Post Editorial

নয়া ফ্যাসিবাদের নয়া ষড়যন্ত্র

উত্তর সম্পাদকীয়​

শমীক লাহিড়ী

এনসিআর, এনপিআর, সিএএ, এসআইআর, বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশি বলে তাড়িয়ে দেওয়া– এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনাসমূহ, নাকি একই গ্রন্থিতে গাঁথা– এই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। যদি বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে একরকমভাবে ভাবতে হয়। আর যদি এগুলো বৃহত্তর কোনও পরিকল্পনার বিভিন্ন পদক্ষেপ হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে, কি সেই বৃহত্তর পরিকল্পনা।
আপাত দৃষ্টিতে এনপিআর, এনআরসি এবং সিএএ, নিবিড় ভোটার তালিকা তৈরির (Special Intensive Revision)  এই পদক্ষেপগুলো একই উদ্দেশ্যে রচিত নয়। 
এনপিআর’র প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেক সাধারণ অধিবাসীর (Ordinary Resident) সম্পূর্ণ পরিচয় সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার বা ডেটাবেস তৈরি করা। এনপিআর’র মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য যেমন— নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, জন্মস্থান, বৈবাহিক অবস্থান, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি এবং বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সরকারের দাবি, এনপিআর বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা এবং সুযোগ-সুবিধাগুলিকে আরও কার্যকরভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে। এনআরসি’র প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভারতের প্রকৃত নাগরিকদের চিহ্নিত করে তাদের একটি তালিকা তৈরি করা। এর লক্ষ্য হলো ভারতে অবৈধভাবে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বিশেষত অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করা।
সিএএ’র উদ্দেশ্য কি? ২০১৯ সালে সংশোধিত সিএএ’র উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা, মুসলমান বাদে। 
হঠাৎ কেন এসআইআর 
এসআইআর’র উদ্দেশ্য হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য সঠিক ভোটারদের একটি নির্ভুল তালিকা তৈরি করা। ভারতের নির্বাচন কমিশন এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করছে। সামগ্রিক ভোটার তালিকার সংশোধনের (এসআরইআর) কাজ বছরে ৪ বার হয়, যাকে বলা হয় এসআরইআর। প্রতি বছর সাধারণভাবে অক্টোবর মাসে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ হয় এবং পরের বছর ১ জানুয়ারি নতুন খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়। এবার নির্বাচন কমিশন হঠাৎ কেন এসআরইআর’র পরিবর্তে এসআইআর করতে চাইছে? তাহলে কি স্বাধীনতার পর থেকে এসআরইআর’র কাজ ছিল অর্থহীন?
মৃত, স্থানান্তরিত, দু’বার বা দুই জায়গায় নাম আছে, নিখোঁজ ভোটার চিহ্নিত করার জন্য এসআরইআর কেন কার্যকরী নয়, একথা নির্বাচন কমিশন কোথাও উল্লেখ করছে না। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড কেন প্রামাণ্য নথি হিসাবে গণ্য করতে চাইছে না কমিশন? এগুলো তো সরকারি নথি। এগুলো নাকি ভুয়ো বানানো যায়, তাই এগুলোকে গ্রাহ্য করা হবে না, এটাই জানিয়েছে কমিশন সুপ্রিম কোর্টে? 
এসআইআর নির্দেশিকা অনুসারে, ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। এটাকে নির্বাচন কমিশন বাধ্যতামূলক করেছে। যাদের জন্ম ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের পরে, তাদের ক্ষেত্রে বাবা-মা উভয়ের নথি প্রয়োজন এবং যদি কোনও একজন অর্থাৎ বাবা বা মা বিদেশি নাগরিক হন, তাহলে জন্মের সময়কার পাসপোর্ট ও ভিসার রেকর্ড জমা দিতে হবে। ১১টা নথি গ্রহণযোগ্য বলে কমিশন জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে প্রশ্ন উঠেছে, আধার, ভোটার ও রেশন কার্ড জাল করা গেলে এই ১১টি নথি যে জাল করা যাবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?
প্রসঙ্গত সুপ্রিম কোর্টে একটি চমকপ্রদ তথ্য দাখিল হয়েছে। রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট যাকে কমিশন ভোটার তালিকায় নাম তোলার ক্ষেত্রে মান্যতা দিয়েছে, সেই সার্টিফিকেটের মোট সংখ্যা বিহারের বর্তমান মোট জনসংখ্যার চাইতে বেশি। তাহলে সেটাকে কমিশন মান্যতা দিয়েছে কোন যুক্তিতে? বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে জোকারের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, শুধুমাত্র আরএসএস-বিজেপি’র নির্দেশ পালন করতে গিয়ে।
এসআইআর’র উদ্দেশ্য কি? 
কি অতিরিক্ত সুবিধা হবে ২০২৪ সালের ভোটার তালিকার পরিবর্তে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করলে, এরও কোনো উত্তর নেই। বাংলাদেশি বা মায়ানমারের কতজন নাগরিকের নাম বাদ গেল বিহারে সদ্য প্রকাশিত খসড়া ভোটার তালিকায়, তা  জানায়নি কমিশন। তথচ বিদেশি অনুপ্রবেশকারীরা নাকি কাতারে কাতারে এসে বিহারে এবং অন্যান্য রাজ্যের ভোটার তালিকায় নাম তুলে ফেলেছে, এই তো কমিশনের অভিযোগ ছিল। আর তাই তো এসআরইআর’র পরিবর্তে এসআইআর। তা সেই কাজ হলো কি? ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে বিহারে গত শুক্রবার প্রকাশিত খসড়া তালিকায়। এরা কারা?
আসল পরিকল্পনা কি?
এই প্রতিটি পদক্ষেপ একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কি সেই পরিকল্পনা? জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ এদের স্বপ্ন ছিল ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ার। পাকিস্তানের মতোই একটি উগ্র ধর্মান্ধ, সভ্যতা যুক্তিবাদ বিজ্ঞান বিবর্জিত একটি অন্ধকার সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরা থেকে যায় এই তথাকথিত উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের। কারণ স্বাধীন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ দেখতে চেয়েছিল এদেশের হিন্দু মুসলমান শিখ জৈন পার্সি বৌদ্ধ নাস্তিক সহ সবাই। সব ধর্ম ভাষা সংস্কৃতি খ্যাদ্যাভ্যাসের সমান মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে। ফলে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে ব্রিটিশদের পদলেহনকারী আরএসএস সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর। এখন ১৫ বছর সরকার চালাবার গ্যারান্টি পেয়ে সেই পুরানো পরিকল্পনাকেই বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এগচ্ছে এরা।
নয়া কৌশল কি?
প্রথমে আতঙ্ক ছড়াও। মানুষের অধিকার কেড়ে নাও। অধিকার মানে কাজ পাওয়া, শিক্ষা চিকিৎসা খাদ্য বাসস্থানের অধিকার, সুস্থ পরিবেশ, উন্নত পরিকাঠামো সহ দেশের নাগরিকদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে যেন কেউ ভাবার সুযোগই না পায়। অবাধে দেশের সম্পদ লুটের ক্ষেত্র বানিয়ে দাও হাতেগোনা কিছু দেশি বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানির জন্য। আর নজর ঘোরাতে নিজেরই নাগরিকদের রাষ্ট্র হুকুম দেয়, নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করো, না হলে দেশছাড়া হতে হবে। নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বাপ ঠাকুর্দার আমলের নথিপত্র বের করো, না পেলে দেশান্তরী। তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকুক সাধারণ মানুষ।  
ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে
পুরানো নথিপত্র যাদের হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের সরকারি দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করতে হবে। আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষকে চরম হয়রানির মুখোমুখি হতে হয় যে কোনও হারানো নথি পেতে হলে। এই হয়রানি এড়াতে দালাল চক্র তৈরি হয়। যাদের অর্থ আছে তারা দালাল চক্রকে অর্থ দিয়ে কাজ সেরে ফেলতে পারেন অথবা নিজেরা গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে এসব উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরায় যে পরিবারগুলোর, তাঁদের কী হবে? 
১৪০ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে ৮০ কোটি ২ টাকা কিলো চালের আশায় লাইন দেন। তাঁরা পারবেন এসব হারিয়ে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ২০/২৫ বছর আগের নথিপত্র জোগাড় করতে। ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় কারোর বাবা-মা’র নাম না থাকলেই তাঁকে কেন প্রমাণ দিতে হবে যে তিনি এদেশের নাগরিক? আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড রাতারাতি কোনও এক ব্যক্তির ফরমানে বাতিল কেন? বিহারে যে ৬৫ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেল, তার ৭৫-৮০ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। কেউ খেতমজুর, কেউ পরিযায়ী শ্রমিক, কেউ ভূমিহীন কৃষক, কেউ গৃহ পরিচারিকা। ফি বছর বন্যায় বা যাযাবরের মতো ঘুরে ঘুরে কাজের সন্ধানে ব্যস্ত শ্রমজীবীদের ২২ বছর আগের বাপ-ঠাকুর্দার নথি কোথায় চলে গেছে তার ঠিক আছে! 
আধার ভোটার কার্ড সহ যে পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে কাজ করতে গেছেন, তাদেরও অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি দাগিয়ে জবরদস্তি বাংলাদেশ, মায়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরা সবাই মূলত শ্রমিক এবং দরিদ্র। কেন? উচ্চপদে বা উচ্চ বেতনে কর্মরতদের কিন্তু বিজেপি অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে না এখনই। প্রতিবাদ প্রতিরোধ না হলে, এদের অবশ্য ভবিষ্যতে কি হবে এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ফ্যাসিস্তদের ইতিহাস কিন্তু বলছে, এরা কাউকেই ছাড়ে না। ফলে ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে– এই প্রবাদ বাক্যটি সকলেরই মনে রাখা দরকার। 
ফিরে দেখা
অতীতে ফ্যাসিস্তদের কার্যকলাপের দিকে ফিরে দেখা দরকার। 
প্রাথমিক বৈষম্যমূলক আইন: হিটলার ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই ইহুদিদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন শুরু করে। প্রথম দিকে, এই আইনগুলির লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জার্মান জনজীবন থেকে দূরে রাখা। এর মধ্যে ছিল— সরকারি চাকরি থেকে অপসারণ, ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক ইত্যাদি পেশা থেকে ইহুদিদের বাদ দেওয়া। ইহুদি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি বয়কট করা, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম এবং সমবেত হওয়ার অধিকার নিষিদ্ধ করা সহ আরও অনেক সামাজিক নিষেধাজ্ঞা প্রথমে জারি করা হয়। পরে তাকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়।
ন্যূরেমবার্গ আইন: ১৯৩৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ন্যূরেমবার্গে নাৎসি পার্টির বার্ষিক সমাবেশে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন ঘোষণা করা হয়, যা ইতিহাসে ‘ন্যূরেমবার্গ আইন’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিদের জাতিগত বিদ্বেষকে আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়।
রাইখ সিটিজেনশিপ ল’ (Reich Citizenship Law): এই আইনের মাধ্যমে ইহুদিদের জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। শুধুমাত্র ‘জার্মান রক্ত’ বা সম্পর্কিত রক্তের অধিকারী ব্যক্তিরাই জার্মান নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। নাগরিকত্ব হারানোয় ইহুদিরা তাদের ভোটাধিকারও হারায়। 
ল’ ফর দ্য প্রোটেকশন অব জার্মান ব্লাড অ্যান্ড জার্মান অনার: এই আইনটি ইহুদি এবং ‘জার্মান বা সম্পর্কিত রক্তের’ নাগরিকদের মধ্যে বিবাহ এবং যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে। এটিকে ‘জাতিগত অপবিত্রতা’ (Rassenschande) হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ‘বিশুদ্ধ আর্য রক্ত’ বজায় রাখা এবং ইহুদিদের সাথে যে কোনও মিশ্রণ রোধ করা।
ইহুদিদের বিরুদ্ধে আইনগত বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। তাদের বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখার কোনও সুযোগ ছিল না, কারণ আইন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতো। আইনগত বৈষম্য এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইহুদিদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পথ খুলে দেয়। ইহুদিদের ওপর আক্রমণ, তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা এবং তাদের প্রতি প্রকাশ্যে ঘৃণা প্রদর্শন একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। 
হিটলারের সরকার আরও অনেক আইন ও ডিক্রি জারি করে ইহুদিদের অধিকার হরণ করতে থাকে। ১৯৩৮ সালে ইহুদি পুরুষদের পাসপোর্টে ‘ইজরায়েল’ এবং ইহুদি মহিলাদের ‘সারাহ’ নাম যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়, যাতে তাদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। ইহুদিদের সম্পত্তি, সম্পদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়। ইহুদি শিশুদের সরকারি স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইহুদিদের বহু দোকানে কেনা নিষিদ্ধ করা হয়।
এইসব আইন ও পদক্ষেপের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল হলোকাস্ট (Holocaust), যার মাধ্যমে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। হিটলারের এই পদক্ষেপগুলি ছিল একটি জাতির অধিকার, সম্মান এবং অস্তিত্বকে ধাপে ধাপে কেড়ে নেওয়ার ভয়াবহ উদাহরণ।
এগুলো ছিল অন্তিম পরিণতি, শুরু হয়েছিল নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমেই। তারপরেই রুটিরুজি কেড়ে নেওয়া, কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি ধাপের দিকে নজর রাখলে দেখা যায়, বর্তমান ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র একই লক্ষ্যের দিকে এগচ্ছে। প্রথমে মুসলমান, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করো, পিটিয়ে মারো যত্রতত্র। আতঙ্ক ধরিয়ে দাও। এরপরেও যারা থেকে যাচ্ছে, তাদের ভিনদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়াও, আইনের তোয়াক্কা না করেই। এদের ভোটের অধিকার প্রথমে কেড়ে নাও, তারপর নাগরিকত্ব।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে কি হিন্দুরা নিরাপদ? 
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, মেলবোর্ন ল’ স্কুলের একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়, আসামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল (FT) ১,৫৯,৩৫৩ জনকে বিদেশি ঘোষণা করেছে। এছাড়াও, FT-এর কাছে ৯৬,১৪৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকে, FT মোট ৩২,৩৮১ জনকে বিদেশি হিসাবে শনাক্ত করেছে। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (NRC) ১৯ লক্ষ মানুষকে ভারতের নাগরিক নয় বলে চিহ্নিত করেছে। NRC থেকে বাদ পড়া তালিকায় প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালি হিন্দু, ১ লক্ষ অসমীয়া হিন্দু (জাতিগত অহমিয়া এবং কোচ-রাজবংশী) এবং প্রায় ১ লক্ষ গোর্খা ধর্মাবলম্বীর নাম আছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। তবে নাম ধরে এই তালিকা প্রকাশ না করায় সরকারি তথ্য পাওয়া যায় না। অর্থাৎ আরএসএস-বিজেপি’র হাতে হিন্দুরাও নিরাপদ নয়। এই হিন্দুরা মূলত দরিদ্র চা বাগান শ্রমিক, খেতমজুর, খেটেখাওয়া মজুর। অর্থাৎ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রাথমিক লক্ষ্য শ্রমজীবী মানুষ। 
নয়া কৌশল
তবে মনে রাখতে হবে হিটলার মুসোলিনি’র সময়ের কৌশলে আজকের ফ্যাসিবাদ চলে না। তারাও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। নতুন কায়দা কৌশল তারা অবলম্বন করছে। এজনই আজকের ফ্যাসিবাদকে নয়া ফ্যাসিবাদ বলা হচ্ছে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের মূল তিনটি স্তম্ভ হলো Legislature বা আইনসভা, Executive বা কার্যনির্বাহী বিভাগ বা প্রশাসন এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। এছাড়াও গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় সংবাদ মাধ্যমকে।  
এখনই ভারতের নয়া ফ্যাসিবাদীরা সংসদ ভেঙে দিচ্ছে না, কিন্তু সংসদকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কোমর ভেঙে দিচ্ছে। প্রশাসনিক বিভাগকে নাগপুরের নিয়ন্ত্রণে আনার সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন নিজেদের পেটোয়া তিন আমলাকে নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করা হয়েছে, পূর্বতন আইন পালটে দিয়ে। দেশের ৭৫ শতাংশের বেশি সংবাদ মাধ্যম ফ্যাসিবাদী আরএসএস’র ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটের মালিকরাই। 
আজ এই আক্রমণ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ওপর। এরপরে তা আসবে সবার ওপর। তাই এখনই প্রতিবাদ শুধু নয়, গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ।

Comments :0

Login to leave a comment