সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা, বাদগামের এই বাড়িটাই গমগম করছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের হাসিমুখের ভিড়ে মিশেছিলেন ডাঃ শাহনওয়াজও। সেদিন ছিল তাঁর মেয়ের বিয়ে। দু’সপ্তাহ পর সোমবার আবার সবাই এসেছেন। সেই একই বাড়ির উঠোনে সকলে দাঁড়িয়ে। থমথমে মুখে, কারোর মুখে হাসি নেই। সামনে শোয়ানো সকলের অতি কাছের মানুষটির দেহ। রবিবার রাতে গান্ডেরবালের হামলায় ছ’জন শ্রমিকের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন ডাক্তার শাহনওয়াজও।
আজ সইবাগের নায়িদগামে সেই বাড়িতে শয়ে-শয়ে প্রিয়জন শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বছর বাষট্টির ওই ডাঃ শাহনওয়াজ দারকে। সেই মানুষগুলির সঙ্গেই অঝোরে কেঁদে চলেছেন শাহনওয়াজের স্ত্রী-মেয়ে। ওদিকের ভিড়ে দু’ছেলের চোখ দিয়েও ঝরে গিয়েছে অঝোর ধারার জল। সঙ্গে মাঝে মাঝেই গুমরে উঠেছে জনতাও।
গাণ্ডরবালের গ্রামের সেই কান্নার রোল হয়তো পীরপাঞ্জাল টপকে পৌঁছায়নি রুচি আবরোলের কানে। শুনতে পাননি, তবুও শাহনওয়াজের পরিবারের মানুষ আজ একইসুতোয় বাঁধা পড়েছেন রুচি আর তাঁর পরিজনদের সাথে। স্বজন হারানোর যন্ত্রণার অনুভূতি আজ তাঁদের মিলিয়ে দিয়েছে। জম্মুর বাসিন্দা শ্রমিক শশী আবরোলেরও মৃত্যু হয়েছে গতরাতের ওই হামলায়। করবা চৌথের ব্রত রেখেছিলেন রুচি। উপোস করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে মন্দিরে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর থেকে স্বামীর আর কোনও ফোন পাননি।
সইবাগের নায়িদগামের মতোই আকাশ ভেঙে পড়েছিল জম্মুর এই তালাব তিল্লো মহল্লাতেও। রাতে জেনেছেন, স্বামী আর নেই। জোজিলা এড়াতে যে টানেল তৈরি হচ্ছে, সেখানেই আর্কিটেকচারাল ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছিলেন শশী আবরোল। গত রাতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছেন এই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটিও। যে উগ্রপন্থা-সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা বারবার জম্মু-কাশ্মীরবাসী সহ গোটা দেশকে ভাঁওতা দিচ্ছেন, সেই উগ্রপন্থা-সন্ত্রাসবাদ এভাবেই কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ-প্রাণ, শ্রমিক হোক বা চিকিৎসক। এই সন্ত্রাসবাদী হামলাকে কেন্দ্রে রেখে ধর্মের বেড়াজাল তৈরি করে প্রতি মুহূর্তে যে উগ্রতা, যে হিংসা তৈরির চেষ্টা মোদীরা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা-ও মুছে যাচ্ছে রুচিদের কান্নায়। পরিজনের আর্তনাদের কাছে ধর্মীয় উন্মাদনা ঠাঁই পায়নি।
শ্রীনগর-লে জাতীয় সড়কের উপর গগনগেরে সুড়ঙ্গ নির্মাণের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওই শশী, গুরমিত, ফয়াজরা। তাঁদের সঙ্গেই গুলিতে ঝাঁঝড়া করে দেওয়া হয় চিকিৎসককেও। তিনি সেখানে একজন চিকিৎসক হিসাবেই কর্মরত ছিলেন। নির্মাণ সংস্থা এপিসিও ইনফ্রাটেকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। শাহনওয়াজের ছেলে মহসিন আইএএস হতে চান, সমাজের সেবা করতে ইচ্ছুক। চোখ মুছে বাবার দেখা এই স্বপ্নের বাস্তবায়নেই তিনি এখন বদ্ধপরিকর। খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারান শাহনওয়াজ। ছোট ভাই-বোনেদের মাথার উপর ছাতা হয়ে উঠেছিলেন তিনিই, দাদাকেই মা-বাবা বলে জানতেন তাঁরা, বললেন তাঁর এক বোন। প্রতিবেশী-আত্মীয় স্বজন সকলের কাছেই শাহনওয়াজ ছিলেন, ভরসার মানুষ, এক স্তম্ভ। তাই তাঁর শেষকৃত্যের সময় ভিড় উপচে পড়েছিল।
রবিবার রাতে খবর পেলেও সোমবার সকাল পর্যন্ত রুচি স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি তাঁর স্বামী আর নেই। কখনও তিন বছরের মেয়ের উপর চেঁচিয়ে উঠছেন, কখনও আবার মেয়েকেই বুকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছেন। ‘কি লাভ হলো ওদের? কি পেল ওরা আমার স্বামীকে মেরে?’ জানতে চেয়েছেন রুচি। জবাব স্বভাবতই পাননি। শশী ও রুচির এক ছেলেও আছে। সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। শশীর বৌদি দিব্যা জানালেন, ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার হোক চাইতেন তিনি। রবিবার সন্ধ্যায় শশীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন রুচি। করবা চৌথের ব্রত রেখেছেন স্ত্রী, জানতেন শশী। শোকস্তব্ধ স্ত্রী বলেন, ‘আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলে মন্দিরে যাই। ফিরে অপেক্ষা করছিলাম কখন ভিডিও কল করবে। আমাকে বলেনি যে কোনও সমস্যার মধ্যে আছে বা জীবনের ঝুঁকি আছে। ও ফোন না করায় আমি করি। প্রথমে ফোন বাজছিল। তারপর বন্ধ হয়ে যায়।’ জম্মুর তালাব তিল্লো এলাকায় থাকেন তাঁরা। রুচির পাশেই বসেছিলেন শশীর মা। সন্তান শোকে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। নিহত শ্রমিকের বোন উর্বশী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সংবাদমাধ্যমের সামনে বললেন, ‘জম্মু-কাশ্মীর কতটা স্বাভাবিক হয়েছে, এই ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। সাত জন সাধারণ মানুষ একসঙ্গে খুন হয়ে গেলেন।’ শশী ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। সংসার কী ভাবে চলবে? জানেন না ওঁরা। রুচির সরকারি চাকরির দাবি জানিয়েছে পরিবার।
কয়েকদিন আগে বিহারের এক পরিযায়ী শ্রমিকের দেহ উদ্ধার হয় সোপিয়ানে। বারবার নিশানা হচ্ছেন শ্রমিকরাই। রবিবার যে ছ’জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিন জন বিহারের। বাকি তিন জন জম্মু-কাশ্মীরেরই। মোদী-শাহের ‘সন্ত্রাসবাদ মুক্ত’ জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপি’কে হঠিয়ে মানুষ ভরসা রাখেন বিরোধীদের উপরই। ওমর আবদুল্লা মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর যখন রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠল, তখনই পরপর সন্ত্রাসবাদী হামলা কেন? এই প্রশ্নও গুরুতর হয়ে উঠেছে।
রোজগেরে মানুষটাকে খুইয়ে শশীর বাবা জে এল আবরোল এদিন যেন আর্তনাদের সুরে বলছিলেন, কাশ্মীরের এই ঝুঁকিটা আঁচ করতে পারিনি। সরকারকে বলছি, একটা চাকরি দিন আমার ছেলের বউটাকে। সংসার চলবে কী করে!
Kashmir Workers Attack
রোজগেরে আর কাছের মানুষ আর্তনাদই মিলিয়ে দিল নায়িদগাম আর তালাব তিল্লোকে
×
Comments :0