মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা সহ একাধিক বিষয়ের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সংসদে কালো পোশাক পরে আসবেন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সাংসদরা। এরই সঙ্গে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ খুলতে বাধ্য করানোর লক্ষ্যে বুধবার সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবও দাখিল করেছে কংগ্রেস। তবে অনাস্থা প্রস্তাব কংগ্রেস দাখিল করলেও এর পিছনে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের পূর্ণ সমর্থন আছে বলে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আবার ২৬ দলের বিরোধী মঞ্চে শামিল না হলেও পৃথকভাবে এদিন অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেছে কে চন্দ্রশেখর রাও নেতৃত্বাধীন ভারত রাষ্ট্র সমিতি।
প্রতিবাদ হিসাবে বিরোধীরা মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে কালো পোশাক পরে অতীতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তবে এভাবে ২৬ দল একযোগে কালো পোশাক পরে সংসদে বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মণিপুর নিয়ে নীরবতার পাশাপাশি অন্যান্য জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ জানাতেই কালো পোশাকের সিদ্ধান্ত বলে ‘ইন্ডিয়া’ সূত্রে জানা গিয়েছে। এদিনই রাজ্যসভায় অন্য একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় মণিপুর প্রসঙ্গ টেনে এনে মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন সিপিআই(এম) সদস্য জন ব্রিটাস।
এদিন কংগ্রেসের হয়ে সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ অধ্যক্ষের দপ্তরে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেন কংগ্রেসের উপ দলনেতা গৌরব গগৈ। পরে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা সেই অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণের কথা জানিয়ে দেন। বিড়লা বলেন, সমস্ত দলের লোকসভার নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে দিন ঠিক করবেন। তবে অনাস্থা প্রস্তাব দাখিলের ১০ দিনের মধ্যে আলোচনা শুরু করাই নিয়ম। এমনিতে সংসদের বাদল অধিবেশন শেষ হচ্ছে ১১ আগস্ট।
লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে এনডিএ বিরোধীদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে থাকলেও মূল লক্ষ্য, প্রধানমন্ত্রীকে মণিপুর নিয়ে মুখ খোলানো। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারকে মণিপুর নিয়ে কোণঠাসা করার পাশাপাশি ওই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে বাধ্য করানোও যাবে। সংখ্যায় হারলেও নৈতিকভাবে জয়ী হবেন বলেই মনে করছেন বিরোধীরা। উল্লেখ্য, এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে মোদী সরকার। ২০১৮ সালে ২০ জুলাই আনা অনাস্থা প্রস্তাব পরাস্ত হয়। কংগ্রেস বৃহস্পতিবার থেকেই অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হোক বলে দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী জানান যে, সরকার এনিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, এনডিএ সাংসদদের পাশাপাশি দেশবাসীর আস্থাও অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
অনাস্থা প্রস্তাব যে সামগ্রিকভাবে বিরোধীদেরই সিদ্ধান্ত সেকথা জানাতে গিয়ে এদিন কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি বলেন, ‘‘এটা শুধু তাঁদের দলের নয়, যৌথ সিদ্ধান্ত। ‘ইন্ডিয়া’র সমস্ত দলই এই প্রস্তাব আনায় সহমত পোষণ করেছে। গত ৮৪ দিন ধরে আইন শৃঙ্খলা সহ যাবতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে মণিপুরে। ওখানে সরকার বলে কিছু আছে বলেই মনে হচ্ছে না। এসবই আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে বাধ্য করেছে।’’ এরই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিরোধীরা মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতির দাবি জানিয়ে এলেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমরা চাইছি, অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় সাড়া দিক প্রধানমন্ত্রী।’’ কংগ্রেস সাংসদ মানিকাম ঠাকুরও এদিন বলেন, ‘‘ইন্ডিয়া মঞ্চ যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই প্রস্তাব আনা হয়েছে। ইন্ডিয়া ঐক্যবদ্ধ। সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যে আঘাত করার জন্য বিরোধীরা এই শেষ হাতিয়ারকে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে।’’
এদিন লোকসভার অধিবেশনের শুরুতেই অধ্যক্ষ বিড়লা বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের কথা জানান। তিনি ওই প্রস্তাবের পক্ষে কারা আছেন জানতে চাইলে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের পক্ষে কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা সোনিয়া গান্ধী, এনসি’র ফারুক আবদুল্লা, ডিএমকে’র টি আর বালু, এনসিপি’র সুপ্রিয়া সুলে দাঁড়িয়ে উঠে সমর্থন জানান। এরই সঙ্গে সিপিআই(এম), সিপিআই, টিএমসি, শিবসেনা (উদ্ধব), জনতা দল (ইউ), আরজেডি, এবং আপ’র সদস্যরাও সমর্থন করেন। বস্তুত, এই অনাস্থা প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল মঙ্গলবার সকালেই বিরোধীদের বৈঠকের সময়। ওই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন ৫০-রও বেশি সাংসদ। এদিন আবার ভারত রাষ্ট্র সমিতি’র সাংসদ নামা নাগেশ্বর রাও পৃথকভাবে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেছেন।
অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে সিপিআই’র বিনয় বিশ্বম বলেছেন, ‘‘একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবেই। প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করবে মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে। সংখ্যা জানার দরকার নেই। সংখ্যা ওরাও জানে, আমরাও জানি।’’ শিবসেনা (উদ্ধব)-র প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী অভিযোগ করেন, ‘‘একজন এতবার বলা সত্ত্বেও দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। এজন্যই অনাস্থা প্রস্তাব আনা।’’ আরজেডি’র মনোজ ঝা মনে করেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ভাঙতে পারলেই সাফল্য বিরোধীদের।’
আবার ২০১৮ সালের অনাস্থা প্রস্তাব আনার সময় মোদী যা বলেছিলেন বিরোধীদের সম্পর্কে, তা উল্লেখ করে কটাক্ষ শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। ওই সময় মোদী সংসদে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেছিলেন যে, ‘আপনারা আবার ২০২৩ সালে অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন।’ মোদী কতটা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সেকথা উল্লেখ করে বিজেপি’র নেতা থেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সমাজমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর জয়গানেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
বিরোধীরা লোকসভায় যেমন অনাস্থা প্রস্তাব এনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ খোলাতে চাইছেন তেমনই রাজ্যসভায় মণিপুর নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যাওয়া হবে বলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেইমতো এদিনও মণিপুর নিয়ে আলোচনার দাবি তুলে সভা ছেড়ে চলে যান বিরোধী সদস্যরা। বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে মণিপুর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সরব হলে তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তিনি এও বলেন যে, গোটা দেশই মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার জন্য উদগ্রীব।
এদিকে, মণিপুর ইন্টারনেট চালু করা নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গে জন ব্রিটাস ওখানে মহিলাদের ওপর নির্যাতন এবং এব্যাপারে সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এদিন রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি ওখানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকার জন্য নানা ধরনের ভুয়ো এবং বিভ্রান্তিমূলক খবর ছড়ানোর ফলেই হিংসা বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি অবিলম্বে ওই রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করে ভুয়ো খবর যাচাই করে নেওয়ার দাবিও জানান।
Comments :0