Post Editorial

হিরোশিমা-নাগাসাকি হত্যাকাণ্ডের আশি বছর

উত্তর সম্পাদকীয়​

শ্যামল চক্রবর্তী


১৬ জুলাই ১৯৪৫
সকাল ৫-২৯ মিনিট। ম্যানহাটনের গবেষণাগারে যে প্লুটোনিয়াম বোমা তৈরি হয়েছিল তার ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। লস আলামস গবেষণাগারের অধিকর্তা রবার্ট ওপেনহাইমার এই পরীক্ষার নাম দিয়েছিল ‘ট্রিনিটি পরীক্ষা।’ খুব গোপনে যে এই পরীক্ষা হয়েছে এমনটা নয়। ৪২৫ জন মানুষ পরীক্ষা দেখতে হাজির ছিলেন। ট্রিনিটি পরীক্ষার  অধিকর্তা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কেনেথ বেইনব্রিজ তো থাকবেন-ই। ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। যুদ্ধের সময়ে আমেরিকার যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রধান ভ্যানেভার বুশ হাজির ছিলেন। আর যাঁরা ছিলেন, অতি পরিচিত কয়েকজনের নাম দেওয়া হলো।
জেমস চ্যাডইউক যিনি নিউট্রন আবিষ্কার করে নোবেল পেয়েছেন। এনরিকো ফের্মি যিনি তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ক গবেষণায় নোবেল লাভ করেন। হ্যানস বেথে যিনি নক্ষত্রজগতের নিউক্লিয় বিক্রিয়া আবিষ্কার করে নোবেল অর্জন করেন। রিচার্ড ফাইনম্যান যাঁর কোয়ান্টাম তড়িৎগতিবিদ্যা বিষয়ক কাজ নোবেল স্বীকৃতি পেয়েছে। ইসিডোর আইজাক র্যা বি যিনি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের  চৌম্বক ধর্ম নিজে কাজ করে নোবেল লাভ করেছেন। ‍‌ছিলেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এডওয়ার্ড টেলার যিনি পরে ‘হাইড্রোজেন বোমার জনক’ হিসাবে সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি কুড়িয়েছেন। গণিতজ্ঞ ও বহুবিদ্যার অধিকারী জন ফন নিউম্যান ছিলেন।
৪২৫ জন যাঁরা হাজির ছিলেন তাঁদের অনেকেই মুসোলিনির ভয়ে ইতালি ও হিটলারের ভয়ে ইউরোপ ছেড়েছেন। মুসোলিনি ও হিটলারের হাতে ফ্যাসিবাদের নারকীয় চেহারা জন্ম না নিলে পৃথিবীতে পরমাণু বোমা তৈরির ইতিহাস নিশ্চয়ই এমন চেহারা পেত না। যাই হোক, পরীক্ষার পর দেখা গেল যে শক্তি পাওয়া গিয়েছে তা ২১০০০ টন ট্রাইনাইট্রোটলুইন বিস্ফোরণের সমান। এককথায় ‘ভয়াবহ।
কী‍ হবে এই বোমা দিয়ে
১৯২৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়ে‌ছিলেন জেমস ফ্র্যাঙ্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই জার্মান বিজ্ঞানী  জার্মান সেনাদলের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। হিটলার ক্ষমতায় আসার পর  তিনি অনেকের ম‍‌তোই আমেরিকায় চলে যান। ম্যানহাটন গবেষণায় রসায়ন বিভাগের দায়ভার  ছিল তাঁর হাতে। পরমাণু বোমা তৈরির পর তাকে জাপানের মাটিতে ফেলা হবে কি হবে না ঠিক করতে তিনজন পদার্থবিদ, তিনজন রসায়নবিদ ও একজন জীববিজ্ঞানীকে নিয়ে কমিটি তৈরি হয়। কমিটির রিপোর্ট আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কাছে জমা পড়ে। কমিটি প্রথমেই বলে, এই আবিষ্কার গোপন থাকবে না। আজ হোক, কাল হোক পৃথিবী তা জানতেই পারবে। যাইহোক, রিপোর্ট হাতে পেয়ে সরকার একটা অন্তর্বর্তী কমিটি তৈরি করল। এই কমিটি ঠিক করবে, যুদ্ধের সময় পরমাণু বোমা নিয়ে কী করতে হবে। যুদ্ধ যারা  দেখভাল করে, যুদ্ধক্ষেত্রে ও প্রশাসনে, এদের বেশ ক’জন সদস্য হলেন।  স্বয়ং যুদ্ধ সচিব হেনরি স্টিমসন এই কমিটির  সভাপতি। দু’জন বিজ্ঞানী  ছিলেন। বাকিরা যুদ্ধের নানা শাখার লোকজন। তিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি, আর্থার কম্পটন, আর্নেস্ট আর্নেস্ট লরেন্স; লস আলামস অধিকর্তা বরার্ট ওপেনহাইমার ও যুদ্ধ প্রধান জেনারেল জর্জ মার্শালকে কমিটিতে না নিয়ে অন্তবর্তী কমিটির ‘উপদেষ্টা’ হিসাবে ঘোষণা করা হলো। বোমা কি গোপনে রেখে দেওয়া হবে না পরীক্ষা করা হবে? ফ্র্যাঙ্ক কমিটি ‘গোপন’করে রেখে দেওয়ার পক্ষে ছিল না। অন্তর্বর্তী কমিটির উপদেষ্টা চারজন ফের্মি, কম্পটন, লরেন্স ও ওপেনহাইমার  পরীক্ষা চাইছেন না। গোপনীয়তা চাইছেন।
বোমা তৈরি করে বিজ্ঞানীদের দা‍য়িত্ব শেষ হয়ে গেল। মিলিটারি প্রধান লেসলি গ্রোভসকে সভাপতি করে কমিটি হলো। জাপানে বোমা ফেলা হবে। শুরুতে চারটি জায়গা বেছে নেওয়া হয়। কুকোরা, হিরোশিমা, নিইগাতা ও কিয়োটো। তালিকায় নাগাসাকি ছিল না। এই চারটি শহরে তখনও পর্যন্ত কোনও বোমা বর্ষণ হয়নি। হেনরি ল্টিমস‍‌নের খানিকটা দয়া-মায়া ছিল বলে মনে হয়। তিনি বললেন, জাপানের এক সাংস্কৃতিক শহর কিয়োটো। ওখানে ধ্বংসস্তূপ তৈরি করা সঠিক হবে না। তখন এল নাগাসাকির নাম। প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। ‘বোমা’ তখনও কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে  মজুত রয়েছে। পরীক্ষার কথা ভাবা হয়নি। ইউরেনিয়ানের পরিমাণ ছিল কম। একটিই  বোমা তৈরি করা যাবে। সেই জ্বালানি দিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘লিটল বয়’ নামের বোমা। প্লুটোনিয়াম অনেকটা আছে। বেশ কয়েকটি বোমা তৈরি করা যাবে। একটি বোমা ফাটিয়ে পরীক্ষা করে নি‍‌লে তো  ভালোই হয়। তার-ই ফলশ্রুতি ছিল ১৬ জুলাই ১৯৪৫।
৬ আগস্ট ১৯৪৫
বহু আলোচিত এক কলঙ্ক কাহিনি। সোমবার। সকাল ৮-১৫ মিনিটে শহরের বুকে পূর্ণ ছন্দে শুরু হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। শহরের বুকে নেমে এল ‘লিটল বয়’ নামের পরমাণু বোমা। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। আ‍‌মেরিকার শক্তি মন্ত্রকের তৈরি একটি তথ্যশালা থেকে সংখ্যা উল্লেখ করব। অপরাধী যখন নিজের অপরাধের কথা কবুল করে খানিকটা সে কমিয়েই বলে। হোক তাই, তবু তাদের তথ্যই দিলাম। তারা লিখেছে, বোমা বর্ষণের পর ৭০,০০০ লোক  মারা যায়। বছরের শেষে তা বেড়ে ১,০০,০০০ হয়েছে। পাঁচ বছর পরে মৃ‍‌তের সংখ্যা  ২,০০,০০০ এমনকি তার চেয়ে বেশি হবে। কেন এমন হয়? সকলেই জানেন, পরমাণু বোমার জ্বালানি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। নিউক্লিয় অ্যাসিডে ভাঙন দেখা দেয়। নানা রকম ক্যানসারের শিকারি হয় মানুষ। আর তা চলতে থাকে বহু বছর ধরে।
না কোনও অপরাধ বোধের বালাই নেই। বোমার নাম যারা ‘লিটল বয়’ রাখতে পারে তাদের কাছে অপরাধের মাত্রা‍‌বোধ বলে কিছু থাকে না। বোমা বর্ষণের ২-৪৫ মিনিট পরে সকাল এগারোটায় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্র্যুমান জাপানকে  সতর্ক করছেন এই বলে, ‘যদি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ না করো, তবে এরকম আরও নাশকতার মুখোমুখি হতে হবে।’ তবে একটি কথা যোগ করতে  হবে। জার্মানির শহর পট্‌স্‌ড্যাম যা  যুদ্ধের সময় সোভিয়েত  সেনারা দখল  করে ‍ নিয়েছিল সেখানে  বসেছিল এক সম্মেলন। সম্মেলনে অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান এবং সোভিয়েত প্রতিনিধি হিসাবে মিখাইলোভিচ মলোটভ ও যোসেফ স্তালিন ছিলেন। ১৯৪৫ সালের  ২৬ জুলাই সেই সম্মেলন থেকে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি হয়। ঘোষণাপত্রের বয়ান নিয়ে  ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়‌নি। ঘোষণাপত্রে আমেরিকা, ব্রিটেন ও চীন স্বাক্ষর করে বলে, জাপানকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করতে হবে। সোভিয়েত সেসময় জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়নি। স্বভাবতই সেই ঘোষণাপত্রে সোভিয়েত সই করতে রাজি হয়নি। হিরোশিমা আক্রমণের আগে ট্রুম্যান ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি যে জাপানে ‘পরমাণু বোমা’ ফেলা হবে। এই বোমা এবং নাশকতা তৈরি করে যার প্রভাব কাছাকাছি সময়ে লুপ্ত হয় না। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। আক্রান্ত মানুষেরা আমৃত্যু নানা যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচেন। তাদের আমরা ‘হিবাকুশা’ নামে চিনি। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের এক পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখতে পাই, জাপানে মোট ‘হিবাকুশা’ মানুষের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজারেরও বেশি। এদের ৩,৪৪,৩০৬ জন হিরোশিমায় ও ১, ৯৮,৭৮৫ জন নাগাসাকিতে রয়েছেন।
৯ আগস্ট ১৯৪৫
কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া ভালো যাচ্ছিল না। পরের বোমা নিয়ে মার্কিন মিলিটারি বাহিনী সুযোগের অপেক্ষা করছিল। সেটি ছিল প্লুটোনিয়াম বোমা। ১৬ জুলাই তারিখে এমন বোমার-ই পরীক্ষা হয়েছিল। এর নাম ছিল ‘ফ্যাট ম্যান’, সেকথা আমরা সকলেই জানি। ট্রুম্যান ২৫ জুলাই তারিখেই অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন, সুযোগ সুবিধে বুঝে যে কোনোদিন এই বোমা জাপানে ফেলতে হবে। খারাপ আবহাওয়ায় বার কয়েক চেষ্টা করেও ফল মিলছিল না। অবশেষে ৯ আগস্ট সকাল ১০-০২ মিনিটে ১,৬৫০ ফুট উঁচুতে ওই বোমার বিস্ফোরণ হয়। হিরোশিমার বোমা ছিল ১৫ কিলোটন। এই বোমা আরও শক্তিশালী। ২১ কিলোটন। হিরোশিমার চেয়ে শতকরা চল্লিশ ভাগ বেশি শক্তিশালী। আগে আঁচ পেয়ে শহরের কিছু মানুষ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে স্কুলের ছেলেমেয়েদের বাবা মায়েরা শহর থেকে তাদের সরিয়ে নিয়েছিলেন। যখন বোমা পড়েছে শহরের লোকসংখ্যা ছিল দু’লক্ষের কাছাকাছি। ৪৩ বর্গমাইল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক কিলোমিটার এলাকার সকল মানুষ মারা গিয়েছেন। নাগাসাকি শহরে বাড়ির সংখ্যা ছিল ৫২০০০। ১৪০০০ বাড়ি ধুলোয় মিশে গিয়েছে। ৫,৪০০ বাড়ি সারাইয়ের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার শক্তি মন্ত্রকের পরিসংখ্যান, বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৪০,০০০ মানুষ মারা যান। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে সংখ্যাটা গিয়ে ৭০,০০০-এ দাঁড়ায়। বোমা হিরোশিমার চেয়ে শক্তিশালী কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা হিরোশিমার চেয়ে কম। তার কারণ, নাগাসাকি শহরে খানিক পরপর টিলা বা ছোট পাহাড় রয়েছে। এরা দেওয়ালের মতো বাধা হিসাবে কাজ করেছে।
১৯৪৫ সালের পর পরমাণু গবেষণা
হিরোশিমা-নাগাসাকির হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর বহু দেশকেই সচকিত করেছে। সোভিয়েত সে সময় আমেরিকার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। ‘ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস’ ২০২৫ সালের একটা হিসাব দিয়েছে। পরমাণু বোমা ও পরমাণু অস্ত্র যা ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও ডুবোজাহাজে ব্যবহৃত হয়, সব মিলিয়ে পৃথিবীতে তার সংখ্যা ১২,২৪১। আমেরিকা ও রাশিয়া মিলিয়ে দু’দেশের যে বোমা ও অস্ত্র তা মোট সংখ্যার শতকরা ৮৭ ভাগ। ১৯৪৫ সালে আমেরিকা যে পথ তৈরি করেছিল, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পৃথিবীর মোট নয়টি দেশ ‘পরমাণু শক্তিধর’ হয়েছে। এই নয়টি দেশের অস্ত্রসংখ্যা ও প্রথম পরীক্ষার দিন আমরা নিচে দিলাম।
দেশ    পরমাণু অস্ত্র সংখ্যা     প্রথম পরীক্ষা
আমেরিকা   ৩৭০০            ১৬ জুলাই ১৯৪৫
রাশিয়া       ৪৩০৯             ২৯ আগস্ট ১৯৪৯
ব্রিটেন        ২২৫              ০৩ অক্টোবর ১৯৫২
ফ্রান্স         ২৯০                 ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০
চীন          ৬০০                 ১৬ অক্টোবর ১৯৬৪
ভারত        ১৮০                ১৮ মে ১৯৭৪
পাকিস্তান     ১৭০                ২৮ মে ১৯৯৮
ইজরা‌য়েল     ৯০                  ১৯৬০-৭৯
উত্তর কোরিয়া  ৫০             ৯ অক্টোবর ২০০৬
একমাত্র দেশ ইজরায়েল যে প্রকাশ্যে পরমাণু অস্ত্র থাকার কথা মানতে চাইছে না। ইজরায়েলের যে ঘৃণ্য ছবি এখন আমরা দেখি প্রতিদিন, অস্বীকার করাটা তাদের পক্ষে ‘মানানসই’ বলেই মনে হয়।
শান্তির কাজে পরমাণু গবেষণা হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। পরমাণু শক্তিকেন্দ্র যথাযথ সতর্কতা মেনে চললে তা মানুষের জীবন ধারণের সহায়ক-ই হবে। প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে দিন দিন। দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কমছে। বিজ্ঞানীরা যদি ‘ফিউশন’ প্রক্রিয়ায় শক্তি তৈরি করতে পারেন আগামীদিনে, পৃথিবীর অগ্রগতি বলেই আমরা তাকে মানব। যাই করি না কেন, খেয়াল রাখতে হবে মানুষের নিরাপত্তার কথা। নিজের দেশের মানুষের নিরাপত্তা নয় শুধু পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের নিরাপত্তা চাই।
শান্তির কথা ভেবে যেন মানুষ পরমাণু শক্তির গবেষণা করে তা নিশ্চিত করতে পৃথিবীতে দুটো সুপরিচিত চুক্তি তৈরি হয়েছে। একটি চুক্তির নাম ‘নিউক্লিয় অস্ত্র অসম্প্রসারণ চুক্তি’ (NPT)। রাষ্ট্রসঙ্ঘ এর উদ্যোক্তা। ১৯৭০ সালে প্রথম এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমান ১৯১টি দেশ এ‍‌ই চুক্তি মেনে চলবে বলে স্বাক্ষর করেছে। উত্তর কোরিয়া ১৯৮৫ সালে যোগ দিয়ে ২০০৩ সালে সদস্যপদ তুলে নেয়। ভারত, পাকিস্তান ও ইজরায়েল রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য দেশ। শুরু থেকেই এই চুক্তির বাইরে থেকেছে। পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র ঘোষণার মধ্যে যে বিভেদ, ভারত এতে আপত্তি জানায় ও সদস্যপদ গ্রহণে সম্মতি দেয়নি। নিউক্লিয় প্রযুক্তির আদান-প্রদানের বেলায় অসম আচরণ ভারতকে এই চুক্তির বাইরে থাকতে বাধ্য করেছে। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় যে চুক্তিটি তৈরি হয়েছে তার নাম ‘সার্বিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ (CTBT)। ওই বছর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় এই চুক্তি গৃহীত হলেও নানা অভিমত রয়েছে। তাই আজ পর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকর হয়নি।
আগামীদিনের বিপদ কোথায়
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জাপানকে আক্রমণের আগাম হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরমাণু বোমা বর্ষণের কথা আগাম ঘোষণা করেননি। এর ভয়াবহ পরিণতি সে দেশের মানুষ আজও বহন করে চলেছেন। বর্তমান বছরে ‘ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস’ একটা বড় বিপদের সম্ভাবনার কথা আমাদের জানিয়েছে। তাঁরা প্রতিবছর কাদের কি পরিমাণ অস্ত্র ছিল তার সমীক্ষা করেছেন। সিদ্ধান্তে এসেছেন, বিগত তিন দশক জুড়ে পৃথিবীর সকল পরমাণু অস্ত্রধর দেশ-ই খানিকটা করে অস্ত্রের সংখ্যা কমিয়ে আনছিল। এবছরে এসে দেখা গেল, আমেরিকা হ্রাসের হার একই রেখেছে। ফ্রান্স ও ইজরায়েল স্থিতিশীল রয়েছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া তা বাড়িয়ে চলেছে। ইরান নিয়ে তো আমেরিকার অভিযোগের অন্ত ছিল না। হঠাৎ আক্রমণ করে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির আধিকারিক বললেন, ওখানকার আশপাশে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সন্ধান মেলেনি। কী বলল তবে আমেরিকা? বিভ্রান্তির চূড়ান্ত। তারপর দিন কয় পরে ইরানকে আমেরিকা জানালো, ‘চালিয়ে যাও তোমাদের পরমাণু গবেষণা। আমরা টাকার ডালি নিয়ে যাচ্ছি।’ আগামীদিনে একটা হিরোশিমা বা একটা নাগাসাকি হয়তো ঘটবে না। কয়েক হাজার কিলোটনের বোমা পড়বে না। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘর্ষ কিংবা গাজার উপর মুসোলিনি-হিটলারের নতুন দোসরের যে হিংস্র হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, সেখানে কোথাও যে নিউক্লিয় তেজস্ক্রিয়তার উপকরণ লুকিয়ে নেই, এই নিশ্চ‌য়তা আমাদের কে দেবে? পৃথিবী তার গণতান্ত্রিক বাতাবরণ হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। ১৪০টির উপরে দেশ প্যালেস্তাইনকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। ইউরোপের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্যালেস্তাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছে বলতেই ট্রাম্পের মুহুর্মুহু আক্রমণ। দক্ষিণপন্থা আগেও ছিল। আজ তার হিংস্রতা ও নৈরাজ্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির আশি বছরে এসে তাই আমাদের মনে হয়, পরমাণু যুদ্ধের বিপদ থেকে আমরা মুক্তি লাভ করিনি। পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে যেমন আমরা সংঘবদ্ধ হতে চাইছি, পরমাণু বোমা ও অস্ত্রের বিরুদ্ধে শক্তির সংঘবদ্ধতা আজও আমাদের এই সময়ে দাবি হিসাবেই বেঁচে আছে।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যারা বোমার আঘাতে আহত হয়ে আজও বেঁচে আছেন, তাঁরা সকলে মিলে একটা প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে তুলেছিলেন। এই পৃথিবীতে যেন আর নতুন হিরোশিমা নতুন নাগাসাকির জন্ম না হয়। ১৯৫৬ সালে এই মঞ্চের প্রতিষ্ঠা। জাপানি ভাষায় তাঁদের এই মঞ্চের নাম ‘নিহন হিদানকিউ’। নিজের দেশ ও পৃথিবীর সকল দেশে পারমাণবিক অস্ত্র সংবরণের আরজি পেশ করেন তাঁরা। এই মঞ্চ ২০২৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। নোবেল কমিটি জানি‍‌য়েছে, ‘একটি পারমাণবিক অস্ত্রযুক্ত পৃথিবী নির্মাণের চেষ্টা ও সাক্ষী-প্রমাণের মাধ্যমে কেন আর কখনও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়,’ সেকথা বলে চলেছে এই মঞ্চ। তাই তাদের স্বীকৃতি। এবছরের হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবসে তাঁদের এই আবেদন যেন আমরা মনে রাখি।
 

Comments :0

Login to leave a comment