India Pakistan

জাহির-জোয়া, বিহানের ভেদ করছে না পাক-গোলা

জাতীয় আন্তর্জাতিক

জাহিন খান, জোয়া খান। যমজ দুই ভাইবোনের বাড়ি পুঞ্চে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর জম্মুর একেবারে শেষ প্রান্তের এই জেলা পাকিস্তানের মর্টার হানায় বিধ্বস্ত। এই দুই খুদে ভাইবোনও তার থেকে রেহাই পায়নি। শুধু জাহিন, জোয়া নয়, মর্টার শেল প্রাণ কেড়েছে ১৩ বছরের বিহান ভার্গবেরও। উগ্র জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধের উন্মাদনার মধ্যে জাহিন, জোয়া, বিহানদের প্রাণ বুঝিয়ে গেল, গোলাবারুদ কোনও ধর্মের ভেদাভেদ করছে না। প্রাণ কাড়ছে নিরীহ মানুষেরই। যাদের এই সংঘাতে, যুদ্ধোন্মত্ততায় কোনও ভূমিকা নেই। পুঞ্চের পরপর ছোট ছোট মহল্লায় ভাস্কর, মহতাব, সুর্জান সিংদের বাড়ি। তাঁদের বাড়ির দেওয়াল, ছাদ ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে। কেউ চোখের সামনে নিকটজনের মৃত্যু দেখলেন, কেউ গোলাগুলি, সাইরেনের শব্দের মাঝেই পরিজনকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেও বাঁচাতে পারেননি তাঁকে। কথা বলতে গেলেই গলা কাঁপছে তাঁদের। ভবিষ্যৎ কি জানেন না। ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজেদের এতদিনের বাস ছেড়ে পালাতে হচ্ছে। অস্ফুটে বলছেন, ‘বড়দের থেকে শুনেছি, ১৯৬৫, ১৯৭১-র সময়েও এমন হয়নি।’
জাহিন, জোয়ার বাবা রামিজ এখন হাসপাতালে ভর্তি। তিনিও ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরপর ধেয়ে আসে গোলাগুলি। চোখের সামনে দেখেন শেল এসে পড়ল, স্প্লিন্টার ফেটে মুহূর্তের মধ্যে ‘নেই’ হয়ে গেল তাঁর দুই সন্তান। তাদের সঙ্গেই গুরুতর জখম হন রামিজ। তাঁকে কোনোরকমে সুরানকোটের হাসপাতালে নিয়ে যান প্রতিবেশীরাই। পুঞ্চের বাসিন্দা ভাস্কর শর্মার অসহায় প্রশ্ন, ‘কেউ কীভাবে নির্বিচারে শহরের মধ্যে এভাবে মর্টার হানা চালাতে পারে?’ ভাস্করের ভাইপো বিহান। বলতে বলতে চোখ বুঁজে আসে তাঁর, ‘ও আমাদের সঙ্গেই ছিল। সেদিন গোটা রাত গোলা এসে পড়ছে। ভয়ে আমরা কাঠ হয়ে আছি। সকালে ঠিক হয়, আমাদের যা হয় হোক, বিহানকে পুঞ্চে না রেখে অন্য কোথাও আপাতত পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সেই মতোই ওকে একটি গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। দিলেরার কাছে হঠাৎ সেই গাড়ির উপর এসে পড়ে মর্টার। মুহূর্তে সব শেষ। একেবারে মাথায় এসে লেগেছিল।’ 
একটি হিন্দি দৈনিকে ভাস্কর, রামিজদের যন্ত্রণা তুলে ধরা হয়েছে। সেই সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিকে পুঞ্চের আরেক বাসিন্দা মহতাব দীন জানান, ‘সুবে সে হি ধামাকা কি আওয়াজ আ রহি থি। ম্যায়নে আপনে বাচ্চো কি সাথ দিওয়ার কি আড় লে রহী থি, ইসলিয়ে বাঁচ সকা। বরনা আজ আপকে সাথ খাড়া হো কর বাত নহি কর পাতা।’ যে দেওয়ালের পিছনে মহতাব দাঁড়িয়েছিলেন, সেই দেওয়ালে অজস্র ছিদ্র। মহতাবের শরীরেও আঘাতের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে। মহতাব বলেছেন, তাঁর চেনা-পরিচিত জায়গাটি কেমন হুট করে বদলে গেল। আরেক স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জীবের কথায়, ‘গোলাবারি ইতনি তেজ থি কি, ঘরো সে নিকলনা মুশকিল হো গয়া থা। রাত দো বাজে সে লেকর দৌপহের কে এক বাজে তক বমবারি চলতি রহি। লোগ পুঞ্চ ছোড়কর ভাগনে লাগে।’ 
পুঞ্চের গুরু সিং সভা সাহিব গুরুদ্বারের পাশেই বাড়ি সুর্জান সিংয়ের। পাক মর্টারের গুরুদ্বার এবং সুর্জানের বাড়ির দেওয়াল ছিদ্রে ভরে গিয়েছে। ছাদে বিরাট গর্ত হয়ে গিয়েছে। নিজের বাড়ির অবস্থা ওই সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে ঘুরিয়ে দেখান সুর্জান। পরপর আঘাতে দেওয়ালগুলি ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে। বললেন, ‘আমি পাগড়ি মাথায় শুয়েছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে শব্দ শুনি। আমাদের বাড়ির ছাদে এসে পড়ে মর্টার। আর তার টুকরো লাগে আমার পাগড়ির কাপড়ে। প্রথমে বুঝতেই পারিনি কি হলো। ঘর ধোঁয়ায় ভরে যায়। ছাদ ধসে পড়তে থাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি আমার ভাইপো অমরজিৎ মর্টার শেলের ঘায়ে গুরুতর আহত হয়েছে। ওর বুকে লাগে স্প্লিন্টার। হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে প্রাণ হারায় ও। অমরজিৎ ২২ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে। 
পুঞ্চের জামিয়া মসজিদে নামাজ পড়ান মৌলানা মুশতাক আহমেদ। তাঁর কথায়, রাত একটা নাগাদ জোরে শব্দ হয়। রাত যত বাড়ে, শব্দও বাড়তে থাকে। প্রাণ হাতে বসেছিলাম। আমার বাড়ির উল্টো দিকেই মাস্টার নাজির আহমেদ থাকেন। ওঁর বাড়ির উপর পর পর মর্টার শেল পড়তে লাগে। তিন-চারটি বিস্ফোরণ হয়। নাজির সাহেবের স্ত্রী শাকিলা তাবাসুম প্রাণ হারান। আমরা দৌড়ে যাই, নাজির সাহেবকে বের করে আনি। 
সীমান্ত বরাবর উত্তেজনার প্রভাব বরাবরই সবথেকে বেশি পড়ে পুঞ্চের বাসিন্দাদের উপর। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাকিস্তানের পালটা হামলার জেরে পুঞ্চে তিন জন মহিলা, পাঁচ শিশু সহ ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানায় কেন্দ্র। সেদিন পর্যন্ত জখম হন ৫৯ জন। শুক্রবার আরও একজন স্থানীয় বাসিন্দার মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। জখম হয়েছেন তিন জন। এদিন নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এম মুরলী নায়েক নামে এক জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। তিনি অন্ধ্র প্রদেশের সত্য সাই জেলার বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত কাশ্মীরের কুপওয়ারা, বারামুলার সঙ্গেই বৃহস্পতিবারও রাতভর রাজৌরি, পুঞ্চে গোলাগুলি চলেছে। পরপর মর্টার এসে পড়েছে। ভোররাতের বিভিন্ন ছবি, ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে, আকাশে উড়ছে ড্রোন সহ আরও কিছু। ভোর ৩টে ৫০ থেকে ৪টে ৪৫’র মধ্যে বিরাট জোরে বিস্ফোরণ হয় পুঞ্চ এবং রাজৌরির মাঝে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে সাইরেন, ব্ল্যাকআউট করে দেওয়া হয়। সংবাদসংস্থা পিটিআই’র খবর থেকে জানা যাচ্ছে, পুঞ্চের লোরান এবং মেন্ধার সেক্টরের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোরানের বাসিন্দা মহম্মদ আবরার প্রাণ হারিয়েছেন। জখমদের মধ্যে রয়েছেন মেন্ধারের চালেরি এলাকার লায়াকাত হুসেন। বাকিদের নাম পরিচয় রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। এদিন সকালে এক্স হ্যান্ডেলে জম্মুর ডেপুটি কমিশনার প্রত্যেকে শান্ত থাকার বার্তা দেন। কোনোরকম দুশ্চিন্তা না করার কথাও বলেছেন। 
এই পরিস্থিতিতে জম্মুর সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারি আধিকারিকদের কথা অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পুঞ্চ এবং রাজৌরির শতাধিক বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে রাখা হয়েছে তাঁদের। বৃহস্পতিবার রাতে সাতওয়ারি, সাম্বা, আরএস পুরা এবং আরনিয়ায় জনবসতি লক্ষ্য করে পাকিস্তান আটটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। যদিও ভারতীয় বায়ুসেনা প্রতিটিই প্রতিহত করেছে। শুক্রবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, উরি, রাজৌরি সেক্টর লক্ষ্য করে পাক বাহিনী ব্যাপক মাত্রায় গোলাগুলি চালাচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment