অনিন্দ্য হাজরা
পদ্মফুল আর ঘাসফুল, দুই প্রতীক নিয়ে বাজারে ভোট চাইতে নেমেছেন যথাক্রমে বিজেপি এবং তৃণমূলের প্রার্থীরা। কিন্তু তাঁরা কে কোন দলের, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবেন কী? গতকাল যারা ওদিকে ছিলেন তাঁরা এবার এদিকে, আর এদিকের অনেকেই এখন ওদিকে। আগামীকাল কে ঢলবেন কোন ফুলে, কে বলতে পারে!
লোকসভা নির্বাচনের মুখে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না অঞ্চলের এক রাজনৈতিক আড্ডার আসরে বোমা ফাটিয়েছেন তৃণমূলের এক নেতা। আঞ্চলিক স্তরের সেই নেতার বক্তব্য ছিল, ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা সিপিআই(এম)'কে প্ল্যান করে পিটিয়েছিলাম। মানুষ দেখছে সিপিআই(এম) পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। আর সেই মার খাওয়ার খবর বিজেপি আরএসএস প্রচার করে বলল, সিপিআই(এম)’কে ভোট দিয়ে কি হবে? ওদের ভোট দেওয়া মানেই তো মার খাওয়া। ওদের থোড়াই ক্ষমতা আছে তৃণমূলকে রোখার। তৃণমূল আর বিজেপি’র মধ্যে ভোটের মেরুকরণে সুবিধা হয়েছে এরফলে।
২০১৮ সাল মানে এখনকার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তখন ঘোর তৃণমূলী। পূর্ব মেদিনীপুর তাঁর খাস তালুক। সেখানেই বিজেপি আরএসএস’র সঙ্গে বোঝাপড়া করে সিপিআই(এম) পেটানো কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, যাতে গ্রামে গ্রামে ফিসফাস বাড়ানো যায়, সিপিআই(এম)’কে দিয়ে হবে না। তৃণমূলকে আটকাতে পারে একমাত্র বিজেপি।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদী খাড়া করেছিলেন দুই হাতে লাড্ডুর তত্ত্ব। রাজ্যে দিদি থাক। কেন্দ্রে আপনারা আমাকে ভোট দিন। বামপন্থীরা তখন থেকেই প্রচার শুরু করেন, তৃণমূল এবং বিজেপি’র মধ্যে গোপন বোঝাপড়া রয়েছে। সেই বোঝাপড়া তীব্র হয়ে ওঠে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে। ২০১৭ সালে তৃণমূলের অন্যতম প্রধান ভোট ম্যানেজার মুকুল রায় বিজেপিতে যোগ দেন। খুলে যায় ফ্লাড গেট। তার হাত ধরে একের পর এক তৃণমূলের নেতা, বিভিন্ন স্তরের, গিয়ে হাজির হতে শুরু হয় বিজেপিতে।
২০১৭ সালে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া মুকুল রায়, ২০২১ সালে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে বিজেপি’র টিকিট জয়ী হন। বর্তমানে তিনি তৃণমূলে। ২০২৪ সালের তৃণমূল এবং বিজেপি’র প্রার্থী তালিকার দিকে তাকালে এমন তৃণমূল থেকে বিজেপি কিংবা বিজেপি থেকে তৃণমূল ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা প্রার্থীর সংখ্যা তাক লাগানোর মতো। তৃণমূল নাকি বিজেপি কোন দলে আছেন? মুকুল রায়কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করায় তিনিই বলেছিলেন, ‘যা তৃণমূল তাই বিজেপি।’ মুকুল রায়ের সেই বিখ্যাত মন্তব্যকে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার প্রতিফলন বলে দাবি করেছিলেন তৃণমূল এবং বিজেপি নেতারা। কিন্তু এখন লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি’র প্রার্থী তালিকার দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে, মুকুল রায়ের মন্তব্যই সঠিক ছিল। শারীরিক অসুস্থতা নয়, দুই দলের সৃষ্টি করা অসুস্থ রাজনীতিই প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের প্রার্থী তালিকায়। যারা জনগণের একাংশকে আরেক অংশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছে, একদলের হয়ে অপর দলকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে, তারাই নিজেদের দল পরিবর্তন করে, তৃণমূল থেকে বিজেপি’তে অথবা বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এই প্রতারকরা এবারও ভোট চাইতে নেমেছেন। এবারও একদলের হয়ে অপর দলের বিরুদ্ধে গলার শিরা ফুলিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু জনগণ কি এবারও প্রতারিত হতে রাজি আছেন?
উত্তরবঙ্গ দিয়ে শুরু করা যাক। কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। দিনহাটার তৃণমূল নেতা উদয়ন গুহ'র এককালের ডানহাত। সীমান্তবর্তী দিনহাটার চোরা চালানোর ভাগ কার হাতে থাকবে, এই নিয়ে গুরু শিষ্যের বিবাদ হয়। ২০১৯'র নির্বাচনের ঠিক আগে নিশীথ যোগ দেন বিজেপিতে। ভোটে জেতার পরে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, শ্লীলতাহানি ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্তকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করে বিজেপি।
চলতি নির্বাচনে রায়গঞ্জে বিজেপি প্রার্থী করেছে কার্তিকচন্দ্র পালকে। কালিয়াগঞ্জ পৌরসভার তৃণমূলী চেয়ারম্যান কার্তিক পাল ২০২০ সালে বিজেপি’র ঝান্ডা হাতে নেন। মজার কথা, কার্তিকের টিকিট প্রাপ্তির পিছনে শুভেন্দু অধিকারীর হাত রয়েছে বলে শোনা যায়। তৃণমূল ত্যাগী শুভেন্দুর হাতযশেই রায়গঞ্জের বর্তমান সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরিকে সুদূর দক্ষিণ কলকাতায় পাঠানো হয়েছে।
রায়গঞ্জের তৃণমূল প্রার্থীও রত্নবিশেষ। তিনি কৃষ্ণ কল্যাণী। ২০২১ সালে রায়গঞ্জ কেন্দ্রে বিজেপি টিকিটে জয়ী বিধায়ক। বিধায়ক পদে ইস্তফা না দিয়েই তিনি তৃণমূলে ঢুকেছেন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি সরকারি খাতায় বিজেপি’র বিধায়ক হয়েও তৃণমূলের নেতা হয়ে কাটিয়েছেন। ২০১৬ পরবর্তী কংগ্রেস নেতা মানুষ ভুঁইয়াকে যেই কায়দায় ভাঙিয়েছিল তৃণমূল, একই কায়দায় কৃষ্ণ কল্যাণীকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারপার্সন বানিয়েছিল। পিএসি’র চেয়ারম্যান পদে বিরোধীদের বসানোই রীতি, কারণ পিএসি সরকারের অ্যাকাউন্টস পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়ে থাকে, সরকারপক্ষের দ্বারা সেটা প্রভাবিত না হওয়াই উচিত। কৃষ্ণ কল্যাণীকে পিএসি চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি ছিল, ঐ পদে তো বিরোধীদের একজনকেই বসানো হয়েছে। এর আগে মুকুল রায়কে ঐ পদে বসিয়েও অধ্যক্ষ একই দাবি করেছিলেন। কিন্তু এই পদাধিকারীরা দল বদলে তার আগেই সরকারপক্ষে যোগ দিয়ে দিয়েছেন।
রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক চিকিৎসক মুকুটমণি অধিকারী এবার তৃণমূলের টিকিটের রানাঘাট লোকসভার প্রার্থী। তিনি ২ মার্চ আরামবাগে নরেন্দ্র মোদির সভায়, মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। সেই সভার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি তৃণমূলের যোগ দেন এবং টিকিট হাতিয়ে নেন। বিজেপি’র ভিতরের খবর, ২০১৯ সালের নির্বাচনে রানাঘাট কেন্দ্রে মুকুটমণিকে প্রার্থী করতে চেয়েছিল দল। কিন্তু চিকিৎসক মুকুটমণিকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দেয়নি রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর। পরবর্তীতে ছাড়পত্র মিললেও, রানাঘাট কেন্দ্রে বিজেপি ফের প্রার্থী করেছে গতবারের জয়ী জগন্নাথ সরকারকেই। জল্পনা, সেই ক্ষোভেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলের মুকুট মাথায় পড়েছেন মুকুটমণি।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পাঁচটি কেন্দ্রের মধ্যে দুটি কেন্দ্রে এমন দল বদলুদের প্রার্থী করা হয়েছে। তালিকার প্রথমেই আসে ব্যারাকপুর। প্রার্থী অর্জুন সিং। রাজ্য রাজনীতির আয়ারাম গয়ারামদের তালিকার একদম প্রথমেই আসবে তাঁর নাম। ২০১৯ সালের মার্চে বিজেপিতে যোগ দেন ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মেলে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের টিকিট। বিজেপি সাংসদ অর্জুন ২০২২ সালের ২২ মে ফেরত আসেন তৃণমূলে। চলতি বছরের ১৫ মার্চ তিনি ফের বিজেপিতে ফিরে যান, কারণ তৃণমূল তার বদলে ব্যারাকপুরের টিকিট দেয় পার্থ ভৌমিককে। অথচ এই অর্জুন সিং তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার দিন পর্যন্ত আশায় ছিলেন যে তিনি টিকিট পাবেন এবং সেই কারণে তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশেও হাজির ছিলেন। ব্রিগেড থেকে ফিরেই তিনি বিজেপি’র সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং বিজেপি তাকে সাদরে গ্রহণ করে ফিরিয়ে নিল, টিকিটও দিল লোকসভা নির্বাচনে।
অর্জুন সিং বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য রোজনামচা হয়ে দাঁড়ায়। একের পরে খুন, বোমাবাজি, পুলিশি ধরপাকড় এবং বেশ কিছু পুলিশি এনকাউন্টার ব্যারাকপুরকে শিরোনামে নিয়ে আসে। ধুলোয় মেশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা। মিশ্র সংস্কৃতির ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল তৃণমূল বিজেপির তান্ডবের ফলে চিহ্নিত হয় সাম্প্রদায়িক হানাহানির অন্যতম ভরকেন্দ্র হিসাবে। বারাকপুরে অর্জুন সিংয়ের নেতৃত্বে এই অস্থিরতার রাজনীতিকে ব্যবহার করে মমতা ব্যানার্জি বাঙালি –অবাঙালি বিরোধ জাগিয়েছেন, আর বিজেপি হিন্দু মুসলিম বিরোধ জাগিয়েছে। বহু মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের বোকা বানিয়ে অর্জুন সিংকে কখনো তৃণমূল কোলে টেনেছে, আবার কখনো বিজেপি কোলে টেনে নিয়েছে।
দমদম লোকসভার বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্ত। আগে ছিলেন ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক। ২০২০ সালে মুকুল রায়ের হাত ধরে তাঁর বিজেপিতে আগমন ঘটে। বিধায়ক পদে ইস্তফা না দিয়েই দল বদলান দত্ত। দল বদলালেও সেবার ব্যারাকপুরে বিজেপির টিকিট পাননি তিনি। খুন হওয়া বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লার বাবাকে ব্যারাকপুরে দাঁড় করিয়েছিল বিজেপি। প্রসঙ্গত, ব্যারাকপুরের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার সবথেকে বড় উদাহরণ বিজেপি নেতা মনীশ শুক্লা হত্যাকাণ্ড।
কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে বরানগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়কে। এই কেন্দ্রের বর্তমান তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি কাউকে কাজই করতে দেন না, এই অজুহাতে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন অভিষেক ব্যানার্জি ঘনিষ্ঠ তাপস রায়। তাপস রায়কে দলে ধরে রাখতে না পারার আক্ষেপ ঝরে পড়েছে তৃণমূলের প্রাক্তন মুখপাত্র কুণাল ঘোষের গলাতেও। তৃণমূলে অভিষেক ঘনিষ্ঠ অন্যতম চরিত্র হলেন সারদা কান্ড খ্যাত কুণাল ঘোষ। দলীয় মুখপত্রের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কুণালের আক্ষেপ, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে মধ্য কলকাতার সজল ঘোষকে দলে ধরে রাখা যায়নি। তিনি বর্তমানে কলকাতা কর্পোরেশনের বিজেপি কাউন্সিলর। বরানগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করেছে।
এতদিন বিধানসভায় মমতা ব্যানার্জির হয়ে গলা ফাটানো তাপস রায় দলত্যাগ করেই বলেছেন, ‘দলে এত দুর্নীতি, সন্দেশখালিকাণ্ড, আমাকে এত অপমান, অসম্মান, অবহেলা, এই তৃণমূলে থাকা যায় না। বেশ কিছু দিন ধরে আমি দলের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছি।’ কবে থেকে তাপস রায়ের ‘বোধোদয়’? তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার বাড়িতে গত ১২ জানুয়ারি ইডি এসেছিল। কিন্তু দল আমার পাশে দাঁড়ায়নি। ৫২ দিন পেরিয়ে গেল মমতা ব্যানার্জি সহ কেউ একটা ফোনও করেনি। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যখন ভাষণ দিলেন, তিনি সন্দেশখালির শাহজাহানের কথা বললেন। কিন্তু আমার কথা উল্লেখ করলেন না। আমি আশা করেছিলাম উনি আমার বাড়িতে ইডি অভিযানের কথা এক বার হলেও বলবেন। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনেছি, আমার বাড়িতে ইডির অভিযানের নেপথ্যে দলেরই কেউ কেউ রয়েছে।’ তাপস রায়ের অনুগামীদের বক্তব্য, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ই ইডি’কে তাপস রায়ের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়েছেন। এই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মমতা ব্যানার্জি দায়িত্ব দিয়েছেন বিজেপি’র সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ রেখে লোকসভায় বিজেপি’কে সহায়তা করার জন্য। দলের অনেকের কাছ থেকেই তাপস রায় নাকি একথা জানতে পেরেছেন। তৃণমূল এবং বিজেপি দু’পক্ষের কাছেই সুদীপ এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই চিট ফান্ড কাণ্ডে তাঁকে গ্রেপ্তারের পরেও সুদীপ মুক্তি পেয়েছেন। অর্থাৎ চুরি দুর্নীতি বড় কথা নয়, দল প্রোটেকশন দিচ্ছে কিনা সেটাই এখন এই দলবদলু প্রার্থীদের কাছে আসল কথা।
জেলা পূর্ব মেদিনীপুর। কাঁথি থেকে বিজেপি প্রার্থী করেছে সৌমেন্দু অধিকারীকে। তিনি সম্পর্কে শুভেন্দু অধিকারীর ছোট ভাই। অধিকারী পরিবারের জমিদারি বানিয়ে ফেলা কাঁথি পৌরসভার চেয়ারপার্সন ছিলেন তিনি। ২০২১ সালে জানুয়ারিতে পৌরসভার ২১ জন কাউন্সিলর এর মধ্যে ১৪ জন তৃণমূল কাউন্সিলরকে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন সৌমেন্দু। ভাইরা বিজেপিতে গেলেও, তাঁদের বাবা তথা কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারী খাতায়-কলমে তৃণমূলেই ছিলেন। শুভেন্দু অধিকারীর মেজো ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী তৃণমূলের টিকিটের জেতা তমলুকের সাংসদ। তিনিও এতদিন ছিলেন খাতায়-কলমে তৃণমূল। চলতি বছরের মার্চ মাসে অর্জুন সিং এর সঙ্গে তিনি বিজেপিতে সরকারিভাবে যোগ দেন।
হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে চিকিৎসক রথীন চক্রবর্তীকে। তিনি ২০১৩ সাল থেকে হাওড়া কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। এই রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিলেও বঞ্চিত হচ্ছেন হাওড়ার মানুষ। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাওড়ায় পৌর নির্বাচন হয়নি।
বিষ্ণুপুরে তৃণমূল প্রার্থী করেছে সুজাতা মণ্ডলকে। তিনি ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী সৌমিত্র খাঁর প্রাক্তন স্ত্রী। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে কলকাতা হাইকোর্ট সৌমিত্র খাঁকে এলাকায় ঢুকতে নিষেধ করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি চাকরিপ্রার্থীদের থেকে তোলাবাজি করেছেন। সেই সময় প্রার্থীর হয়ে প্রচার করেন সুজাতা। পরবর্তীকালে তাদের বিচ্ছেদ হয়, এবং একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়টিকে রাজনীতির আঙিনায় টেনে আনে তৃণমূল এবং বিজেপি। চলে বিস্তর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। সেই রেশ ধরে সুজাতা মণ্ডল তৃণমূলে যোগ দেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আরামবাগ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিজেপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হতে হয়। এবার পারিবারিক কেচ্ছাকে রাজনৈতিক পরিণতি দেওয়া হয়েছে রাজ্যের অন্যতম পিছিয়ে থাকা অঞ্চল বলে পরিচিত বিষ্ণুপুরে। প্রাক্তন স্বামী স্ত্রীর লড়াইয়ের মুখরোচক গল্পের আড়ালে পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াই এবং দাবি।
তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দুই শাসক দলের সংগঠনের স্তরে স্তরে রয়েছে এমন বহু ব্যক্তি, যাঁরা ঠিক কোন দল করেন, তা স্পষ্ট নয়। এই রাজনৈতিক সুবিধাবাদের সুযোগ নিয়েছে আরএসএস। স্নিপার সেলের মতো এদের ব্যবহার করা হচ্ছে সমাজে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়াতে। গলিতে গলিতে রামনবমীর উগ্র ভিড়ের আমদানি এদের দৌলতেই। ঘটনা পরম্পরা থেকেই স্পষ্ট, তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপি কিংবা বিজেপি-কে দিয়ে তৃণমূলকে ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সেকথা উঠে আসছে। তার ফলে তৃণমূল এবং বিজেপি’র উপর ক্ষুব্ধ মানুষ খুঁজছেন বিকল্প। বেছে নিচ্ছেন বাম এবং কংগ্রেস প্রার্থীদের। এই অবস্থার টিকে থাকার জন্য তৃণমূল এবং বিজেপি’র একমাত্র অস্ত্র মেরুকরণ। যদিও লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দুই দফার ভোটের হিসাব, এবং মাটি থেকে উঠে আসা রিপোর্ট অনুযায়ী মেরুকরণে টেক্কা এবার আর রাজ্যের কোনও অঞ্চলে কাজ করবে না।
Comments :0