সুদীপ্ত বসু
‘ব্যক্তির স্বার্থরক্ষায় একটা সরকার কেন সুপ্রিম কোর্টে আসবে?’ প্রশ্ন তুলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। অষ্টাদশ লোকসভার ভোট পর্বের মাঝেই রাজ্য সরকার ছুটে গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের দরজায়। কেন?
মিটিং মিছিলে, গান্ধী মূর্তির পাদদেশ থেকে দিল্লির রাস্তায় মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সাজানো হল্লা চলেছে, টেলিভিশনের পর্দায় পরিকল্পিত ভাষ্য তৈরিতে ‘রাজ্যকে বঞ্চনা করা হচ্ছে কেন, ১০০ দিনের বকেয়া টাকা দিতে হবে’ বলে স্লোগান তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু আদালতের দরজায় পৌঁছেছেন ‘ন্যায় দাবি’ আদায়ে? আবাস যোজনার ঘরের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রেখেছে বলে নির্বাচনী সভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি বিলোচ্ছেন— তৃণমূলকে ভোট দিলে ৩১’র ডিসেম্বরের মধ্যে পাকা বাড়ির টাকা পৌঁছে যাবে। সেই মর্মে ফরমও বিলি করছে গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু আবাস যোজনার বাড়ি আটকানো নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নেড়েছে রাজ্য সরকার? উত্তর, না।
কিন্তু ভোটের মাঝেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রাজ্য চলে গেছে সুপ্রিম কোর্টে। কেন? রেগার বকেয়া বরাদ্দ, আবাস যোজনার বকেয়া থেকে মমতা ব্যানার্জির সরকারের কাছে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শেখ শাহাজাহান। সন্দেশখালি জুড়ে শাহজাহানের সাম্রাজ্য রক্ষায় তৎপর মমতা ব্যানার্জির সরকার। তাই হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে তড়িঘড়ি সুপ্রিম কোর্টে সরকার। সরকারের অগ্রাধিকার-ই সরকারের পরিচয়। মমতা ব্যানার্জির সরকার দুষ্কৃতী, দুর্নীতিগ্রস্তদের রক্ষায় উদগ্রীব, এটাই আশঙ্কার রাজ্যবাসীর কাছে।
*******************************
আদিবাসীদের জমি দখল, অবৈধ ভেড়ির কারবার, মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের শয়ে শয়ে অভিযোগ থাকা সন্দেশখালির ত্রাস শাহজাহান ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্ট গত ১০ এপ্রিল সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই শাহজাহানকে রক্ষায় বিপুল টাকা খরচে, অভিষেক মনু সিংভির মতো আইনজীবীকেও সুপ্রিম কোর্টে দাঁড় করায় রাজ্য সরকার। মমতা ব্যানার্জির সরকার হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই সিবিআই তদন্তের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দরজায়। বিস্মিত সুপ্রিম কোর্টও। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে ‘ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষায় একটা সরকারকে কেন সুপ্রিম কোর্টে আসতে হবে?’ রাজ্য সরকারের পক্ষে আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি তখন বলেন যে, হাইকোর্ট সন্দেশখালি কাণ্ডে যে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ রাজ্যের পুলিশ বাহিনী সহ রাজ্য প্রশাসনের গোটা সিস্টেমকে মনোবল ভেঙে দিয়েছে, হতাশ করেছে। কতটা চক্ষুলজ্জাহীন হতে পারে একটা সরকার যে সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে বলছে যে সন্দেশখালিতে মহিলাদের ওপর অত্যাচার, জমি দখলের ঘটনায় হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তাতে নাকি পুলিশ প্রশাসনের মনোবল ভেঙেছে! তাহলে পুলিশ প্রশাসন গত দশ বছরে নীরব ছিল কেন? আসলে পুলিশ প্রশাসন নয়, সন্দেশখালিতে শাহজাহান-নামা আসলে শাসক দলের মনোবল ভেঙেছে, তাই এত তৎপরতা।
তাও একবার নয়, শুধু সন্দেশখালি নিয়েই ‘ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষায়’ দু’-দু’বার সুপ্রিম কোর্ট ছুটেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার, ভোটের আবহেই। ৫৫ দিন তৃণমূলের ১৩ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক জেলা পরিষদের সদস্য শেখ শাহজাহানকে দীর্ঘ লুকোচুরি খেলার পরে পুলিশ ‘গ্রেপ্তার’ করেছিল মিনাখাঁ থেকে। তারপর আদালতে নির্দেশ দেয় শাহজাহানকে সিবিআই হেপাজতে তুলে দিতে। তা আটকাতেও বিপুল টাকা খরচ করে একবেলার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে যায় সরকার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টেও আবেদন খারিজ হওয়ার পরে দীর্ঘ নাটকীয়তা শেষে সিবিআই হোপাজতে পুলিশ তুলে দেয় শাহজাহানকে।
অর্থাৎ শুধু শেখ শাহজাহানের মতো দুষ্কৃতীকে, জমি দখল থেকে খুনের আসামিকে রক্ষায় দু’মাসের মধ্যে দু’বার সুপ্রিম কোর্টে যায় আস্ত একটা সরকার! এটাও বেনজির। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অগ্রাধিকার শাহজাহানই- মমতা ব্যানার্জিই তা প্রমাণ করেছে। এমনটাই তো চায় আরএসএস, বিজেপি। মেরুকরণের এমন সহজ, প্রশস্ত রাস্তা ভারতের আর কোনও অবিজেপি সরকার দিতে পারে আরএসএসকে? এরাজ্যের দুই মেরু নির্মিত ভাষ্যের রহস্য এটাই। আপনাকে ডুব দেওয়ার জন্য পাঁক ভর্তি পুকুরকেই বেছে নিতে কর্পোরেটের টাকায়, নির্বাচনী বন্ডের ‘জনমত নির্মাণের’ নামে প্ররোচিত করা হচ্ছে!
**********************
তবে এই প্রথম নয় সারদা থেকে রোজভ্যালি, নারদ ঘুষ কাণ্ড থেকে কয়লা পাচার, গোরু পাচার প্রতিটি ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ঘটনা গত কয়েকবছরে বারেবারে দেখা গেছে। কখনও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিবাল, অভিষেক মনু সিংভি কখনও মুকুল রোহতগির মতো আইনজীবীদের দাঁড় করানো হয়েছে। রাজ্যের কোষাগারের টাকা খরচ করে কখনও শেখ শাহাজাহান কখনও অনুব্রত মণ্ডলদের তদন্ত থেকে বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে সরকার। জনস্বার্থে নয়, ২০১১’র পরে সুপ্রিম কোর্টে দ্বারস্থ হচ্ছে রাজ্যের সরকার কেবল দলীয় স্বার্থে এমন ঘটনা একাধিক। গত পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েনের হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে তড়িঘড়ি রাজ্য ছুটেছিল সুপ্রিম কোর্টে। একেকটা শুনানির জন্য মুকুল রোহতগি, কপিল সিব্বাল, অভিষেক মনু সিংভির মতো আইনজীবী লক্ষ লক্ষ টাকা নেন। কোটি কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে উবে গেছে স্রেফ তৃণমূলকে রক্ষা করতে।
তথ্য জানার অধিকার আইনে সম্প্রতি পাওয়া তথ্যে জানা গেছে ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইনি ব্যয় মেটাতে তহবিলের বরাদ্দ যেখানে ছিল ২৪কোটি মতো সেখানে ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে হাইকোর্টে ১১ হাজার ৯৬৯টি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছিল, রাজ্য সরকার সেগুলির একটি পক্ষ ছিল, ২০২২-২৩ সালে এই ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৩৫। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। রাজ্য সরকারের প্যানেলভুক্ত আইনজীবীদের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে দলীয় স্বার্থে সুপ্রিম কোর্টে যখন দৌড়াচ্ছে সরকার তখন প্যানেলের বাইরে নামজাদা আইনজীবীদের দাঁড় করানো হচ্ছ লক্ষ লক্ষ টাকায়। এর কোনোটার পিছনের রাজ্যের মানুষের স্বার্থ যুক্ত নেই।
শুধু চিট ফান্ড কাণ্ডের তদন্ত ঠেকাতে রাজ্যের কোষাগার থেকে সুপ্রিম কোর্টে দিনের পর দিন মামলা লড়তে ১১ কোটি টাকা খরচ করেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। এরাজ্যে শুধু ২০১১ সালের পর থেকেই প্রায় ১৭০০টি সংস্থা দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে তুলেছে, এরাজ্যের গ্রাম অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েই। শুধু সারদা, রোজভ্যালি সহ দশটি সংস্থার প্রতারণাতেই আত্মঘাতী হয়েছেন ২৬৪ জন। একটিবারও মুখ খোলেননি মুখ্যমন্ত্রী। টাকা ফেরতের দাবিতে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি বিজেপি’কেও। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নামও জড়িয়েছে সারদা, রোজভ্যালি দুই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতেই। দুটি চিট ফান্ড সংস্থার সংবাদমাধ্যমও কার্যত ভাড়া খেটেছে শাসক দলের হয়ে। এবং এই দুটি চিট ফান্ড সংস্থারই রমরমা বেড়েছে ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি মহাকরণে ঢোকার পর থেকেই।
দশ বছর পেরিয়েছে। আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তা আজও দিনের আলো দেখেনি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্ত ও প্রতারক সংস্থার সম্পত্তি বেচে টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও বিশ বাঁও জলে। রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় আটকে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত। ২০১৪ সালে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরে কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী সংস্থার হাত বেঁধে ফেলেন। রাজ্য সরকার এই তদন্ত আটকাতে ১১ কোটি টাকা খরচ করে।
****************
শুধু তাই নারদ ঘুষ কাণ্ডের তদন্তেও একই ভূমিকা দেখা যায় সরকারের। নিজাম প্যালেসে তৃণমূলী বিক্ষোভ, হামলার ঘটনায় নারদ কাণ্ডের মামলা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার শুনানির মাঝপথে হাইকোর্টে হলফনামা দাখিল করতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। কলকাতা হাইকোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে। তা চ্যালেঞ্জ করেই মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের আইনমন্ত্রী নারদ কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন মামলা দায়ের করে। বিপুল টাকা খরচ করে লড়া হয় সেই মামলাও।
মমতা ব্যানার্জি দাবি করেছিলেন ‘সিবিআই আগে প্রাইম মিনিস্টারের অধীনে ছিল এখন হোম মিনিস্টারের অধীনে’! মমতা ব্যানার্জি এমন ভুল তথ্য হামেশাই রাজ্যবাসীর সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু একজন মুখ্যমন্ত্রী কেন এমন ভুল প্রকাশ্যে বলে বেড়ান? রহস্য লুকিয়ে আছে আসলে সেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ, জন-অভিযোগ মন্ত্রকের নিস্পৃহতার মধ্যেই। সেই নিস্পৃহতার জন্যই সবথেকে লাভবান দুজন ব্যক্তি হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর সিবিআই’র আবেদনও এখন বকেয়া রয়েছে প্রায় ছয় বছর ধরে! সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের(সিভিসি) রিপোর্ট বলছে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গোটা দেশে একাধিক দূর্নীতির মামলায় (ব্যাঙ্ক, এমনকি সরকারি দপ্তরের দুর্নীতি) জনপ্রতিনিধি ও সরকারি আধিকারিক সহ ১১০ জনের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর সম্মতিটুকু পর্যন্ত আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ, জন-অভিযোগ মন্ত্রক। সিবিআই’র তরফে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর আবেদন করা হলেও তা কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ ও জন অভিযোগ মন্ত্রক ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। এই মন্ত্রকের অধীনেই রয়েছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এই মন্ত্রক নরেন্দ্র মোদীর হাতেই রয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই সিবিআই’র তরফে কলকাতা থেকে দিল্লির সদর দপ্তরে তৃণমূলের তিনজন সাংসদ ও একজন মন্ত্রীর জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে মামলা ও আইনি প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সিবিআই আবেদন জানায়। সেই আবেদন সিবিআই’র সদর দপ্তর থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ মন্ত্রকে পৌঁছায়। ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। আবেদনের ফাইলে সম্মতির সই মেলেনি, তদন্ত প্রক্রিয়া মাঝপথেই আটকে। শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া বাকি তিনজন হলেন-তৃণমূলের দমদমের তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়, হাওড়ার সাংসদ প্রসূন ব্যানার্জি, বারাসতের কাকলি ঘোষদস্তিদার। সবুজ সঙ্কেত মেলেনি প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা দপ্তর থেকে! একই সঙ্গে শীতঘুমে চলে গেল মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রির তদন্তও। অন্তত শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত কেন থমকে তা নিয়ে আদালতে ছুটতে দেখা গেছে মমতা ব্যানার্জির দল বা সরকারকে?
উত্তর না। কেন? তা বুঝতে বাড়তি কষ্ট করারও প্রয়োজন নেই।
Comments :0