পুলিশ ও প্রশাসনের আসল রোগ আড়াল করতে এবং আর জি করের ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবি থেকে নজর ঘোরাতে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় নতুন আইনের নামে তামাশা করেছেন। বুধবার সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই অভিযোগ করে বলেছেন, ন্যায়বিচারের দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায়, জুনিয়র ডাক্তাররা রোগ নির্ধারণ করে কলকাতা পুলিশকে শিড়দাঁড়া দিয়ে এসেছে, আর মুখ্যমন্ত্রী নজর ঘোরাতে বিধানসভায় ফাঁসির আইন তৈরির নামে তামাশা করছেন! বিজেপি তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিলকে সমর্থন করছে!
ন্যায়বিচার পেতে বিভ্রান্ত না হয়ে রাস্তায় থাকার আহবান জানিয়ে সেলিম বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের শুনানির দিকে আমাদের নজর রয়েছে, শেষপর্যন্ত ন্যায়বিচার আদায় না করে কেউ রাস্তা ছাড়বেন না। সিবিআই যে দায়িত্ব পেয়েছে মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল থেকে সেকাজ তাদের দ্রুত করে দেখাতে হবে। সেদিকেও মানুষের নজর থাকবে।
সেলিম বলেছেন, মমতা-অভিষেক শুরু থেকেই একজন শিখন্ডি বেছে নিয়ে একস্ট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের কথা বলেছেন। কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা হয় না। সবাই যখন বিচার চাই বলছে, মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় আইন করে ফাঁসির নামে তামাশা করেছেন। আইন তৈরি হয় আগামী অপরাধ নিবারণের জন্য, পুর্ববর্তী অপরাধের শাস্তির জন্য নয়। এই আইনে আর জি করে ধর্ষণ করে খুনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারে কী সুবিধা হবে? কেন্দ্রের আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে, রাষ্ট্রপতি অনুমোদন না দিলে এই আইনের কী হবে? এসব গ্যালারি শো করে সরকারি তহবিলের কোটি কোটি টাকা খরচ করে পোষা আইনজীবীদের ফি দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেবেন, আর বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে? তা হবে না। আমরা সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে আছি, সিবিআই যে দায়িত্ব পেয়েছে মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল থেকে সেকাজ তাদের দ্রুত করে দেখাতে হবে।
বিজেপি বিধানসভায় আনা মুখ্যমন্ত্রীর বিলকে সমর্থন করেছে। এই প্রসঙ্গে সেলিম বলেছেন, এতই যদি সমর্থন তাহলে ওরা কিছুদিন আগে বিএনএস আনার সময়ে সংসদে এই পরিবর্তনটা করেনি কেন? এখন এই তৃণমূল বনাম বিজেপি, নবান্ন বনাম রাজভবন, এই সব বিতর্ক দেখিয়ে মানুষের ন্যায়বিচারের দাবিকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।
মুখ্যমন্ত্রীর ফাঁসির আইনী দাবির অসারত্ব সম্পর্কে সেলিম বলেছেন, এমনকি ধর্ষণেও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড আগেই ছিল, তবে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ধর্ষণের ক্ষেত্রে ছিল। এখানে সেটা তুলে সব ক্ষেত্রেই একাকার করে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণ ও খুনের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডই ছিল। এখন সেটাকেই একমাত্র করা হলো। অর্থাৎ বিচারকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো পরিসর রাখা হলো না। মুখ্যমন্ত্রীর আইন তৈরি নিয়ে সদিচ্ছা থাকলে নির্ভয়া ঘটনার পরে ভার্মা কমিশন যেভাবে আইন তৈরি করেছিল সেভাবে আইনজ্ঞদের মতামত নিতে পারতেন। এক্ষেত্রে বিধানসভায় কোনো সংসদীয় পদ্ধতি না মেনে ল্য ফার্ম কে দিয়ে বিল তৈরি করিয়ে পাস করানো হয়েছে।
আসল সমস্যা আইনে নেই, আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাতে আছে বলেই কামদুনি থেকে আর জি কর বারবার ঘৃণ্য ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, সমস্যাটা পুলিশ প্রশাসনের। মুখ্যমন্ত্রী এটাকে বিধানসভায় আইনের বিষয় করে তুললেন। তালেবরদের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে, পুলিশী ব্যবস্থা ধংস করা হয়েছে। তার থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য আইন দেখাচ্ছে। জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন করে কমিশনারকে শিড়দাঁড়া দিয়ে এসেছে সঠিক রোগ নির্ধারণ করেছেন বলেই, আমরা তাদের কুর্নিশ জানাই। প্রথম থেকে কলকাতা পুলিশ বিচারের প্রক্রিয়াকে ব্যহত করেছে। কলকাতা পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাট করেছে গোড়া থেকে। প্রথম দিন তৃণমূলের নেতারা পুলিশের মদতে লাশ দ্রুত হাইজ্যাক করে পুড়িয়েছে। হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে যারা ভাঙচুর করেছে তাদের না ধরে প্রতিবাদীদের দোষারোপ করানো হয়েছে পুলিশকে দিয়ে। তৃণমূল নেতা অভীক দে‘র পরিচয় নিয়ে কমিশনারের নির্দেশে মিথ্যাচার করেছেন ডিসি সেন্ট্রাল। বিনীত গোয়েল কমিশনার পদে থাকার যোগ্য নন, তাঁকে সরতেই হবে। পুলিশের কোনো নৈতিক জোর থাকবে না উনি কমিশনার থাকলে। তিনি যতদিন থাকবেন বিক্ষোভ লালবাজারে আছড়ে পড়বে।
ফাঁসি দেওয়া নয়, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দোষীদের সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রেই মমতা ব্যানার্জির সরকারের আসল ব্যর্থতাকে তথ্য দিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার সর্বনিম্ন। কারণ পুলিশের তদন্তের পেশাদারীত্ব নষ্ট হয়েছে। খুনের ঘটনাস্থলে পুলিশ কুকুর না পাঠিয়ে তৃণমূলপন্থী অফিসার আর উত্তরবঙ্গ লবির ডাক্তারদের পাঠালে তদন্ত হবে কী করে? ওঁরা তো প্রমাণ লোপাট করেছেন।
সেলিম বলেন, ২০২২ সালে দেশে ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তদের সাজাপ্রাপ্তির ঘটনা ২৭.৪ শতাংশ, আর পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৫.৮ শতাংশ। দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১০ সালে ছিল ১৩.৭ শতাংশ। এই অপদার্থতা ঢাকার জন্যই বিধানসভা ডেকে আইনের নামে তামাশা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। থানায় পুলিশের এফআইআর লেখার লোক নেই, কোথাও কোনো পরিকাঠামো নেই। এখন কেস রেকর্ডই করা হয় না। সালিশির নামে, ভয় দেখিয়ে, টাকা দিয়ে চাপা দেওয়া হয়। নারী নির্যাতনের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশের মধ্যে চতুর্থ। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের পরেই। এনসিআরবি বলেছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে তথ্য আসে না। থানায় রিপোর্ট নেওয়া হয় না।
Comments :0