দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি যশবন্ত শর্মাকে নিয়ে এবার সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সংঘাতে গেলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের আইনজীবীরা। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিচারপতি শর্মাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসবে তাঁর প্রথম কর্মস্থল এলাহাবাদ হাইকোর্টে বদলির সুপারিশ করেছে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কলেজিয়াম। বস্তুত, সেই সুপারিশে আইন মন্ত্রকের সিলমোহর এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তারপরেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন কলেজিয়ামের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকাল কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে। অন্যদিকে, গত ১৪ মার্চ বিচারপতি শর্মার নয়াদিল্লির সরকারি বাসভবনে অগ্নিকাণ্ডে বিরাট পরিমাণ নগদ টাকা পাওয়া গেলেও ঘটনার দশ দিন পরেও দিল্লি পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট বা দিল্লি হাইকোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হলো না, কত টাকা পাওয়া গিয়েছে বিচারপতির বাসভবন থেকে। এমনকী প্রাক্তন বিচারপতি থেকে প্রবীণ আইনজীবীদের তরফে দাবি জানানো হলেও সোমবার পর্যন্ত এই ঘটনায় কোনও এফআইআর দায়ের করা হয়নি। এর মধ্যেই এদিন সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি’র ন্যাশনাল জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন (এনজেএসি) গঠনের ভাবনাকে ফের সামনে নিয়ে এসেছেন স্বয়ং উপরাষ্ট্রপতি ও রাজ্যসভার চেয়ারপার্সন জগদীপ ধনখড়।
হোলির দিনে গত ১৪ মার্চ বেশি রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আগুন লেগেছিল নয়াদিল্লিতে বিচারপতি শর্মার ৩০, তুঘলক ক্রিসেন্টের সরকারি বাসভবনের স্টোররুমে। তা নেভাতে গিয়ে দমকলকর্মী ও পুলিশকর্মীরা অজস্র নোটের বান্ডিল পান অগ্নিদগ্ধ ঘরটিতে। পোড়া ও আধপোড়া নোটের ছবি ও ভিডিও তোলে পুলিশ। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ মার্চ বিকেল ৪টে ৫০ মিনিট নাগাদ দিল্লির পুলিশ কমিশনার টাকা উদ্ধারের বিষয়টি ফোনে জানান দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায়কে। তিনি আবার সঙ্গে সঙ্গে তা জানান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নাকে। কিন্তু সরকারিভাবে কোনও তরফেই এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা জানানো হয়নি। ঘটনার ছ’দিন পরে কোনওভাবে ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যায়। তখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তড়িঘড়ি শীর্ষ আদালতের কলেজিয়ামের বৈঠক ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। চাপে পড়ে গত শনিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে ঘটনাটি সম্পর্কে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট। তাতেই জানা গিয়েছে, দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে ঘটনাটি জানাতে আগুন লাগার পরে ১৭ ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়েছেন দিল্লির পুলিশ কমিশনার। কেন? নেই উত্তর। যেমন উত্তর নেই দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে অগ্নিকাণ্ড ও টাকা উদ্ধারের কথা ঘটনার পরের দিনই জানতে পারলেও কেন তখনই কলেজিয়ামের বৈঠক ডেকে এমন একটি গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেননি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। এমনকী গত ২১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট এক বিবৃতিতে দাবি করেছিল, বিচারপতি শর্মার বাড়ির ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অথচ শনিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারপতি উপাধ্যায়ের যে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি যেমন ঘটনার পরের দিন (১৫ মার্চ) দিল্লির পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে অগ্নিদগ্ধ টাকার নোটের ছবি ও ভিডিও পেয়েছেন, তেমন তার পরের দিন (১৬ মার্চ) তিনি নিজে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ওই সব ছবি ও ভিডিও দিয়েছেন। সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে, তারপরেও সুপ্রিম কোর্টের ২১ মার্চের প্রেস বিবৃতিতে কী করে বলা হলো, বিচারপতি শর্মার বাড়ির ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে!
স্বাভাবিকভাবেই বিচারবিভাগের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে পরপর প্রশ্ন উঠতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে গত শনিবার বিচারপতি শর্মার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে তিন বিচারপতির কমিটি গঠন করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি। তবে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না দিল্লি পুলিশ, দিল্লি হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট কোনও পক্ষেরই। গত শুক্রবার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে সংসদেও। সেদিন রাজ্যসভার চেয়ারপার্সন ও উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ও বলেছিলেন, তাঁকে বেশি ভাবাচ্ছে ঘটনাটি এত পরে প্রকাশ্যে আসার বিষয়টি। এবার সোমবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে তিনি রাজ্যসভায় নিজের কক্ষে বৈঠকে ডাকেন সংসদের উচ্চকক্ষের নেতা বিজেপি’র জে পি নাড্ডা এবং বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খাড়গেকে। সেখানেই তিনি বিচারপতি নিয়োগের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে একটি ব্যবস্থার কথা, যা এই কক্ষ প্রায় সর্বসম্মতিতে অনুমোদন করেছিল।’’ স্পষ্টতই তিনি এনজেএসি-কে বোঝাতে চেয়েছেন। সূত্রের খবর, এমন কোনও ব্যবস্থার কথা নতুন করে ভাবা দরকার বলেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন বৈঠকে। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম ব্যবস্থা তুলে দিয়ে ওই কমিশন গঠন করতে চেয়ে ২০১৪ সালে আইন তৈরি করেছিল মোদী সরকার। তবে ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই আইন খারিজ করে দিয়েছিল অসাংবিধানিক বলে। বিচারপতি শর্মার বাড়ি থেকে বিপুল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসায় ঝোপ বুঝে কোপ মারার ভঙ্গিতে এদিন ধনখড় ওই আইনকে ফিরিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি এদিন এই বিষয়টি উত্থাপন করেছেন লোকসভার বিরোধী সাংসদরাও। আপ’র সঞ্জয় সিং, কংগ্রেসের কীর্তি চিদাম্বরম, সিপিআই’র পি সন্দোষ কুমার, এএসপি’র চন্দ্রশেখর প্রমুখ সংসদের বাইরে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিচারপতি শর্মার এখনই ইস্তফা দেওয়া উচিত। না দিলে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে সংসদে ভর্ৎসনা প্রস্তাব আনা দরকার। বিরোধী সাংসদরা সংসদে এই বিষয়ে আইন মন্ত্রীর বিবৃতিরও দাবি জানিয়েছেন। বিরোধীরা এদিন লোকসভার অধিবেশনেও বিষয়টি তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আটকাতে বিজেপি সাংসদরা অন্য নানা বিষয় নিয়ে এমন শোরগোল করেন যে, অধিবেশন মুলতবি করে দিতে হয়। এক বিচারপতির বাড়ি থেকে নোটের বান্ডিল উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে আলোচনা ঠেকাতে সরকারপক্ষের সদস্যরাই অধিবেশন ভেস্তে দিচ্ছেন, এও নজিরবিহীন!
Comments :0