GHUM KERE NEOYAR LARAI

ঘুম কেড়ে নেওয়ার লড়াই

ফিচার পাতা

GHUM KERE NEOYAR LARAI


অমিয় পাত্র

জেলা-নদীয়া, ব্লক-শান্তিপুর, গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম হরিপুর। পঞ্চায়েত প্রধান শোভা সরকার (মণ্ডল) চিঠি পাঠিয়েছেন কর্ণধর মাঝি ও অন্য ১৪৯ জনকে। চিঠির বয়ানে বলা হয়েছে - "It is hereby placed for information that Section 27 of MGNREGA Act has been in force for the F. Y 2022-23 and 2023-24 in West Bengal. That is why the work can not be provided even after receiving demand of work in form 4A for this time being. This is for your kind information please."

 


এই চিঠির প্রেক্ষাপট হলো— সম্প্রতি নদীয়া জেলার ২১টি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রায় ছ’হাজার জব ওয়ার্কার কাজের দাবি পত্র পঞ্চায়েতে জমা দেন। আইন অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে এদের প্রত্যেককে কমপক্ষে ১৪ দিন কাজ দেবার ব্যবস্থা পঞ্চায়েতকে করতে হবে। কেন কাজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না সেটাই এই চিঠিতে বলা হয়েছে। MGNREGA Act-এর ২৭ ধারায় কি বলা হয়েছে? ২৭(১) ধারায় বলা হয়েছে— এই প্রকল্প সুষ্ঠু রূপায়ণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজন মনে করলে রাজ্য সরকারকে নির্দেশিকা পাঠাতে পারে। এবং ২৭(২) ধারায় বলা হয়েছে— এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থ অপব্যয়িত হওয়া বা অন্য কোনও সমস্যা সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার তদন্তের ব্যবস্থা করবে এবং প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সারবত্তা থাকলে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থ দেওয়া বন্ধ করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধনাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুনরায় কাজ চালু করবে। 


আমাদের রাজ্যে কাজ বন্ধ থাকার প্রধান কারণ রেগার কাজে সীমাহীন দুর্নীতি। বাস্তবে রাজ্যের অসংখ্য স্কিমের কোনও অস্তিত্ব নেই, কাগজে কলমে টাকা উধাও হয়েছে। মাটি কাটার কাজ হয়েছে যন্ত্র (JCB) ব্যবহার করে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। ফলের বাগান তৈরি হয়েছে খাতা-কলমে। ভুয়া প্লট দেখিয়ে টাকা তোলা হয়েছে। দলীয় আনুগত্য বিচার করে কাজ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ কাজে অংশগ্রহণ না করেও কাটমানি আদায় দিয়ে মজুরির টাকা পেয়েছে। জবকার্ড থাকা পরিবারকে কোনও কাজের সুযোগ না দিয়ে কার্ডটি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ হলো এই পরিবারগুলো কাজ করতে অনিচ্ছুক। রাজ্যে প্রায় ৮০ লক্ষ শ্রমিকের কাজ পাওয়ার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অসংখ্য বেনিয়ম ধরা পড়ার কারণে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ বন্ধ। রাজ্য সরকার এই পুকুর চুরির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তৃণমূলের এক কচিনেতা বলছেন জনজোয়ারের পর দিল্লি যাবেন রেগার টাকা আনতে। বালখিল্যতা। তখন রেগা আইনের ২৭ ধারার কি হবে? নাকি সব সেটিং হয়ে আছে?

কেন এই ব্যর্থতা? 
রেগার অর্থ লুটপাট করেছে পঞ্চায়েতের কর্মকর্তা, সদস্য, দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী, তাদের পছন্দের ঠিকাদার, সুপারভাইজারদের একটা চক্র। সরকার এবং দলের মাথায় যারা রয়েছেন তাঁদের মদতেই এই দুর্নীতি হয়েছে। যিনি এখন জেলায় জেলায় ভাষণবাজির খেলায় মেতেছেন, পরের প্রজন্মের চোরদের তালিকা প্রস্তুত করছেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনিও এই দুর্নীতির উপভোক্তা। দলটাই চলে লুটের টাকায়। কোটি কোটি টাকা খরচে যে জোয়ার তোলার মহড়া হচ্ছে— সে টাকার উৎস কি? তদন্ত হলে দেখা যাবে সেখানেও ঢুকেছে রেগার লুট হওয়া টাকা। তাই এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তৃণমূলের পক্ষে সম্ভব নয়। লক্ষ লক্ষ স্কিমে চুরি হয়েছে যা সরকারি নথিতে আছে তা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ হচ্ছে না কেন? একটা তদন্ত হলে ক্ষতি কি? কিসের ভয়? আসলে এরাই গ্রামে গঞ্জে তৃণমূল দল চালায়, এরাই তৃণমূলের হৃৎপিণ্ড। এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে দলে মাছি তাড়াবার লোকও থাকবে না। আদর্শের জন্য কেউ তৃণমূল দল করেন না। আদর্শ নামক বস্তুটি তৃণমূল দলে নেই। কে কোথায় কীভাবে করে খাবে,  কীভাবে কালো টাকার পাহাড় জমাবে সেটাই এদের দৈনন্দিন কাজ। দল ও সরকার চলে একজনের মরজি মতো। সেখানে কোনও কথা চলে না।

 

এই সরকার নীতিহীন, দিশাহীন
২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত  আইন ও তার মর্মবস্তুর ঠিক বিপরীতে হাঁটছে। ভুমিসংস্কারের কাজ কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বামজমানায় বণ্টিত জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পাট্টা বাতিল করে সেই জমির দখল দেওয়া হচ্ছে পূর্বতন মালিককে। মোকদ্দমায় আটকে থাকা জমির ক্ষেত্রে সরকার মালিকের অনুকূলে অবস্থান গ্রহণ করছে। এবারের বাজেট অধিবেশনে ভুমি সংস্কার আইনের সংশোধন করে বলা হয়েছে সরকারের হাতে থাকা জমি কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কর্পোরেটকে তাদের আবেদনের ভিত্তিতে মালিকানা স্বত্ব দেওয়া হবে। ভুমিহীন, বাস্তুহীনদের বিনামূল্যে জমি দেওয়ার পরিবর্তে কোম্পানি, কর্পোরেট এবং প্রোমোটারদের বিক্রি করার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। আদিবাসীদের দখলে থাকা বনাঞ্চলের জমির অধিকার দেওয়ার সমস্ত আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যে কাজের সুযোগ কমছে। মুখ্যমন্ত্রী নিদান দিচ্ছেন— 'কাজ নেই তো চপ ভাজো, পকড়া ভাজো, ঘুগনি বেচো'। স্পষ্ট ইঙ্গিত 'কাজ দেওয়া সম্ভব নয়, যেমন খুশি করে খাও'। অগত্যা গ্রামের তরতাজা ছেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্য রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই-ভাইপোরা চপ, পকড়া নয় বিক্রি করছেন চাকরি, গাড়ি গাড়ি বালি, পাথর, কয়লা, গোরু। এদের বাড়ি-গাড়ি হচ্ছে, টাকার পাহাড় জমছে, ভোগ-বিলাস-বন্ধু-বান্ধবী বাড়ছে। সাধারণ মানুষের জন্য রুটি রুজির সঙ্কট বেড়ে চলেছে।


  
বিজেপি-কে চিনে নিন
মোদি জমানায় সরকারি কাজের অভিমুখ কর্পোরেটদের অনুকূলে চলে যায়। স্বভাবতই শ্রমজীবী মানুষের কাজ, মজুরি, অধিকার এবং সামাজিক সুরক্ষা— সবক্ষেত্রেই আঘাত তীব্র হয়েছে। সর্বত্র কাজের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে। ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে  কমিয়ে আনা হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে বরাদ্দ ৬০০০০ কোটি টাকা যা বিগত বছরে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৩৩ শতাংশ কম। হিসাবে দেখা যাচ্ছে এ বছর সক্রিয় জবকার্ড আছে এরূপ পরিবার মাত্র ১১ দিন কাজ পাবে। আইনে বছরে ১০০ দিন কাজের নিশ্চয়তা দেওয়া সত্ত্বেও কেন এই দ্বিচারিতা? যারা কাজ করেছেন, তাদের মজুরি কেন আটকে রাখা হবে? আইনে এই প্রকল্প অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার লাইসেন্স কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে -"institute appropriate remedial measures for its proper implementation within a reasonable period of time." দীর্ঘ ১৭ মাস রেগার কাজে আর্থিক বরাদ্দ বন্ধ রাখা যায় না। মনুবাদী বিজেপি আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে। নানাভাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে বৈরিতামুলক সম্পর্কের দিকে ঠেলে দেওয়া  হচ্ছে। রাজ্যের তৃণমূল এবং কেন্দ্রের বিজেপি উভয় দলই মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই বিভাজনের হাতিয়ারকে ব্যবহার করছে। কেন রেগার কাজ নেই, কেন ১১ লক্ষ পরিবার আবাস যোজনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, কেন কৃষকরা ফসলের সহায়ক মূল্য পাচ্ছে না, কেন বাজারে হু হু করে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর দাম বাড়ছে, শূন্য পদে নিয়োগ নেই কেন, দেশের সম্পদ নির্বিচারে বেসরকারি হাতে যাচ্ছে কেন, রাজ্যজুড়ে দুর্নীতির এই রমরমায় কারা যুক্ত এসব প্রশ্ন আড়াল করতেই জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের মধ্যে সুপ্ত আবেগকে জাগিয়ে বিভেদের পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপি’র লড়াই শুধু মিডিয়ায়। লুট, দুর্নীতির পান্ডারা দলবদলে বিজেপি’র নেতা। মোদী-শাহের নিরাপদ আশ্রয়ে সারদা এবং নারদের চোররা দিব্যি আছেন। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সির কাজ কি দুর্নীতির মাথাকে আড়াল করা? রাজ্যের মানুষ জানেন বামপন্থীদের লড়াই ছাড়া দু’ডজন নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক জেলে যেতেন না। আইনি লড়াই বামপন্থী আইনজীবীরা করছেন। রেগার দুর্নীতির কিনারা বিজেপি করবে একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এই বিপদে মানুষের পাশে বামপন্থীরাই 
গ্রামে কর্মসংস্থানের জন্য চালু প্রকল্প যেমন- জওহর রোজগার যোজনা এবং সম্পূর্ণ গ্রামীণ রোজগার যোজনা সহ পুরাতন প্রকল্পগুলো রেগার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সারাদেশে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের রেগার কাজই একমাত্র কাজের সুযোগ। এই বঙ্গে সেটাও তৃণমূলের লাগামছাড়া দুর্নীতির কারণে বন্ধ। রাজ্যজুড়ে কাজের তীব্র সঙ্কট। মানুষের পেটে টান পড়েছে। অপুষ্টি ও অনাহার বাড়ছে। তৃণমূল এবং বিজেপি’র কাজিয়া চলছে মঞ্চে,  টিভির পর্দায়। কবে আবার রেগার কাজ চালু হবে সেদিকে এই দুই দলের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। গত আর্থিক বছরে পশ্চিমবাংলায় ১১ লাখেরও বেশি পরিবারের আবাস যোজনায় বাড়ি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ অর্থ সদ্ব্যবহার হলো না। কারণ কী? রাজ্য প্রশাসন এবং পঞ্চায়েত প্রাপকদের স্বচ্ছ তালিকা প্রস্তুত করতে ব্যর্থ। রেগা এবং আবাস যোজনা মিলিয়ে গত দেড় বছরে রাজ্য কমবেশি ৩০০০০ কোটি টাকা কাজে লাগাতে পারেনি। এই সরকার অপদার্থ, এই সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ছাড়া অন্য কি বলা যায়? এই অর্থের উপভোক্তা গ্রামের গরিব পরিবার। বঞ্চিত হয়েছেন তারাই। 


আমাদের রাজ্যে খেতমজুর ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সকলের জন্য বাসগৃহ, পরিবার প্রতি বছরে ২০০ দিন রেগার কাজ এবং দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরির দাবিতে প্রথম ধাপে ৮ জুন পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ বকেয়া মজুরির জন্য দাবিপত্র জমা দেওয়া হবে। ১ জুন রাজ্যে প্রায় ৪০০ গ্রাম পঞ্চায়েতে রাতভর অবস্থান ও ধরনার কর্মসূচি হবে। পরবর্তী ধাপে এই কর্মসূচি ব্লকে এবং জেলাস্তরে সংগঠিত হবে। যাদের বেপরোয়া চুরি-দুর্নীতির জন্য এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাদের বিদায় দেওয়ার প্রক্রিয়া থমকে আছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দিন ঘোষণা বিলম্বিত হওয়ার জন্য। তাই দুর্নীতি বন্ধ, দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তির দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজের সাথে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
তৃণমূল, বিজেপি’র অস্তিত্ব মিডিয়ায়। এক্ষেত্রে অর্থের প্রভাব এবং রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে। আমরা চাইলেই এটা পরিবর্তন হবে এমন নয়। বাজারি মিডিয়ার নিরন্তর প্রচার সত্ত্বেও মানুষের ভাবনায় একটি সদর্থক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। গণআন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে আমাদের প্রতিটি মানুষের দরজায় যেতে হবে। ওরা থাক টিভির পর্দায়, খবরের কাগজের পাতায়, আমাদের গন্তব্য গ্রাম-গঞ্জ-শহরের প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি পরিবার। মানুষকে সাথে নিয়ে এ লড়াই চলবে। সব ঘুঘুর বাসা ভাঙতে হবে। চোরের দল বহাল তবিয়তে থাকবে আর পঞ্চায়েতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা হবে- তা হয় না।


 

Comments :0

Login to leave a comment