পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে মোদীর গণতন্ত্র ধ্বংসকারী বুলডোজারের চালকের ভূমিকা পালন করছেন মমতা ব্যানার্জি বলে অভিযোগ করলেন গণআন্দোলনের নেত্রী বৃন্দা কারাত। শুক্রবার কলকাতায় রানি রাসমণি রোডে বিশাল মহিলা সমাবেশে তিনি এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেছেন, ‘‘মহিলাদের অধিকার রক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পথে এগোতে হলে বিজেপি এবং তৃণমূল দুই শক্তিকেই হটাতে হবে। ওদের বিষাক্ত রাজনীতিতে মহিলারা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন। মোদী দিল্লিতে বসে বুলডোজারের রাজনীতি করছে, আর পশ্চিমবঙ্গে সেই বুলডোজারের স্টিয়ারিং হাতে বসে আছে তৃণমূল।’’
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ডাকে এদিন মহিলাদের ‘প্রতিরোধের সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হয়। মাঝে বৃষ্টি এলেও রাস্তা উপচে পড়া এই সমাবেশে মহিলা আন্দোলনের নেত্রীবৃন্দ ভাষণ দিয়েছেন। সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় আক্রান্ত মহিলা প্রার্থীরা, শহীদদের পরিবারের মহিলারা। শহীদদের সেলাম জানিয়ে, লড়াকু সাহসী মহিলা আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন বৃন্দা কারাত, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মারিয়াম ধাওয়ালে, সভাপতি পি কে শ্রীমতি, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক কনীনিকা ঘোষ, রাজ্য সভাপতি জাহানারা খান, কার্যকরী সভাপতি দেবলীনা হেমব্রম, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী রেখা গোস্বামী, মিনতি ঘোষ, অঞ্জু কর প্রমুখ।
মারিয়াম ধাওয়ালে এবং পি কে শ্রীমতি বিশাল মহিলা সমাবেশকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘‘আগামী ৫ অক্টোবর দিল্লির বুকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মহিলা সমাবেশ হবে। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলারা যোগ দেবেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আপনারাও যোগ দেবেন দিল্লির সমাবেশে। যারা দেশ বিক্রি করছে, তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, হিন্দুস্থান ওদের নয়, আমাদের সবার।’’
বৃন্দা কারাত বলেছেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আপনারা সাহসের সঙ্গে যেভাবে লড়াই করেছেন তা সারা ভারতে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত হয়েছিল মহিলা আন্দোলনের জেরে। কিন্তু তৃণমূলের গুন্ডারা পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাধা দিতে আক্রমণ করেছে, সন্ত্রাস করছে, তার পরেও মহিলারা যেভাবে লড়াই করেছেন সেটাই প্রতিরোধের সংগ্রাম। ভোটে হারুন জিতুন যাই হোক, আপনারা সারা দেশের মানুষের কাছে জয়ী হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে আপনারা মোদীর আক্রমণ এবং মমতা ব্যানার্জির আক্রমণ দুয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। আমি রাস্তায় দেখলাম লেখা রয়েছে, দুয়ারে সরকার। কিন্তু সরকার কোথায়, মানুষ তো বলছে দুয়ারে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুট। দুয়ার থেকে এই লুটেরাদের ছায়াও মুছে ফেলার জন্য তৈরি হতে হবে।’’
বৃন্দা কারাত বলেছেন, ‘‘সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কাছে লড়াইটা রাজনৈতিক, কারণ আমরা জানি যে সরকারের নীতিই মহিলাদের দুর্দশার জন্য দায়ী। মোদী সরকার আদানি-আম্বানিদের স্বার্থে কাজ করছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঠেকাতে মানুষকে ভাগ করছে ধর্মের নামে। অনেকে ভেবেছিল, ওরা তো কেবল মুসলিমদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছে, অন্যরা নিরাপদ। না, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকে ভাঙতে পারলে কেউই নিরাপদ নয়। বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি থেকে কেউ বাঁচবে না। মণিপুরের ঘটনা তার প্রমাণ। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন আসছে, এবার আরএসএস-বিজেপি’র সরকারকে হটাতে না পারলে মহিলারা ভারতের কোথাও নিরাপদ থাকবেন না।’’
মারিয়াম ধাওয়ালেও মোদী সরকারের নীতির জন্য মহিলাদের দুর্দশার উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, আনাজ গুদামে, পাতে খাবার নেই। স্কুল কলেজ ব্যাঙ্ক বিমা রেল সর্বত্র শূন্যপদ। হাতে কাজ নেই, ঘরে উনুন জ্বলবে কী করে? যারা দেশ বিক্রি করে দিতে চাইছে, তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, দেশ ওদের নয়। হিন্দুস্তান হামারা হ্যায়।’’ পি কে শ্রীমতি বলেছেন, ‘‘মোদী এবং মমতা ব্যানার্জি দু’জনেই চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোথায় কাজ? গণতান্ত্রিক সংবিধান ভেঙে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চাইছে, তাতে মহিলাদের অধিকার সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাবে।’’
কনীনিকা ঘোষ বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলদাস পুলিশ ও প্রশাসনকে যুক্ত করে তৃণমূল গোড়া থেকে সন্ত্রাস চালিয়েছে। মহিলারা মনোনয়ন দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে থেকেছেন, মার খেয়েছেন, তবুও লড়েছেন নির্বাচনে। এটাই প্রতিরোধ। বাংলার মানুষ দেখেছেন আরজুনা বিবিরা আক্রমণের প্রতিরোধ করতে করতে লোহা থেকে ইস্পাতে পরিণত হয়েছেন। এই প্রতিরোধের সংগ্রাম চলবে। বিজেপি যে মনুবাদ চাপিয়ে দিতে চাইছে তা মেয়েদের অধিকার মানে না, মেয়েদের পূর্ণ মানব বলেই মানে না।’’
সমাবেশকে অভিনন্দন জানিয়ে এছাড়াও ভাষণ দেন দেবলীনা হেমব্রম। সভাপতিত্ব করে জাহানারা খান বলেছেন, ‘‘রাজ্যজুড়ে প্রতিদিন নারী নির্যাতন ঘটছে, শাসকদল মদত দিচ্ছে দুষ্কৃতীদের। মিড ডে মিল, আশা কর্মীদের পারিশ্রমিক বাড়ছে না, মন্ত্রী বিধায়কদের ভাতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু এরাজ্যেই মহিলারা ধর্ষিতা হচ্ছেন না, বিজেপি শাসিত রাজ্যে ধর্ষকদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে বরণ করা হচ্ছে। তাই বিজেপি এবং তৃণমূল দু’য়ের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্র করতে হবে।’’
এদিনের সমাবেশে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষ এসেছিলেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার দগদগে স্মৃতি নিয়ে। ক্ষোভে ফুটছিলেন তাঁরা। এসেছিলেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে শহীদ রাজিবুল হক এবং মনসুর আলমের পরিবারের সদস্যরাও। তাঁদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রীবৃন্দ। এছাড়াও পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন এমন অনেক লড়াকু মহিলাও যোগ দিয়েছিলেন এদিনের সমাবেশে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ লড়াই করে রীতিমতো জয়ী হয়েছেন। বারবনী, ভাঙর ২ নম্বর ব্লক, তারকেশ্বর ও উলুবেড়িয়ার মহিলা প্রার্থীরা এদিন মঞ্চে উঠে সমবেত মানুষকে শুনিয়েছেন কীভাবে মনোনয়ন জমার সময় থেকে গণনাকেন্দ্র পর্যন্ত তৃণমূল তাঁদের ওপরে হামলা চালিয়েছে। গোটা সমাবেশ তাঁদের লড়াইকে করতালি ও স্লোগানে সেলাম জানিয়েছে। প্রতিরোধরে বার্তা এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে।
Comments :0