saline scandal

স্যালাইন উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দিলেও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি রাজ্য, দাবি জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকেরই

রাজ্য




উৎপাদন বন্ধ, কিন্তু ব্যবহার বন্ধ নয়! বিষাক্ত স্যালাইনকাণ্ডে রাজ্যের তৃণমূল সরকার, স্বাস্থ্য প্রশাসনের অপদার্থতা আর চরম গাফিলতির ছবি-ই সামনে আসছে।
কর্নাটককাণ্ডের পরেও রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইন নিয়ে তৃণমূল সরকারের চরম উদাসীনতা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস সংস্থার প্রতি সরকার তথা শাসক দলের কোনও একটি মহলের কি বাড়তি দুর্বলতা ছিল? বিষাক্ত স্যালাইন নিয়ে সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন গত ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গে এসে সতর্কবার্তা দিলেও সরকার কেন প্রয়োজনীয় তৎপরতা দেখায়নি?
গত ৭ জানুয়ারি বিষাক্ত স্যালাইন প্রস্তুতকারী অভিযুক্ত সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসকে এরাজ্যে কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশিকা জারি হয়েছিল। উৎপাদনও বন্ধ রাখতে বলা হয়। সোমবার রাজ্যের মুখ্যসচিবও জানান, গত ৭ তারিখে ওই সংস্থায় উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ‘নির্দেশিকা’কেই সরকার গোটা স্যালাইনকাণ্ডে নিজেদের দায় এড়াতে রক্ষাকবচ হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে।
আর এদিন খোদ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসন স্পষ্ট দাবি করেছে, ৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকায় রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইন ব্যবহার না করার কথা বলাহয়নি। আর এই দাবির পরেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে স্বাস্থ্য ভবনের অন্দরেও। 
পূর্ব মেদিনীপুর মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ বিভাস রায় সোমবার তাৎপর্যপূর্ণভাবেই দাবি করেন, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে রিকুইজিশন এসেছিল। পূর্ব মেদিনীপুরের যে স্টক ছিল, তা দেওয়া হয়েছিল। এটা স্বাস্থ্য প্রশাসনের খুব সাধারণ বিষয়। তবে বিতর্কিত ‘আর এল’-কে স্বাস্থ্য ভবনের পক্ষ থেকে সরিয়ে রাখতে কোথাও বলা হয়নি। ৭ তারিখ একটাই নির্দেশ এসেছিল, পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের সমস্ত ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধ রয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে কোনও ওষুধের প্রয়োজন হলে লোকাল পারচেজ করা যেতে পারে।
অর্থাৎ খোদ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দাবি, সরকারি নির্দেশে ওই অভিযুক্ত কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের কথা জানানো হলেও স্টকে থাকা সেই বিষাক্ত রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে না— এমন কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। ডাঃ বিভাস রায়ের আরও দাবি, শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর কেন, একাধিক জেলার একাধিক হাসপাতালে এই স্যালাইন গিয়েছে। তবে অন্য কোথাও থেকে কোনও অভিযোগ আসেনি। মেজর কোনও সমস্যা হয়নি।
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত প্রসূতিকে যে বিষাক্ত রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে আসা হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের রিজার্ভ স্টোর থেকে। কালো তালিকাভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির তৈরি বেশ কয়েকটি ব্যাচ নম্বরের স্যালাইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। গত মে মাসে রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সেই নমুনা পাঠানো হয় ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে। বেশ কয়েকটি ব্যাচের রিপোর্ট আসলেও ২৩৯৬ ব্যাচ নম্বরের রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইনের রিপোর্ট আসেনি। অথচ ২৩৯৬ ব্যাচ নম্বরের স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতিকে এবং তা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের রিজার্ভ স্টোর থেকে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ বিভাস রায় সেই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, ‘‘একটি জেলার স্টক থেকে অন্য জেলায় পাঠানো খুবই সাধারণ বিষয়। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে রিকুইজিশন এসেছিল, পূর্ব মেদিনীপুরের যে স্টক ছিল, তা থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইনকে স্বাস্থ্য ভবনের তরফে সরিয়ে রাখতে কোথাও বলা হয়নি। ৭ জানুয়ারির সরকারি নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের সমস্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলা হয়। সেই সময়ে কোনও জরুরি জীবনদায়ী ওষুধের প্রয়োজন হলে লোকাল পারচেজ করা যেতে পারে। পূর্ব মেদিনীপুরের সমস্ত ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে জেলা হাসপাতাল, সুপার স্পেশালিটি, মেডিক্যাল কলেজ সর্বত্র ওই রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মেদিনীপুরের মতো ম্যাসিভ ঘটনার খবর তো অন্য কোথাও থেকে সামনে আসেনি।’’ 
জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর এর রিজার্ভ স্টোরের ফার্মাসিস্ট প্রলয় মণ্ডল জানিয়েছেন, ‘‘এই মুহূর্তে পূর্ব মেদিনীপুরে পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের ৫৪ হাজার বোতল রিঙ্গার’স ল্যাকটেট স্যালাইন মজুত রয়েছে। পুরো স্টক ইতোমধ্যেই সিল করা হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে লোকাল পারচেজ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি সমস্ত রকম ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জেনেছি।’’
এখন গোটা ঘটনার দায় এড়াতে মুখ্যসচিব ৭ তারিখের নির্দেশিকার তথ্য সামনে এনে যে দাবি করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে খোদ স্বাস্থ্য ভবনের একাংশই। নির্দেশিকায় কেন সরকার স্পষ্টভাবে জানায়নি যে, ওই বিষাক্ত ‘আরএল’ স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে না, উঠেছে প্রশ্ন।
এর আগে গত বছর কর্নাটকে এই বিষাক্ত স্যালাইনে চার জন প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও) আর রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর যৌথভাবে তদন্তে নেমে চোপড়ায় এই সংস্থার কারখানায় যায়। সরেজমিনে সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে যৌথ তদন্তকারী দল। রাজ্যের সরকারের তরফে স্পষ্ট জানানো হয় সেই সময় যে, বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই সংস্থার কারখানায় আইভি ফ্লুইড উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্ত যা উৎপাদন হয়েছে, তার  কী ব্যবস্থা হবে, তা নিয়ে কোনও অবস্থান জানানো হয়নি। রাজ্য সরকার তখন সিডিএসসিও’র কাছে জানায়, ড্রাগস কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট পুরোদস্তুর নজর রাখছে, যাতে এই ‘রিঙ্গার’স ল্যাকটেট’ (স্যালাইন) অন্যত্র কোথাও সরবরাহ না হতে পারে!
অথচ জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তা রমরমিয়ে চলল শুধু নয়, এমনকী ওই বিষাক্ত স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে না বলে নির্দেশও দেয়নি রাজ্যের তৃণমূল সরকার। কেন? সরকারি ভূমিকাতেই বাড়ছে সন্দেহ।

Comments :0

Login to leave a comment