‘বামেদের লোকসভায় ভোট দিয়ে কি লাভ ! ওরাতো আর মন্ত্রী হবে না?’ এই কথাটা বাংলা জুড়ে সুপরিকল্পিতভাবে এক অংশের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস করিয়ে দিতে চায়। বামপন্থীরা সংসদে শক্তিশালী হলে কি হয় তার প্রমাণ ইউপিএ ১ সরকার। বামপন্থীরা বাইরে থেকে সমর্থন দিযে ‘ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি’ রূপায়ণ মানে সাধারণ মানুষের দাবি পূরণে বাধ্য করেছিল সরকারকে। সেই সাফল্যগুলিকে আড়াল করে বাম বিরোধী প্রচারকেই জোরালো করতে চায় মোদী-দিদি মিডিয়া। সব চেষ্টা সত্ত্বেও আজ আবার প্রতিদিন জোরালো হচ্ছে মানুষের দাবি, বামপন্থীদের আবার লোকসভায় আবার চাই।
ইউপিএ ১ সরকারের সাফল্যের দীর্ঘ তালিকায় না গিয়ে কয়েকটি আইন দেখলেই এটা পরিষ্কার হবে।
মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম (MGNREGA)
স্বাধীন ভারতে কাজের অধিকার প্রথম পেল সাংবিধানিক স্বীকৃতি। বামপন্থীদের দাবি ছিল গ্রাম-শহরের সব ইচ্ছুক আবেদনকারীকেই দিতে হবে ২০০ দিনের কাজ। অনেক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে অবশেষে গ্রামীণ এলাকায় প্রতিটি পরিবারকে একটি আর্থিক বছরে কমপক্ষে ১০০ দিনের কাজ নিশ্চিত করার প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। এর সুফল আজও পাচ্ছেন গরিব মানুষ। এখন গরিব মানুষের প্রকল্পের এই অর্থ লুটছে রাজ্যে তৃণমূল আর এই প্রকল্প তুলে দিতে চাইছে মোদী সরকার।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন শুরু হয়েছিল ১২ এপ্রিল, ২০০৫। গ্রামীণ জনসংখ্যা, বিশেষ করে দুর্বল গোষ্ঠীগুলির জন্য ন্যায়সঙ্গত, স্বল্প মূল্যে উচ্চমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবার জন্য। এই মিশনের অধীনে অনেকগুলি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল, যা গ্রামীণ ভারতের স্বাস্থ্য পরিসেবার ধারাকেই অনেকাংশে বদলে দিয়েছে। যেমন - জননী সুরক্ষা যোজনা, জাতীয় মোবাইল মেডিকেল ইউনিট, জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা, জননী শিশু সুরক্ষা কর্মসূচি, রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি, বিনামূল্যে ওষুধ এবং বিনামূল্যে ডায়াগনস্টিক পরিষেবা দান, জেলা হাসপাতাল এবং জ্ঞান কেন্দ্র, গর্ভবতী মা’দের জন্য আয়রন ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি, রোগীদের সুবিধার্থে রোগী কল্যাণ সমিতি গঠন ইত্যাদি। এর ফলে শিশু মৃত্যুর হার নেমে আসে, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা উন্নত হয়।
ইউপিএ ১ সরকারের এই পরিকল্পনাগুলি জাতিসঙ্ঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে রাজ্য-কেন্দ্র দুই সরকারই। ফল – চিকিৎসা এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
খাদ্য নিরাপত্তা আইন
সব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছিল। এই আইন অনুযায়ী ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্য দেবার ফলে (গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭৫% এবং শহুরে জনসংখ্যার ৫০% পর্যন্ত) মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উপকৃত হয়।
এই আইনের অধীনে, ‘অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা' (AAY) প্রকল্পটি দরিদ্রতম গোষ্ঠীর মানুষদের সাহায্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই গোষ্ঠীর মানুষ প্রতি মাসে মাথাপিছু ৭ কেজি ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্য অর্থাৎ পরিবার পিছু মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য পায়। সাধারণ পরিবার কমপক্ষে মাথাপিছু ৩ কেজি চাল/গম প্রতি মাসে পায়। এই প্রকল্পে গ্রামীণ জনসংখ্যার কমপক্ষে ৪৬% এবং শহুরে জনসংখ্যার ২৮% অর্থাৎ জনসংখ্যার ৭৪% পরিবার খাদ্যের নিশ্চয়তা পেয়েছিল। বাকিদের সাধারণ পরিবার হিসাবে মনোনীত করা হয়, যারা ন্যায্য মূল্যে চাল-গম ইত্যাদি পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। এই আইনে গর্ভবতী মহিলা এবং স্তন্যদানকারী মায়েরা ৬০০০ টাকা মুল্যের খাবার এবং মাতৃত্বকালীন অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হয়েছিলেন৷ পরিবারের বয়স্ক মহিলারা রেশন কার্ড দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল যে তাঁরাই পরিবারের প্রধান হবে ন।
বামপন্থীদের দাবি মেনে ইউপিএ ১ এর আমলে তৈরি এই আইন নিয়ে, মোদী এখন ৮০ কোটি মানুষকে এই সুবিধা দেওয়ার ‘মোদী গ্যারান্টি’ ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন করছেন। অথচ এখন ৭৪% পরিবারের বদলে মোদী গ্যারান্টিতে মাত্র ৫৭% পরিবার এই সুবিধা পাচ্ছে।
তথ্যের অধিকার আইন
২০০৫ সালে ভারতে এই ঐতিহাসিক আইনটি তৈরি হয়। যে কোনও ভারতীয় নাগরিক রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস ও বিভাগ থেকে যে কোনও তথ্য চাইতে পারেন এই আইন অনু্যায়ী। সরকার বাধ্য থাকবে সব জানাতে। এই আইনের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ভারত তৈরি করা। এখন মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ‘তোলাবাজী প্রকল্প’ সহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের এবং অর্থনৈতিক প্রকৃত তথ্য গোপন রাখার জন্য মরিয়া। এটাই তফাৎ।
শিক্ষার অধিকার আইন
শিশুদের বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন। স্বাধীন ভারবর্ষের শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বামপন্থীদের সমর্থনে তৈরি যুক্তফ্রন্টের সরকার ১৯৯৮ সালে প্রথম এই আইনের খসড়া তৈরি করে, দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। ভারতীয় সংবিধানের ২১ (ক) অনুচ্ছেদের অধীনে এই আইন অনুযায়ী ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সর্বজনীন শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ অর্থাৎ তফসিলি জাতি ও উপজাতি, সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণি, ভিন্নভাবে সক্ষম অংশের জন্য জন্য ২৫% সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক এই আইন অনুযায়ী।
এখন মোদী সরকার প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তুলে দিতে চাইছে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে। সরকার বা রাষ্ট্র শিক্ষার আর কোনও দায়িত্বই নেবে না। মোদী সরকারের নীতি – অর্থ যার শিক্ষা তার।
অরণ্যের অধিকার আইন
২০০৬ সালের জঙ্গলে বসবাসকারী সম্প্রদায় এবং উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর (তফসিলি উপজাতি) অধিকারের আইন (যারা জমি এবং অন্যান্য বন সম্পদের উপর বাস করে) তৈরি হয়েছিল বামপন্থীদের আন্দোলন ও তাদের ওপর নির্ভরশীল সরকার থাকার জন্যই। ব্রিটিশ আমল থেকেই থেকেই কয়েক শতক ধরে এদের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। এই আইন তাঁদের অরণ্যে বসবাস ও জমির অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন মোদী সরকার জঙ্গল-পাহাড় সব এদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দিচ্ছে।
সেই সরকারের সাফল্য সাধারণ হিসাবে তিনটে মাপকাঠিতে দেখলেই পরিষ্কার ছবিটা সামনে আসবে।
১) দারিদ্রসীমার নিচের জনসংখ্যার শতাংশ ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৯-১০ সময়কালে প্রতি বছর ১.৫% পয়েন্ট (ppt) হারে হ্রাস পেয়েছিল। ২) বেকারত্বের হার ২০০৪-০৫ সালে ৮.২ % থেকে ২০০৯-১০ সালে ৬.৬% এ নেমে আসে। ৩) আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের চড়া দাম থাকা সত্ত্বেও পেট্রল, ডিজেল, গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামহীন হতে দেয়নি।
তথাৎ প্রকট (এই সাবহেডিং ঠিক নেই)
প্রথম ইউপিএ-১ সরকারের এই সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়েই মানুষের ভরসা তৈরি হলো, এল ইউপিএ ২ সরকার। শুধু বদলে গেল সহযোগী দলের বিন্যাস। বামপন্থীদের জায়গা নিলো তৃণমূল। প্রায় হাফ ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন। কি লাভ হয়েছিল? গোটা বাংলা জুড়ে মিথ্যে প্রকল্পের শিলাবৃষ্টি আর দুর্নীতির রমরমা শুরু হলো, কিন্তু প্রকল্প হলো না। একের পর এক ব্যর্থতা, দুর্নীতি, মানুষের জীবনজীবিকার সঙ্কট, মানুষকে সরকার বিরোধী করে তুললো। বামপন্থীদের নজরদারি কতটা জরুরি ছিল সারা দেশের মানুষ দেখলো। শুধু পুঁজির দালালরা সযত্নে তাকে আড়াল করে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার করলো, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে। সেই সুযোগে নতুন স্বপ্নের ফেরি করতে হাজির হলেন মোদী আর তার দল।
Comments :0