ফ্ল্যাটের বেডরুমে, ড্রয়িং রুমে, কখনও বা খাটের তলা থেকে গত কয়েক মাসে নগদ কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ছবি দেখেছিলেন রাজ্যবাসী। সেই টাকা উদ্ধারের ছবি টুইট করে প্রকাশ করতো ইডি। এবার থরে থরে সাজানো, তবে টাকা নয়। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার বাড়ি থেকে থরে থরে সাজানো ওএমআর শিটের ছবি প্রকাশ করলো ইডি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে সাজানো সেই ওমআরশিটের ওরিজিনাল কপি!
নিয়োগ দুর্নীতি চেহারা কী তা আরও একবার স্পষ্ট করলো এই ছবি। টেটের ওএমআর শিটের পাশাপাশি রাজ্যের একাধিক পৌরসভার বিভিন্ন পদের পরীক্ষার উত্তরপত্রও রয়েছে তাতে। প্রতিটি ওএমআর শিট’ই আসল, তাতে পরীক্ষার্থীর পেনের কালির দাগও স্পষ্ট। একজন প্রোমোটারের বাড়ি থেকে উদ্ধার হচ্ছে টেটের ওএমআরশিট, পৌরসভার বিভিন্ন পদের পরীক্ষার উত্তরপত্র! ইডি’র কথায় ওপর থেকে নিচ, সর্বত্র দুর্নীতি ঘিরে ফেলেছে!
ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের বাড়ি থেকে যে নথিপত্র ও ডিজিটাল এভিডেন্স উদ্ধার হয়েছে তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ, দাবি ইডি’র। এমনকি বেশ কয়েকজন এমন প্রভাবশালী নাম, টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে অয়ন শীলের জেরা থেকেই তাতে গোটা রাজ্য স্তম্ভিত হয়ে যেতে পারে।
তদন্তের স্বাভাবিক গতিপথেই সেই প্রভাবশালী নাম এবার সামনে আসবে। ধৃত তৃণমলের হুগলী জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শান্তনু ব্যানার্জির বাজেয়াপ্ত করা দুটি আইফোন ও তাঁর বন্ধু ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের বয়ান তদন্তকে নিয়োগ দুর্নীতির একেবারে মাথায় নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করেছে বলে দাবি ইডি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কথায় নিয়োগ দুর্নীতির সোনার খনি মিলছে এক প্রোমোটারের বাড়ি থেকে, তা হলে বোঝা যাচ্ছে দুর্নীতির চেহারা কী।
তৃণমূল সরকারের আসার পরে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শান্তনু ব্যানার্জির ‘বন্ধু’ অয়ন শীলের সংস্থাকেই পৌরসভার নিয়োগের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি এজেন্সি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল সরকার। অধিকাংশ পৌরসভায় নিয়োগের বরাত পেয়েছিল ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থা এবিএস ইনফোজোন প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই জন্ম হয় এই এবিএস ইনফোজোন প্রাইভেট লিমিটেডের। এটা মূলত ডাটা প্রসেসিং সংস্থা। বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে রয়েছে দু’জন, ধৃত অয়ন শীল ও তাঁর স্ত্রী কাকলি শীল। ইন্টারভিউ নেওয়া থেকে শুরু করে ওএমআর শিট ছাপানো, নিয়োগপত্র দেওয়া পর্যন্ত সব প্রক্রিয়ার জন্য টেন্ডার পেত এই অয়ন শীলের সংস্থা।
আরো তাৎপর্যের হলো ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের অপর একটি সংস্থা এবিএস ইনফ্রাজোন প্রাইভেট লিমিটেড আবার পেতো সেই পৌরসভাগুলিতে যাবতীয় নির্মাণ কার্য থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাত।
একতরফাভাবে দক্ষিণবঙ্গের সিংহভাগ পৌরসভার যাবতীয় বড় নির্মাণের কাজের বরাত পেত অয়ন শীলেরই এই রিয়েল এস্টেট সংস্থা। এই সংস্থাটি আবার ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৈরি হয়। সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে রয়েছেন দু’জন— অয়ন শীল এবং জনৈক শমীক চৌধুরি।
ধৃত অয়ন শীলের দুটি সংস্থাই তৈরি হয়েছে তৃণমূল সরকারের আসার পরে। দুটি সংস্থারই ঠিকানা চুঁচুড়ার জগুদাস পাড়া। এক প্রোমোটারের দুটি সংস্থার মাধ্যমেই একদিকে পৌরসভায় নিয়োগ অন্যদিকে পৌরসভার কাজের যাবতীয় বরাত।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, কতটা প্রভাবশালী, কতটা ক্ষমতাবান হতে পারে তাহলে এই প্রোমোটার? নাকি আরও বড় কোনও প্রভাবশালী রয়েছে আসলে এর পিছনে? তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, ঐ দুটি সংস্থারই নামে আদ্যক্ষর আবার এ বি! যদিও অয়ন শীল কিংবা স্ত্রী, পুত্রের নামের সঙ্গে কোনও মিল নেই। ‘এ বি’ তাহলে অন্য কারো নামের ইঙ্গিত?
এদিকে নিয়োগ দুর্নীতি কান্ডে ধৃত অয়ন শীলের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শ্বেতা চক্রবর্তীর যোগসূত্র আছে বলে জানা যাচ্ছে একটি সূত্রে। নৈহাটির ৭সি বিজয়নগরের বাসিন্দা শ্বেতা চক্রবর্তী পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কামারহাটি পৌরসভায় কাজ করেন। এই ঘটনার পর থেকে শ্বেতা চক্রবর্তী বাড়িতে থাকলেও সংবাদমাধ্যমের সামনে হাজির হননি। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে শ্বেতা চক্রবর্তীর সঙ্গে অয়ন শীলের যোগাযোগ।
প্রোমোটার অয়ন শীল যে গাড়ি ব্যবহার করতেন সেই গাড়িরও শ্বেতার নামেই রেজিষ্ট্রেশন। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল এই গাড়ি কেনা হয়। এমনকি গ্রেপ্তারির আগে এই শ্বেতা চক্রবর্তীর তরফেই অয়ন শীলকে মোবাইলে জানানো হয় ইডি আসবে, পালাও। সব সরিয়ে ফেলো।
নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে ধৃত অয়ন শীলের সংস্থার ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন শ্বেতা চক্রবর্তী। তাঁর সাথে অয়নের যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিশ পাওয়া গেছে।
কামারহাটি পৌরসভার বিপরীতে জগন্নাথ নিকেতন আবাসনে একটি ফ্ল্যাট আছে অয়ন শীল ও শ্বেতা চক্রবর্তীর নামে। সেখানে প্রতিদিন যাতায়াত ছিল। পৌরসভার কাজ শেষ করে সেখানে শ্বেতা প্রতিদিন যেতেন। গত কয়েকদিন আগেও শ্বেতা ওই ফ্লাটে যান। মামা ও ভাগ্নী পরিচয় দিয়ে ফ্ল্যাটে থাকতেন।
মঙ্গলবার ফ্ল্যাটে হৃহ সহায়িকা কাজ করতে এসে দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যান। এছাড়াও গ্যারাজে গাড়িও দেখা যায়নি। শ্বেতা চক্রবর্তীর বাবা অরুণ চক্রবর্তী বলেন, শ্বেতা ওর সংস্থায় কাজ করতো। মেয়ের গাড়ি কেনার জন্য পাঁচলাখ টাকা দেয় অয়ন শীল। শ্বেতার ছোটবেলা থেকেই মডেলিং করার প্রবল ইচ্ছা ছিল।
Comments :0