‘ডেমোক্র্যাসি নয়, দেশে মোদী রাজত্বে চলছে মোবোক্র্যাসি’। মণিপুরে দুই আদিবাসী মহিলার সঙ্গে যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে, তার মাত্র ২৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই সংসদের ভিতরে তো বটেই, বাইরেও বিরোধীরা নরেন্দ্র মোদীর তুলোধোনা করে ছেড়েছেন এভাবেই। দেশের এই অসুস্থ, অমানবিক পরিস্থিতির জন্য মোদী সরকারই যে দায়ী, একযোগে বলেছেন দেশের তাবড়-তাবড় রাজনীতিকরা। মণিপুরের প্রতিবেশী উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির পাশাপাশি বিজেপি শাসিত নয়, এমন সমস্ত রাজ্যও সোচ্চার হয়েছে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— ধিক্কার জানিয়েছে মোদী-শাহকে। প্রশ্ন উঠেছে, আর কতদিন এভাবে এই দু’জন ‘আল ইজ ওয়েল’ মনোভাব চালিয়ে যাবেন? দেশ জ্বললেও আর কতদিন চোখ ঘুরিয়ে থাকবেন তাঁরা? অভিযুক্তদের কঠিনতম শাস্তি দিলেও ওই মহিলাদের সম্মান আপনারা ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
জাতি সংঘর্ষে মণিপুর গত কয়েকমাস ধরেই বিপর্যস্ত। ইতিমধ্যে শতাধিকের বেশি মৃত্যুর সাক্ষী সেই রাজ্য। কেন্দ্র এবং মণিপুরে বিজেপি’র ডবল ইঞ্জিন সরকারের মদতে হিংসা ক্রমশ বেড়েছে। মোদী চুপ করেই থেকেছেন। এতদিনে সেখানে যাওয়ার সময় হয়নি তাঁর, বিদেশ সফরে অবশ্য গিয়েছেন। মণিপুরের যে ভিডিও বুধবার রাতে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, তা এতটাই কদর্য, এতটাই ঘৃণ্য যে গোটা দেশ নড়ে গিয়েছে।
দেশের মহিলাদের এই সম্মানহানিতে ক্ষোভ-হতাশা মিশিয়ে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘‘৭৭ দিন আগে এই ভয়ঙ্কর অপরাধ হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই মণিপুর প্রশাসন এবং পুলিশ তা জানত। কিন্তু কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এমনকী এখনও কোনও তৎপরতা দেখানো হচ্ছে না। ন্যায় বিচারের কোনও উদ্যোগও নেই।’’ ওই ভিডিও যাতে আরও ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তাই টুইটারকে দেওয়া নির্দেশের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘‘বরং এই ন্যক্কারজনক ঘটনা যারা বা যে মাধ্যম সামনে আনল, তাদেরই কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে। কী ভয়ানক!’’
মোদী নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব অস্বীকার করছেন বলে তোপ দেগে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘‘ডেমোক্র্যাসিকে এখন মোবোক্র্যাসিতে পরিণত করা হয়েছে। মণিপুরে মানবিকতার মৃত্যু হয়েছে। সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতি সংঘর্ষে বিধ্বস্ত রাজ্যটিকে নিয়ে কিছু বলুন। দেশকে জানান, ঠিক কী ঘটেছে।’’ সরাসরি আক্রমণ শানিয়ে তিনি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদীজি, দেশে কখনও আপনার এই নীরবতাকে ক্ষমা করবে না। যদি আপনার সরকারের ন্যূনতম লজ্জাও বেঁচে থাকে, তাহলে মণিপুর নিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে মুখ খুলুন। অন্যদের ঘাড়ে দায় না চাপিয়ে দেশবাসীকে বলুন, কেন্দ্রে এবং ওই রাজ্যে সরকার সামলাতে আপনি ব্যর্থ।’’ পরে সাংবাদিকদের সামনে খাড়গে বলেন, ‘‘এই বিপর্যয়ের সময়ে আমরা বিরোধীরা মণিপুরের মানুষকে রক্ষা করব।’’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘রাহুল গান্ধীর কাছে তো কোনও বাড়তি সুবিধা ছিল না। তবু তিনি মণিপুর গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এত সুযোগ-সুবিধা-পরিষেবা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেখানে যেতে পারলেন না?’’
কংগ্রেসের আরেক প্রবীণ নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘৬৩ দিন আগে এফআইআর দায়ের হয়েছে। তা-ও অভিযুক্তদের ধরা গেল না এখনও। ইন্টারনেট না থাকায় গোটা দেশের মানুষের কাছে এই ঘটনা পৌঁছায়নি। হয়তো কেউ কেউ আন্দাজ করতে পারছিলেন, মণিপুরে মহিলাদের উপর কতটা অত্যাচার হচ্ছে। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই একথা বলা যায় না যে, নারী এবং শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে কোনও খবর ছিল না। মণিপুরে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত ৭৬ দিন অপেক্ষা করেছেন মুখ খোলার জন্য। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কেউ জানতেন না এত বড় একটা ঘটনা? মোদী সরকার কবে থেকে এই ‘আল ইজ ওয়েল’ অ্যাটিচিউড দেখানো বন্ধ করবে?’’ মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোর দাবিও জানিয়েছে কংগ্রেস।
মহিলা কংগ্রেসের প্রধান নেত্তা ডিসুজা এদিন সাংবাদিক সম্মেলন করেন। মহিলাদের সঙ্গে এই অভব্যতার কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। চোখে জল নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘স্মৃতি ইরানিকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার আগে আপনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এধরনের ঘটনা ঘটলে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা উচিত। আপনি তৎকালীন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখন তো আপনারা ক্ষমতায়। আপনি এখন চুপ কেন?’’
মণিপুরের নৃশংসতা, সে রাজ্যের অশান্তি আড়াল করতে মোদী কংগ্রেস শাসিত ছত্তিশগড়কে ঢাল বানানোর চেষ্টা করেন সম্প্রতি। সেরাজ্যে সফরে গিয়ে ভূপেশ বাঘেলের সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কতখানি ব্যর্থ, তা প্রমাণ করতে হাওয়া গরম করেছিলেন। বাঘেল এদিন বলেন, ‘‘মণিপুরে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। ছত্তিশগড়ের সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। এই রাজ্য যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ।’’ রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট বলেন, ‘‘কেন্দ্রের গাফিলতিতে মণিপুরে আজ এই অবস্থা।’’
বিজেপি’র একসময়ের শরিক শিবসেনা, পিডিপি, জেডি(ইউ)’র পাশাপাশি ডিএমকে, আপ, আরজেডি, সপা, সহ সমস্ত বিরোধীরা ক্ষোভ জানান। এনসিপি প্রধান শারদ পাওয়ার অবিলম্বে মণিপুরে শান্তি ফেরাতে কেন্দ্রের পদক্ষেপের দাবি তোলেন। আম্বেদকারের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘মানবিকতা না থাকলে তোমার মহিমা মূল্যহীন। এই সময়ে আমাদের প্রত্যেককে এক হয়ে মণিপুরবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে।’’ পাওয়ার-কন্যা দলের কার্যকরী সভাপতি সুপ্রিয়া সুলে বলেন, এরকম একটি ভিডিও মনে ভয়ঙ্কর আঘাত দেয়। কতটা অসুস্থ-অমানবিক পরিবেশ। এর দায় কেন্দ্রের।
বিজেপি সর্বত্রই ডবল ইঞ্জিন সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। রাজ্যে-রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদী-শাহ গলা চড়িয়ে ডবল ইঞ্জিনের সুবিধা ব্যাখ্যায় লেগে থাকেন। বিজেপি’র একসময়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জেডি(ইউ) এই ডবল ইঞ্জিন সরকারের প্রসঙ্গ তুলেই খোঁচা মেরেছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, মণিপুরে তো ডবল ইঞ্জিন সরকার। তা-ও ওই রাজ্য জ্বলছে কেন? নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে, মহিলাদের সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে— চূড়ান্ত বিরক্তির সময়। সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদব বলেন, বিজেপি’র ভোটের রাজনীতি, ঘৃণার রাজনীতি মণিপুরের এই অবস্থার জন্য দায়ী। তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন বলেন, এই ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যেভাবেই হোক শান্তি ফেরাতে হবে সরকারকে।
এদিন আবার কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং জামিন পেয়ে গিয়েছেন। আপ কটাক্ষ করে বলেছে, ‘‘বিজেপি আসলে ব্রিজভূষণ জনতা পার্টি।’’ জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি, মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা সহ প্রত্যেকে দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন। একই দাবি করেছেন শিবসেনা (উদ্ধব)’র সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীও।
Manipur
মণিপুর নিয়ে দেশজুড়ে ধিক্কার মোদী-শাহকে
×
Comments :0