেড়ে চারশো গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাবে। রাজ্যের ভ্রান্ত নীতির ফলস্বরূপ আমরা আমাদের বাজার হারাচ্ছি।”

রাজ্য সরকারের এই ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন সারা ভারত কৃষকসভার জলপাইগুড়ি জেলা নেতা মুকুলেশ রায় সরকার। তিনি সরকারের নীতিকে 'কৃষক-বিরোধী' বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “উত্তরবঙ্গের আলু চাষের সঙ্গে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা জড়িত। বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। অথচ রাজ্য সরকারের অবৈজ্ঞানিক ও খামখেয়ালি নীতির কারণে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন। রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের ফলে ভিনরাজ্যে আলু চাষ বাড়ছে, আর আমাদের উত্তরবঙ্গের বাজার সংকুচিত হচ্ছে। সরকার অবিলম্বে এই বিপর্যয় ঠেকাতে নীতিগত হস্তক্ষেপ করুক।”
​পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জলপাইগুড়ি জেলায় প্রতিবছর প্রায় ১০০০০ হেক্টর জমিতে আগরি পোখরাজ আলুর চাষ হয়। নদীর চরভূমি ও বেলে মাটিতে এই চাষ বেশি হলেও এবছর দীর্ঘ বর্ষা ও বন্যায় জলঢাকা এবং তিস্তার চরের বহু এলাকায় ফসল মার খাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তার ওপর প্রতিবেশী আসামে আলু চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ উত্তরবঙ্গের চাষিদের উদ্বেগ আরও বহুগুণ বাড়িয়েছে।
​আসামের নগাঁও আলুবীজ ব্যবসায়ী সঞ্জয় দাস বলেন, “এবছর বন্যা কম হওয়ায় আসামে আলু চাষের এলাকা অনেক বেড়েছে। বড় ব্যবসায়ীরাও এবার নিজেরা চাষ করছেন। যদি ফলন ভালো হয়, তাহলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজারে বাংলার আলুর জায়গা অনেকটাই কমে যাবে।”

ধূপগুড়ি ও আশপাশের এলাকায় আলু শুধুই কৃষিপণ্য নয়—এটি স্থানীয় অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। এর সঙ্গে যুক্ত চাষি, ব্যবসায়ী, পরিবহন, হিমঘর, এমনকি স্থানীয় ভোটের বাজারও আলুর উপর নির্ভরশীল। ফলে রপ্তানি কমে গেলে গোটা অঞ্চলের অর্থনীতিতেই গভীর টান পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
​ব্যবসায়ী তপন পাল এবং রাজু ঘোষ সরকারের কাছে স্পষ্ট দাবি জানিয়েছেন, ​“সরকার যেন ভিনরাজ্যে আলু রপ্তানিতে বাধা না দিয়ে একটি স্থায়ী, স্পষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত নীতি প্রণয়ন করে। তবেই উত্তরবঙ্গের আলু শিল্প টিকে থাকবে, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জীবিকা সুরক্ষিত হবে।”
​আলু চাষ ও বাণিজ্য বাঁচাতে অবিলম্বে নীতিগত হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

Comments :0

Login to leave a comment