চলন্ত ট্রেনের মধ্যে এক মাঝবয়সি যাত্রীর ওপর চড়াও হয়ে বেপরোয়া চড় মেরে যাচ্ছেন এক মহিলা। মুখে কুৎসিত ভাষা।
চলন্ত ট্রেন থেকেই সেই আক্রমণের ভিডিও তৈরি হয়ে গেল। সেখানেই থামলো না। দাড়িওলা মানুষটির ওপর আক্রমণের সেই ভিডিও মহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সমাজমাধ্যমে। সেই ভিডিও নিয়ে ট্যুইট করলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। তারপর থেকে ফেসবুকে জুড়ে শুরু হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে একের পর এক বিষ ছড়ানো মন্তব্য।
বিজেপি শাসিত রাজ্যের ঘটনা নয়। দু’দিন আগে ধুলিয়ান স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন ফরাক্কার তোফাপুর গ্রামের বাসিন্দা মফিদুল ইসলাম। তাঁর সহযাত্রী ছিলেন গ্রামেরই হিন্দু পরিবারের পাঁচ, সাত জন। তাঁরা ছিলেন ট্রেনের অন্য কামরায়। মফিদুল ইসলাম একাই ছিলেন ট্রেনের আলাদা কামরায়। আচমকাই তাঁর ওপর বেপরোয়া আক্রমণ শুরু করেন এক মহিলা যাত্রী। অভিযোগ, মাফিদুল ইসলাম তাঁর ভিডিও করছেন। কিন্তু এলোপাতাড়ি আক্রমণের মধ্যেই ট্রেনের মেঝেতে আছাড় মেরে ভেঙে দেওয়া হয় মফিদুল ইসলামের ফোনটিকে। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর ব্যাগ। চোখ থেকে চশমা খুলে ট্রেনের মেঝেতে ফেলে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর কুৎসিত মুখের ভাষার সঙ্গে এক বয়স্ক যাত্রীর গালে পড়তে থাকে থাপ্পড়ের পর থাপ্পড়। মারার কারণ বুঝতে পারছিলেন না তিনি। কোনও সহযাত্রীর কাছ থেকে সহায়তা না পেয়ে একসময় নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে মাফিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমার অন্যায় কী ম্যাডাম। আমার কোনও ভুল হয়ে থাকলে পুলিশের হাতে তুলে দিন।’’
সপ্তাহ খানেক আগেই হাওড়ার উলুবেড়িয়াতে আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে একযোগে বৈঠকে বসেছিল সঙ্ঘ ও রাজ্য বিজেপি’র নেতারা। তারপর থেকে বিভাজনের রাজনীতির সুর ক্রমশ চড়াচ্ছে বিজেপি। এরমধ্যেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র পিষে মারার ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে ছাত্ররা। পথে নামে নাগরিক সমাজও। আরজি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার পর রাজ্যে বাড়তে থাকা বাম পরিমণ্ডল দেখার পর বিজেপি সামনে আনে বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে। কিন্তু ফের যাদবপুরের ঘটনার পর কী নতুন করে বিভাজনের রাজনীতি সামনে আনার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ট্রেনের ঘটনাকে? সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা জানিয়েছেন,‘‘ উদ্দেশ্য নিয়ে বিজেপি এরাজ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতি তৈরি করতে চাইছে। কে দোষী, কে নির্দোষ তা যাচাই করার আগেই ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।’’
সহযাত্রীদের পাশে পাননি। কিন্তু মহিলার হাতে এক মুসলিমের আক্রান্ত হওয়ার ভিডিও তৈরি হয়ে যায় ট্রেন থেকেই। দ্রুত তা সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার সূত্র ধরে খবর চলে যায় মফিদুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধ বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
বড় ছেলে মিনহাজুল ইসলাম এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। বড় মেয়ে নবম শ্রেণির, মেজ মেয়ে সপ্তম শ্রেণির, একদম ছোট্ট মেয়েটি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। পরিবারের ওপর এহেন বিপর্যয় নেমে আসার পর সন্তানের উচ্চ মাধ্যমিকের বাকি পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত মা। শনিবার মাফিদুল ইসলামের স্ত্রী রুমা বিবি আতঙ্কিত গলায় জানান, ‘‘ বাড়িতে মিডিয়া আসছে। ছেলেটা বলেছিল, পরীক্ষাটা ভালোভাবে দিতে হবে। এখন কী হবে আল্লাই জানে।’’
সেদিন ট্রেনে ঠিক কী ঘটেছিল?
ধুলিয়ান স্টেশনে নিজের বাইক রেখে মোবাইলে ছবি তুলে রেখেছিলেন মাফিদুল ইসলাম। গাড়ির সুরক্ষার জন্য এই ছবি তুলে রাখা। তারপর বেশ কিছুক্ষণ স্টেশনে ঘোরাফেরা করার পর নবদ্বীপ থেকে মালদহগামী ট্রেন আসে। সেই ট্রেনে ওঠার পরই ঘটে যায় ঘটনাটি। সেই ঘটনা প্রসঙ্গে মাফিদুল জানান, ‘‘ আমাকে মারধর করার আগে মেয়েটি ফোনে কাউকে বলছিল, আসামিকে পেয়ে গেছি। আমাকে এলোপাতাড়ি চড় মারার সময় দু’জন লোক ভিডিও করছিল। একটা পাতলা করা ছেলে ভিডিও করছিল। আর আমার সামনে যিনি ছিলেন, উনিও একটা ভিডিও করছিলেন। জিজ্ঞাসা করছিলেন, আপনার নাম কী? আপনার বাড়ি কোথায়? ’’
ঘটনার গভীরতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা ভাবতেই পারেননি আক্রান্ত সংখ্যালঘু মানুষটি। ‘‘আমি তো এতটুকু ভাবতে পারিনি, ওদের একটা গ্যাং আছে। আমার মোবাইল আমার হাতেই ধরা ছিল। মহিলা প্রথমে মোবাইল কেড়ে কআছাড় মারছে। আমার চশমা ছিল। সেটা খুলে নিয়ে ভেঙেছে। জানটা বাঁচানোর জন্য আমি আইনের দিকে যেতে চাইছিলাম। বলেছিলাম, আরপিএফ-কে ডাকুন। ওরা যা ঠিক করবে আমি মেনে নেব।’’ ঘটনার পর মালদহ জিআরপিতে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। মাফিদুল ইসলামের ভাঙা মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেছে রেল পুলিশ। ব্যাক্তিগত জামিনে মুক্ত হয়ে মাফিদুল ইসলাম বাড়ি ফিরে এসেছেন।
কিন্তু তারপর থেকেই সোশাল মিডিয়াজুড়ে সংখ্যালঘু বিরোধী জিগির তৈরি করা চলছে। মহিলার ভিডিও তৈরি করার জন্য একজন সংখ্যালঘু মানুষকে কীভাবে চড়-ঘুষি মেরে শায়েস্তা করা হয়েছে সেই ঘৃণার প্রচার ছড়াতে শুরু করেছে আরএসএস বিজেপি। কিন্তু আকস্মিকভাবেই ঘটনার পর থেকে কার্যত উবে গেছেন মহিলা।
ধর্ম নির্বিশেষে মাফিদুল ইসলামের প্রতিবেশীরা সকলেই মানছেন, তাঁরা মাফিদুল ইসলামকে চেনেন। তাঁর বিরুদ্ধে মহিলার ভিডিও করার এই অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই। মাফিদুল ইসলামের স্ত্রী রুমা বিবি বলছেন,‘‘ বিশ বছর হয়ে গেল আমরা ঘর সংসার করছি। আমি ওঁকে চিনি। আর মোবাইলের কথা যদি বলেন, উনি মোবাইল ভালো করে চালাতেই পারেন না। ছেলেদের কাছে জানতে চান, এটা শিখিয়ে দে, কীভাবে কী চালাতে হয় দেখিয়ে দে।’’
সংখ্যালঘু প্রধান মুর্শিদাবাদ জেলায় এই ঘটনার গত দু’দিন ধরে সোশাল মিডিয়াজুড়ে চলছে বাইনারি তৈরির চেষ্টা। একদিকে আছে বিজেপি-আরএসএস। আর উল্টোদিকে মাফিদুল ইসলামের ওপর আক্রমণের ঘটনার পর দলে দলে তাঁর বাড়িতে রাজ্যের শাসকদলের বিধায়ক থেকে সমাজকর্মীদের ছদ্মবেশে তৃণমূল নেতাদের উপস্থিতি। মাফিদুল ইসলাম বলছেন,‘‘ আমি আমার তরফ থেকে আমি কিছু চাই না। যার যেটা ফায়দা লুটবে, সবাই আপনা আপনা ফায়দা লোটার জন্য আসছে। আমি আইনের ওপর ভরসা রেখেছি। আইন যেটা বলবে আমি মেনে নেব।’’
Islamophobia Train Attack
সংখ্যালঘু বিদ্বেষ তৈরি করতে চলন্ত ট্রেনে এলোপাতাড়ি মার

×
Comments :0