সড়ক পথে আইজল থেকে দূরত্ব প্রায় ১২০০ কিলোমিটার। ঘটনার প্রায় ৬০ ঘন্টা পরে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের দেহ নিয়ে আসা হয়েছে তাঁদের গ্রামে। কিন্তু গ্রামে নিথর দেহ ফিরলেও পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মত দেখতে পারেননি তাঁদের কারো স্বামী বা সন্তানকে!
এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে কফিনবন্দি দেহ নিয়ে আসা হয়েছে মিজোরামের রাজধানী থেকে মালদহে। অথচ দেহগুলিকে বরফে রাখা বা কোনও রাসয়নিক দিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে কোনরকম সংরক্ষণের ব্যবস্থাই করা হয়নি। স্রেফ আইজলে ময়নাতদন্তের পরে দেহগুলি কফিনে পুরে তুলে দেওয়া হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সে। ফলে যখন সেই দেহ পৌঁছালো মালদহ, যখন শুক্রবার রাতে এবং শনিবার বিকালে দু দফায় দেহগুলি পৌঁছালো রতুয়া, ইংরেজবাজারের গ্রামে তখন পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত তা দেখতে পারেননি। বিকট দুর্গন্ধ, কফিন খোলা যায়নি। সাধারণ গ্রামবাসীরা যারা জড়ো হয়েছিলেন সেই দুর্গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কোনরকম সংরক্ষণ ছাড়াই নির্বিকার ভাবে রেল দপ্তর ২৩জন পরিযায়ী শ্রমিকদের দেহ স্রেফ কাঠের বাক্সে পুরে পাঠিয়ে দিয়েছে সুদূর আইজল থেকে। বরফেও রাখা হয়নি। ফলে দেহগুলি সম্পূর্ণভাবে পচে গেছে।
সব হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়া চোদুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা নিহত পরিযায়ী শ্রমিক সাইদুর রহমানের স্ত্রী হামিদা বিবি ক্ষোভের সঙ্গেই বলছিলেন, ‘শেষবারের জন্য ওঁকে দেখতে পর্যন্ত পারলাম না। কফিন খোলা গেল না। বললো পুরো পচে গেচে। গন্ধ বেরোচ্ছে। গরিব বলে কি আমরা মানুষ নই। একটু যত্ন করেও দেহগুলি পাঠাতে পারলো না কেউ’! সাইদুর রহমানের ভাগ্নে, জামাই, বোনের স্বামী, ভাইপো সহ পরিবারের মোট সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকায় থাকা পরানপুরের মাসরেকুল থেকে গাজোলের সেবুল হকও চৌদুরিয়া গ্রামের মৃত সাইদুর রহমানের আত্মীয়। বাড়িতে এখন তাঁর স্ত্রী আর দশ ও ছয় বছরের দুই মেয়ে। সব হারিয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে গোটা পরিবার।
সিআইটিইউ মালদহ জেলা সম্পাদক দেবজ্যোতি সিনহার কথায়, এটা অমানবিক একটা ঘটনা। পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের কী মনোভাব তা তো লকডাউন পর্বেই দেখেছিল গোটা দেশ। আমাদের জেলায় লকডাউনের সময় বাড়ি ফিরতে ২২জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। আবার এখন পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যা আচরণ করল রেল তা সত্যি অমানবিক। মৃতদেহগুলি তো একটূ সম্মানেরও আশা করে। গ্রামে যখন একে একে কফিনবন্দি দেহগুলি ঢুকছিল সেই সময়তেই প্রশাসনের পাশাপাশি তদারকিতে ছিলেন সিপিআই(এম) কর্মীরাও। গাজোলের বৈইচগাছা পঞ্চায়েতে বিরোধী দলনেতা, সিপিআই(এম)র পঞ্চায়েত সদস্য জিশান আহমেদ বলছিলেন, ‘দুদফায় এদিন পর্যন্ত ২৩টি দেহ এসেছে। গতকাল ১৮টি আর আজ ৫টি। মোট ১৮টি অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয়েছে। রেলের তরফে আইজল থেকে সড়কপথে যে পাঠানো হয়েছে দেহগুলি তাতে বরফ বা ওষুধ কিছুই ছিলোনা, পচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছে গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। গরিব মানুষের জীবনেরই দাম নেই মরদেহের আর কী দাম! দেহগুলি মালদহ মেডিক্যাল কলেজে আসার পরে শনাক্ত করে কাগজপত্রে সই করে রেলের তরফে তা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।পুলিশও ওই অবস্থাতেই দেহগুলি গ্রামে নিয়ে আসে।’
শনিবারও পাঁচটি দেহ গ্রামে ফেরে। শনিবারও দেখা যায় কফিনের বাক্স থেকে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পচে যাওয়ার জন্য এদিনও মৃতদের পরিবারের লোকজন কেউ তাঁদের নিকটজনের মুখ শেষবারের মত দেখতে পারেননি।
চৌদুয়ার গ্রামে শনিবারই ফেরে ১৯ বছরের শাহিন আখতারের পচে যাওয়া সেই দেহ। এবছরই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল শাহিন আখতার। অভাবের সংসার। তাই ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নকে চেপে রেখেই বাবা তফিদ আলির হাত ধরে পাড়ি দিয়েছিলেন মিজোরামে, আইজল থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে সাইরঙে রেলসেতু নির্মাণের কাজে। দেড় মাস আগে বাবার হাত ধরেই গ্রাম ছেড়েছিলেন। মাসিক ২১ হাজার টাকার চুক্তিতে।
শনিবার গ্রামে ফিরলো শাহিন, তবে নিথর দেহ হয়েই। বাবা তফিদ আলি নিজের ছেলের মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে বাড়ি এলেন।
তফিদ আলিও সেদিন দুর্ঘটনার সময় ছিলেন রেলসেতুর কাজেই। তবে যেদিকে ভেঙে পড়ে সেদিকে কাজ করছিল তাঁর পুত্র। তফিদ আলি বেঁচে যান অন্যদিকে থাকার কারণে। ‘ এর থেকে মৃত্যু ভালো ছিল। নিজের ছেলের মরদেহ নিয়ে ফিরলাম গ্রামে।’ হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন চৌদুরিয়া গ্রামের এই নির্মাণ শ্রমিক। বাবা ছেলে দুজনকেই কেন যেতে হলো, আবারও কি যাবেন বাইরে কাজে? পুত্রহারা পিতার জবাব- ‘ কী করব, খেয়ে তো বাঁচতে হবে। এখানে কাজ থাকলে কী আমরা বাইরে যেতাম। হয়তো এরপরে আবার যেতে হবে’।
পুত্রহারা তফিদ আলির এই জবাবই আসলে এই বাংলার গ্রামের দুর্দশা, কাজের আকালের নিদারুণ ছবিকে তুলে ধরছে। রবিবার রতুয়ার চৌদুরিয়ার যুবক সেনাউল হকের দেহ গ্রামে আসার কথা। সেনাউলের দেহ ঘটনার দুদিন পরে শুক্রবার দুপুরে ভেঙে পড়া রেলসেতুর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করেছিল সেনাবাহিনী।
Comments :0