সুদীপ্ত বসু ও রামশঙ্কর চক্রবর্তী: নন্দকুমার
‘দুদিন ধরে খেতে পারছে না, ভাত গিলতে পারছে না, মুড়িও খেতে পারছে না। ওর গলায় বুট দিয়ে চাপা দিয়েছিল লকআপের ভিতরে...।’ আর কথা বলতে পারলেন না। তমলুক জেলের বাইরে তখন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শেখ সোনু, গলা বুঁজে আসছে কান্নায়।
সোমবার সকালে মাত্র কয়েক মিনিটের সুযোগ পেয়েছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে জেলে দেখা করার। ১৫ ইঞ্চি দেওয়াল, দু’টো লোহার জাল পেরিয়ে আবছা আলোয় শুধু ঠাওর করতে পেরেছেন স্ত্রী আরজুনা বিবির মুখ। শুনেছেন সেই ভয়াবহ অত্যাচারের বিবরণ, নিজেই শিউরে উঠেছেন।
‘‘জানেন, থানায় একটা ঘরে আলাদা রাখা হয়েছিল ওঁকে। এক মহিলা পুলিশ, দু’জন পুরুষ পুলিশ ছিল। শাড়ি খুলে নিয়ে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়েছিল। মেঝেতে ফেলে হাঁটু পর্যন্ত শাড়ি তুলে থাইয়ের ওপরে বুট পড়ে দাঁড়িয়েছিল একটা পুলিশ। গলাতেও পা দিয়েছিল। এরা মানুষ? আমার স্ত্রী কী অপরাধ করেছিল, একটা ঘর চাইতে গিয়েছিল।’’ আর পারলেন না, কেঁদে ফেললেন নরঘাটার ইটভাটার শ্রমিক শেখ সোনু।
জানা গিয়েছে, শুক্রবার রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ থানার ভিতরে যখন বিবস্ত্র করে আরজুনা বিবির ওপর আমনুষিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে সেই সময় ওসি’র ঘরে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল সভাপতি দীননাথ দাস ও নন্দকুমারের দাপুটে তৃণমূল নেতা প্রদীপ দে-কে। গত শুক্রবার যখন বিডিও অফিসের বাইরে পুলিশ নৃশংসভাবে লাঠি চালাচ্ছে সিপিআই(এম) নেতা, কর্মী, সমর্থকদের ওপরে তখন আবার বিডিও অফিসের দোতলায় বসে চা খাচ্ছিলেন বিডিও শানু বক্সি, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীননাথ দাস।
অভিযোগ, সাত বছর আগে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় মেইনস পরীক্ষায় চারটি কম্পালসারি পেপারে আড়াইশোর বেশি নন্বর বেড়ে গিয়েছিল এই বিডিও’র! ফলে অবৈধভাবে মেধা তালিকাতেও এগিয়ে যান তিনি। সেই বিডিও-ই আবাস যোজনা দুর্নীতি নিয়ে ডেপুটেশন নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের নৃশংস, উন্মত্ত আচরণের ভয়ানক বিবরণ শোনার আগে একটি বারের জন্য হলেও এসে দাঁড়াতে হবে নন্দকুমার ব্লকের শীতলপুর পঞ্চায়েতের গিরিরচক গ্রামে। গিরিরচক গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে এগলেই একটি ইটভাটা। শেখ সোনু এই ইটভাটারই শ্রমিক। ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেল, শেখ সোনু ও আরজুনা বিবি’র এই দম্পতির আসলে কোনও ঘরই নেই!
স্থানীয় ইটভাটার মালিকের একটা কুঁড়েঘরে থাকেন তাঁরা। সারা বছর ভাটায় কাজ থাকে না, তখন গ্রামের ভিতরে দাদার বাড়িতে গিয়ে থাকেন আরজুনা বিবি। ২০১৮-র তালিকাতেও নাম ছিল না। এবারেও নাম নেই। সমীক্ষক দল অর্থাৎ পুলিশ যখন এসেছিল তখন বলেও নাম তোলাতে পারেননি। দু’বার দুয়ারে সরকারের শিবিরে গিয়েও তোলাতে পারেননি নাম। অবশেষে গত শুক্রবার আবাস যোজনায় নিজের ঘরের দাবিতে বিডিও অফিসে গিয়েছিলেন। তারপর এখন জেলেই ঠিকানা ৩১ বছর বয়সি ওই গৃহবধূর।
ঘরে কিছু নেই, দু’একটা থালা বাসন ছাড়া। ‘‘এই ঘরে কোন জন্তুও থাকতে পারবে? গত পাঁচ বছর ধরে আবাস যোজনার ঘরের জন্য বউটা ছুটে বেড়াচ্ছিল সব জায়গায়, এখন শেষমেশ জেলে’’, বললেন শেখ সোনু।
গিরিরচক গ্রামেরই বাসিন্দা গোপাল হাবর, এই ষাটোর্ধ্ব মানুষটি এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছেন। ইটভাটার শ্রমিক। নিজের বাড়ি? ‘আসুন একবার দেখে যান’। দেখা গেল মাটি আর ইট দিয়ে কোনোমতে একটা দেওয়াল তোলা, তাও ভেঙে পড়েছে, বাকিটা পলিথিন পেপার। ‘‘ঘরের দাবিতেই বিডিও অফিসে গিয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে ছিলাম চুপচাপ, পুলিশ এসে মারা শুরু করল, পায়ে হাঁটুতে, যন্ত্রণা খুব,’’ বলছিলেন গোপাল হাবর। ওখানে চিকিৎসাও করাতে পারেননি, ওষুধের দোকানে ঢুকেও পুলিশ তাড়া করেছে।
এই গিরিরচকে নশোর বেশি পরিবারের বাস। প্রায় ১২০ জনের বেশি মানুষ যাঁদের বাড়ি বলতে কার্যত কিছু নেই, ভেঙে পড়া ঘর, কিন্তু নাম নেই আবাস যোজনার তালিকায়। অথচ এই গ্রামেই পাকা দোতলা বাড়ির মালিকের নাম রয়েছে তালিকায়। কানের দুল বন্ধক দিয়ে দু’হাজার টাকা তৃণমূলকে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন এক গৃহবধূ, তবুও মেলেনি ঘর! কারণ সিপিআই(এম) এখনও ভোট পায় এই বুথে!
এই গিরিরচক গ্রামেই তিনজন জেলে। আরজুনা বিবি ছাড়াও তাঁর দাদা শেখ আখতার ও আরেক সিপিআই(এম) কর্মী রফিকুল ইসলাম।
বাবাকে এদিন সকালে জেলে দেখতে গিয়েও পারেননি, ওইভাবে গরাদের ভিতর, দু’টো জালের ভিতরে বাবাকে দেখে কেঁদে ফেলে বেরিয়ে এসেছিলেন বাইরে। ওডিশায় মার্বেলের কারখানায় কাজ করেন শেখ হোসেন। জেলবন্দি বাবা রাজমিস্ত্রি। ‘‘আমরা তো জানতামও না কি হয়েছে, বাবা বিডিও অফিসে গিয়েছিল তালিকায় নাম তোলার দাবিতে। তারপর সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরেছিল। বলল পুলিশ মেরেছে, পায়ে, হাতে, পিঠে কালশিটে দাগ। তারপর রাত দু’টো নাগাদ পুলিশ আসে বাড়িতে। আমার বোনরা যে ঘরে শুয়েছিল সেখানে দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করে। আমরা রুখে দাড়াই। তারপর ওত রাতে বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় থানায়।’’
নরঘাট থেকে ফের নন্দকুমারের কুমোরআড়া পঞ্চায়েতের মহম্মদপুর গ্রাম। গ্রামের একেবারে প্রান্তে ষাটোর্ধ্ব নিতাই জানার ঘর। প্রায় একই, ভেঙে পড়েছে দরজা, জানলাও, বাঁশ, বেড়া, গাছের ডাল সব কিছু দিয়ে ঠেকনা দেওয়া আছে। তাঁর নামও নেই আবাস যোজনায়। বাড়িতে স্ত্রী, চার মেয়ে। তিন মেয়ের বিয়ের হয়েছে, এক মেয়ের বিয়ের দু’মাসের মাথায় স্বামী প্রয়াত হয়েছেন। সেই নিরীহ মানুষটিকেও পুলিশ মারতে মারতে নিয়ে গিয়েছে থানায়, এখন জেলে। দুপুরে না জ্বলা উনুনের সামনে অসহায়ের মত বসে তাঁর স্ত্রী অনুরাধা জানা। ‘‘বাড়িতে কোনও পুরুষ নেই,পার্টির লোকজন একটু সাহায্য করছে তাই, নয়তো কীভাবে থাকবে আমরা জানি না।’’
সেই নন্দকুমারই মঙ্গলবার দেখবে আদালতের ভিতরে এবং বাইরে রাস্তা, সেই বিডিও অফিসের, সেই কুখ্যাত থানার সামনে পালটা প্রতিবাদের উত্তাল চেহারা।
Comments :0