তরুণদের হারাচ্ছে কলকাতা
উচ্চশিক্ষার সুযোগ কমেছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োগ প্রায় বন্ধ করেছে। কাজের সুযোগও কমছে। তাই চাকরি, কাজের খোঁজে কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য নতুন প্রজন্ম চলে যাচ্ছে অন্যত্র। কলকাতার অনেক পরিবারেই তরুণদের দেখা মিলছে না।
শিশু শ্রমিক বাড়ছে শহরে
বন্ধ হবে জানিয়ে হাইকোর্টে যে ৮,২০৬টি স্কুলের তালিকা সরকার জমা করেছিল তার মধ্যে কলকাতার ৫৩২টা স্কুল আছে। এই স্কুলগুলো হয় কলকাতা পৌরসভার চালিত বা রাজ্য সরকারের। বামফ্রন্ট সরকারের সময় এই সব স্কুলগুলিতে গিয়ে সাধারণ গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা যে লেখা পড়া করার সুযোগ পাচ্ছিল আজ সেই সুযোগ তারা হারাচ্ছে। স্কুলে ক্লাস না হওয়ায় তারা স্কুল যাচ্ছে না ড্রপ আউট বাড়ছে। শিশু শ্রমিক বাড়ছে শহরে।
জলাশয় কোথায়?
কলকাতা কর্পোরেশন সূত্রের খবর, ২০০৫ নাগাদ কলকাতা শহরে ৭২০০টি জলাশয় ছিল। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ৩০০০-র কাছাকাছি। উত্তর অথবা দক্ষিণ, পূর্ব কিংবা পশ্চিম, কলকাতায় জলাশয় কমেছে। বিগত ১২ বছরে শুধু অন্তত পাঁচ হাজার পুকুর ভরাট হয়েছে কলকাতা জুড়ে। কলকাতার ফুসফুস বলে পরিচিত ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডে জমাভূমি বোজানো হয়েছে নির্বিচারে। হয়েছে অবৈধ নির্মাণ। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে তৃণমূল আমলেই কয়েক বছরে যথেচ্ছভাবে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই যুক্ত আছেন শাসক দলের লোকজন। ১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাভূমি বিশ্বে কোথাও নেই। সেই জলাভূমির প্রায় ৪০ শতাংশ বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণ সেরে ফেলা হয়েছে। থানায় অভিযোগ জানানো হলেও পুলিশ কোনও ভূমিকা পালন করেনি।
সিন্ডিকেটের রাজত্ব, বেআইনি বাড়ির তাসের দেশ
গার্ডেনরিচে সম্প্রতি বেআইনি বাড়ি ভেঙে ১২জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এই ঘটনা নমুনা মাত্র। যাদবপুরের বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি উপনগরী থেকে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার, কিংবা বড়বাজার থেকে বেহালা, ঠাকুরপুকুর— তৃণমূলের শাসনে কলকাতার প্রতিটি ওয়ার্ডে বেআইনি বাড়ি বানানো হয়েছে। তৃণমূল, বিজেপি’র কাউন্সিলর, বিধায়ক, সাংসদ, প্রোমোটার, জমির দালালরা জড়িয়ে আছেন অক্টোপাসের মতো এক সিন্ডিকেটে। স্কোয়ার ফুটের হিসাব যেখানে সব। কলকাতা বিপন্ন হচ্ছে এই লুটের সাম্রাজ্যে।
অবৈধ নির্মাণের পাশাপাশি সবুজ ধ্বংস
সমগ্র কলকাতা দক্ষিণ জুড়ে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে, পার্কগুলোর অবস্থা শোচনীয়, মাঠ ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে অট্টালিকা।
ঊর্দু স্কুল, কোথায়?
রাজাবাজারে ঊর্দু স্কুল হবে, ঘোষণা করেছিলেন তৃণমূলের নেতা, সাংসদ সুদীপ ব্যানার্জি। কোথায় সেই স্কুল? হয়নি।
গণপরিবহণ বিপর্যস্ত
বন্ধ হয়েছে একের পর এক সরকারি বাস রুট, বেসরকারি বাস পরিষেবাও বিপর্যস্ত, সর্বত্র অটোর কাটা রুটের রমরমা। ট্যাক্সি নেই বললেই চলে রাস্তায়। পাওয়া গেলেও কোনও নির্দিষ্ট ভাড়া নেই। উবের সহ অন্যান্য অ্যাপেও ভাড়া বেশি। এখনো সম্পূর্ণ হলো না বেহালার মেট্রো পরিষেবা। নাজেহাল অবস্থা সাধারণ মানুষের। একটু বৃষ্টি হলে, বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিনগুলোতে আরও অসহায় হয়ে পড়ে কলকাতা দক্ষিণের সমস্ত মানুষই।
বস্তি অঞ্চলগুলোর দুরবস্থা
বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের বস্তিবাসীর জন্য যে প্রজাস্বত্ব আইন চালু করেছিল তা সংশোধন করে লঘু করেছে তৃণমূল সরকার। তাদের একের পর এক প্রজন্মের বস্তিতে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বস্তির ঠিকা জমিতে প্রোমোটিংয়ের রাস্তা খুলে দিয়েছে সরকার। তাদের মাথার ওপরের ছাদে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় বস্তি উন্নয়নের জন্য কর্পোরেশন মিউনিসিপালিটিগুলোয় একটা অর্থ বরাদ্দ থাকতো। সেই টাকা থেকে বাথরুম তৈরি, আলো লাগানোর কাজ করা হতো। এখন তা হয় না। পৌর পরিষেবা থেকে বস্তিবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পানীয় জল সরবরাহের জন্য নতুন করে কোনও জল কল তৈরি করা হয়নি। যা ছিল তাই আছে। উলটে টাকা নিয়ে বস্তিবাসীদের বাড়িতে জলের লাইন ঢোকানো হচ্ছে। জলের লাইন নিয়ে দুর্নীতি চলছে।
২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার হাইকোর্টে মামলা করেছিল কলকাতার গরিব মানুষের কম পয়সায় বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য, সেই জন্য তারা সিইএসসি-কে ১২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় যাতে গরিব মানুষদের বিদ্যুৎ এর ক্ষেত্রে ভরতুকি দেওয়া হয়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর মমতা ব্যানার্জি সেই ভরতুকি তুলে দেয়। এরপর রাজ্য সরকার ‘হাসি খুশি’ নামে একটা আইন বিধানসভায় পাশ করে যেখানে বলা হয় ২৫ ইউনিট পর্যন্ত কোনও বিদ্যুৎতের খরচ দিতে হবে না। এর ফলে কিন্তু গরিব মানুষের কোনও লাভ হয়নি।
স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয়
বন্ধ সবক'টি কর্পোরেশন স্কুল, সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলের পরিকাঠামো বিপর্যস্ত, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, সেই সুযোগে বেসরকারি স্কুলের রমরমা, বেতন কাঠামোয় নেই কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ, প্রতিবছরই লাগামহীন বাড়ে স্কুল ফি।
কলেজগুলো বাস্তবিকেই এখন তৃণমূলের পার্টি অফিস। ছাত্র ভর্তির সময় থেকে চলে টাকার খেলা। কোনও নির্বাচিত গভর্নিং বডি নেই। শিক্ষক শিক্ষিকাদের কথা বলবার কোনও পরিসর নেই। এলাকার কাউন্সিলর, বিধায়করাই নিয়ন্ত্রণ করেন কলেজ। হেলথ সেন্টারগুলোতে নেই ন্যূনতম পরিষেবা। চিকিৎসক নেই বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া প্রায় মহামারীর চেহারা নেয় প্রতিবছর। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পান না অধিকাংশ মানুষই। বেসরকারি ক্ষেত্রের রমরমা। যেকোনও সাধারণ অসুখেও ৬/৭ লাখ খরচ করতে হয় চিকিৎসার জন্য।
কুমোরটুলির ক্ষতি
যাত্রা শিল্প বাঁচাতে ফণিভূষণ অ্যাকাদেমি তৈরি করা হয়েছিল। একইভাবে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে মৃৎ শিল্পকে রক্ষা ও বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতেই আধুনিক কুমোরটুলি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। উন্নয়ন হলে বিশ্ববাসীর কাছে আজ অন্য চেহারা নিত কুমোরটুলি। কিন্তু তৃণমূল নেতা সুদীপ ব্যানার্জির মদত পেয়ে তৃণমূলীরা ‘কুমোরটুলি বাঁচাও’ কমিটি গড়ে সেই সম্ভাবনা আটকে দিয়েছিল।
Comments :0