Delhi Blast

হাসপাতাল যেন কেল্লা, আগলে রাখা হয়েছে

জাতীয়

ময়ূখ মুখার্জি: নয়াদিল্লি 

বন্ধু ট্রাম্পকে মোদী স্বাগত জানিয়েছিলেন গরিব মহল্লা সবুজ কাপড়ে মুড়ে। এবার তিনি ‘শান্তির দূত’। লাল কেল্লা লাগোয়া বিস্ফোরণ স্থল ঢেকে ফেলা হয়েছে সদা চাদরে। কে করলো, কারা করলো এসব প্রশ্ন যত চড়া হচ্ছে তত তৎপরতা বাড়ছে বিস্ফোরণের ক্ষত ঢাকতে। দেখে মনে হচ্ছে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগানটাকেই বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ। ‘মোদী থাকলে একটাও বিস্ফোরণ হয় না’ জুমলা যে কাল ফেঁসে গিয়েছে লালাকেল্লার কাছের এই বিস্ফোরণে। এখন তো লোকে বলতে শুরু করেছে, মোদীও পারে না ঠেকাতে! পুলওয়ামা, পহেলগাঁও তো এখন ভুলতে পারেনি দেশ। বিস্ফোরণ স্থল ঢেকে ফেলার মতো এলএনজেপি হাসপাতালকে গতরাত থেকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে দুর্গে। মাছি গলতে পারছে না নিরাপত্তার কড়াকড়িতে। সেই নিরাপত্তা গলেই প্রিয় মানুষটির খোঁজে হাহাকার শোনা যাচ্ছে বহু মানুষের। আজ সকাল থেকেই এলএনজেপি হাসপাতালের সামনে হৃদয়বিদারক দৃশ্য— কেউ নিজের প্রিয়জনের দেহ চিনতে পেরে ভেঙে পড়েছেন, কেউ আবার নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরছেন হাসপাতালের গেটের বাইরে।
উত্তর প্রদেশের সামলির নওমান আনসারি দিল্লিতে এসেছিলেন নিজের প্রসাধন সামগ্রীর দোকানের জন্য নতুন পণ্য কিনতে। বিস্ফোরণেই মৃত্যু। ওঁর চাচা ফুরকান জানালেন, “নওমান ঘটনাস্থলেই মারা গেছে, আর তার চাচাতো ভাই আমন গুরুতর জখম।”
বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে ছিলেন নওমান নামে বছর আঠারো এক যুবক। মঙ্গলবার সকালে তাঁর পরিবার মরদেহ শনাক্ত করার পর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ে। সাদা কাপড়ে মোড়ানো নোমানের দেহ যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো, ওঁর বন্ধুরা নীরবে তাকে অনুসরণ করে পা বাড়ালেন। বন্ধু সোনু বলেন, “আমি ওকে ওই অবস্থায় দেখতে পারব না।”
মঙ্গলবার সকাল থেকেই এলএনজেপি হাসপাতালের সামনে হৃদয়বিদারক দৃশ্য— কেউ নিজের প্রিয়জনের দেহ চিনতে পেরে ভেঙে পড়েছেন, কেউ আবার নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরছেন হাসপাতালের গেটের বাইরে।
হাসপাতালের মর্গের দরজায় তখন কড়া নিরাপত্তা। প্রবেশের অনুমতি শুধুমাত্র বাছাই করা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের। অনেকেই কর্তৃপক্ষের কাছে খবরের জন্য হাতজোড় করে ঢোকার জন্য অনুনয়-অনুরোধ করে চলেছেন। আর এদিকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসা-যাওয়া করছে— চারপাশে কান্না আর শোকের আবহ।
হাসপাতালের এক কর্মী জানালেন, “রাতের দৃশ্য ছিল ভয়ংকর। যেসব দেহ এসেছে, অনেকগুলো চেনাই যায়নি— কারও শরীর ছিন্নভিন্ন, কারও অঙ্গহানি। এক দেহকে আরেকটির থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না।”
খুব সকালের দিকেই বেশিরভাগ দেহই তাঁদের পরিজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ ই-রিকশায় বসে কাঁদতে কাঁদতে অ্যাম্বুলেন্সের পিছু নিয়েছেন।
সব দেহই এলএনজেপি হাসপাতালে আনা হয়েছিল। হাসপাতালের ইমারজেন্সি ও ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড সম্পূর্ণ সিল করা হয়েছে, প্রবেশ নিষিদ্ধ। মঙ্গলবার সকালে সাধারণ রোগীদের অন্য ব্লকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীরা গেট বন্ধ করে রোগী বা তাঁদের আত্মীয়দের ঢুকতে বাধা দিচ্ছিলেন। গেট বন্ধ থাকায় রোগীদের বিকল্প পথ ব্যবহার করতে বলা হচ্ছিল।
অনীতা গুপ্তার মা হাসপাতালে ভর্তি। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “গেট বন্ধ, এখন অন্যদিক ঘুরে যেতে হবে। ভেতরে নিরাপত্তারক্ষীরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না, এমনকি রোগীর সঙ্গীদেরও নয়।”
সকালেই বছর আটষট্টির মানুষটি চলে এসেছেন এলএনজেপি হাসপাতালে। ‘ডিউটি’ দিচ্ছেন কখনও মরডগ, কখনও এমারজেন্সির বাইরে। কখনও কোনও পরিবারের হাতে জল তুলে দিচ্ছেন, বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছু খাইয়েও দিচ্ছেন। খানিক পরেই কারোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন অ্যাম্বুলেন্স জোগাড়ে। কখনও আবার আতঙ্কিত স্বজনদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেউ প্রিয়জনের দেহ শনাক্ত করে ভেঙে পড়েছেন, কেউ আবার এখনো আশায় বুক বাঁধছেন—হয়তো কেউ বেঁচে আছেন।
কুড়ি বছর আগের কথা। এখনও বছর আটষট্টির মানুষটির মনে তাজা সরোজিনী নগর বাজারে বিস্ফোরণের ভয়াবহ সেই স্মৃতি। সেই অশোক রন্ধাওয়া মঙ্গলাবার আবারও এসে দাঁড়িছেন মৃত্যু ও শোকের মুখোমুখি। এইবার লালকেল্লার কাছে হওয়া বিস্ফোরণের পর এলএনজেপি হাসপাতালে, মৃত ও আহতদের পাশে।
২০০৫ সালের ২৯ অক্টোবর সরোজিনী নগর ও গোবিন্দপুরীর ব্যস্ত বাজারে এবং একটি বাসে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন ৬২ জন, আহত হন ২০০-রও বেশি মানুষ। সেই সময় রন্ধাওয়া ছিলেন সরোজিনী নগর মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তারপর থেকেই এমন বিপর্যয়ের সময় তিনি দুর্গতদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। এসেছেন ব্যাগে টাকা ভর্তি করে। যাঁর যেমন লাগছে পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠা করছেন না।
বললেন, “জানি এই যন্ত্রণা কেমন। নিজে সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। একটা বিস্ফোরণ কীভাবে মুহূর্তে পরিবারের জীবন তছনছ করে দেয়, তা আমি জানি।” বর্তমানে তিনি একটি এনজিও চালান। তারা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে আর্থিক ও মানসিক সহায়তা দেয়।
তিনি জানালেন, মঙ্গলবার সকালেই হাসপাতালে ছুটে আসেন। “আমি এখানে আছি মানুষের জন্য। কেউ যদি কোনোভাবে সাহায্য চান — অ্যাম্বুলেন্স, খাবার, আর্থিক সহায়তা বা মানসিক সমর্থন — আমরা পাশে রয়েছি।”
রন্ধাওয়া বললেন, “সকালের মধ্যে বেশিরভাগ মৃতদেহ তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা এখনো আছি, যদি কেউ সাহায্যের প্রয়োজন মনে করেন। এরপর আমরা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ও ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে যাবো আহতদের পাশে দাঁড়াতে।”
হাসপাতালের বাইরে চারপাশে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা ও শোকের ছায়া। একের পর এক পরিবার প্রিয়জনকে শনাক্ত করছেন — কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, কেউ স্থবির।

Comments :0

Login to leave a comment