Post editorial

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা এভাবেই তৈরি হয়

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ অনুপ রায় 


একটি মৃত্যুকে ঘিরে গোটা সমাজ এভাবে বিচলিত হওয়া ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসা, শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার ও প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুশাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করে মেয়েদের এগিয়ে আসা আজ সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এই ঘৃণ্য অপরাধকে ও অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, কিন্তু তার সাথে সাথেই যে ব্যবস্থা এই অপরাধের ভিত তৈরি করেছে তাকে যেন ছাড় না দিই। 
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পচন ধরেছে। এটা কিন্তু শুধু কথার কথা নয়, যারা এই ব্যবস্থাটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, প্রতিমুহূর্তে কাছ থেকে দেখছেন, তারা এর সত্যতা স্বীকার করেন। স্বাস্থ্য দপ্তরের কাজকর্ম নিয়ে আমাদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের, বিশেষ করে যখন থেকে এই দপ্তর পরিচালনায় চিকিৎসকদের কোণঠাসা করে আমলাদের ওপর নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ানো হতে থাকলো। এই আমলাদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো যে এরা সবসময়ই মন্ত্রীরা যা বলেন তাকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করেন।  তারা কোনোসময়ই এর বিভিন্ন প্রকৌশলগত দিকগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা করতে চান না। এর ফলে যে কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। এই অতিরিক্ত আমলা নির্ভরতার আরেকটি দিক হলো দপ্তরের কাজকর্ম নিয়ে কোনও একাত্মতা গড়ে ওঠে না। এরা ভাবেন আমি এসেছি স্বল্প সময়ের জন্য, তাই সমস্যার গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, একটা আপাতঃ সমাধানের পথে যাওয়াই ভালো। এবং এই চটজলদি সমাধানের থেকেই জন্ম নেয় দুর্নীতি। 
আমরা জানি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একদিনে তৈরি হয় না। স্বাস্থ্য দপ্তরের ক্ষেত্রে ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বর্তমান প্রতিবেদক এর সুযোগ হয়েছিল দীর্ঘ এক দশক ধরে স্বাস্থ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকার। কিভাবে নীতিহীনতা ও ভিন্নমত দমন করার প্রবণতা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও স্বচ্ছতার সাথে কাজ করতে চাওয়া চিকিৎসক প্রশাসকদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে তার প্রত্যক্ষদর্শী এই প্রতিবেদক। স্বাস্থ্য দপ্তরের কাজকর্মে বাইরের লোকের হস্তক্ষেপ বর্তমান সরকারের আমলে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বোচ্চ প্রশাসকের অসহায় অবস্থা দেখে করুণা হয়। এই মৎস্যন্যায় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের প্রত্যক্ষ মদতে। বিগত ১০ - ১২ বছর ধরে ক্রমাগত একের পর এক অন্যায় হয়েছে চিকিৎসকদের বদলি, প্রমোশন ও নিয়োগ নিয়ে। একদলকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে অন্য দলকে অবৈধভাবে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, মোটা অঙ্কের অর্থ নেওয়া হয়েছে এর জন্য, এবং এই কালো টাকা নির্দিষ্ট কয়েকজন পকেটে পুরেছে, তার প্রসাদ পেয়েছে তাদের ঘিরে থাকা সাঙ্গোপাঙ্গরা। অথচ এই সব অন্যায়ের সঙ্গে জুড়ে গেছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকরাও, কারণ এইসব আদেশনামা তাদের স্বাক্ষরিত। এই আধিকারিকরাও সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারেননি। টাকার লেনদেন হয়েছে শুধু পছন্দের জায়গায় পোস্টিং পাওয়ার জন্যই নয়, ট্রান্সফার আটকানোর জন্যও। স্বাস্থ্য দপ্তরের শীর্ষ কর্তারা সবই জানতেন, অথচ না জানার ভান করতেন। হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড তৈরি করা হলো নিয়োগের বিষয়টি এই চক্রের পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। শাসকদলের কয়েকজন চিকিৎসক নেতার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এখানে, আমরা চিকিৎসক সংগঠন এর যৌথ মঞ্চ ‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস-এর পক্ষ থেকে একাধিকবার ডেপুটেশন দিয়েছি, কিন্তু দুর্নীতির বাসা ভাঙা যায়নি কারণ সরকার সব জেনেও কোন অজ্ঞাত কারণে চুপ করে বসে থেকেছে। এইভাবেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন রাত তৈরি হয়। আজকের সন্দীপ ঘোষদের  কার্যকলাপ সব জেনেও চুপ থাকার ফসল।
পালা বদলের পর সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতির শুরুটা হয়েছিল এই নিয়োগ, বদলি ও প্রমোশন দিয়ে। প্রথমেই বাতিল করা হলো আগের সরকারের বদলি নীতিকে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির অপছন্দের চিকিৎসক সংগঠন এর পদাধিকারীদের ওপর প্রথম আক্রমণ নেমে এল, তারপর অন্যান্য চিকিৎসকদের ওপর। অনেকেই এই বদলি আটকানোর জন্য ওদের সাথে রফা করলেন অর্থের বিনিময়ে, যারা করলেন না বা করতে পারলেন না তারা মুখ বুজে মেনে নিলেন। হায়েনা যেমন রক্তের স্বাদ পেলে সেখান থেকে সরতে চায় না এরাও তাই করল। কাঁচা টাকার আমদানি স্বাভাবিকভাবেই টাকার লেনদেন নিয়ে বিভিন্ন উপদল গড়ে উঠল। ক্রমশ সরকারি হাসপাতাল, বিশেষ করে মেডিক্যারল কলেজ কেন্দ্রিক বিভিন্ন সিন্ডিকেট গড়ে উঠল যারা সেই হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের কাছে থেকে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, ওষুধ ও রাসায়নিক এবং আসবাবপত্র সরবরাহের বরাত যারা পেতেন তাদের কাছ থেকে, বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ি পার্কিং থেকে, ক্যান্টিন ও বিভিন্ন স্টল থেকে টাকা আদায় করতে শুরু করে। এই নিয়ে অনেক অভিযোগ দপ্তরে জমা পড়লেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। সহজেই অনুমেয় এভাবে বাধাহীন তোলাবাজির একটা বড় অংশ উর্ধ্বতন নেতৃত্বের কাছে নিয়মিত পৌঁছে যেত। যে সব খবর প্রকাশ্যে আসতে তা মূলত নেতাদের নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গন্ডগোলের জন্য। 
এরপর এদের নজর পড়ল শিক্ষার দিকে। প্রথমেই প্রয়োজন পড়ল স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা। এটা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক স্তরে পছন্দের লোক নিয়ে আসা এবং মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকদের একাংশ, কয়েকজন অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আধিকারিককে নিয়ে একটা চক্র তৈরি করে এর মাধ্যমে দুর্নীতি করা। এটা তারা প্রথম থেকেই চেষ্টা চালিয়ে ও বড় সাফল্য পায়নি কারণ শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের অনেকেই এই অনৈতিক কাজকর্মের বিরোধী ছিলেন। এরপর শুরু হয় বেছে বেছে অধ্যক্ষ নিয়োগ ও শিক্ষকদের পদোন্নতির মাধ্যমে বাছাই কয়েকটি কলেজে একটা দুর্নীতিচক্র গড়ে তোলা, তাদের সাথে কিছু ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারের যোগ দেওয়া। আমি যখন অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছি তখন এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ভাঙানোর জন্য ভয় দেখানোর একটা অন্যতম রাস্তা ছিল পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয়। কিন্তু সেসময় বেশিরভাগ বিভাগীয় প্রধানকে তারা সাথে পায়নি। পরবর্তী সময়ে এই দুর্নীতি চক্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলো, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রশ্নপত্র নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মডারেটর পদ তুলে দিয়ে দু’-একজন পেটোয়া জুনিয়র শিক্ষককে দিয়ে প্রশ্ন তৈরি করা, তা ফাঁস করা, উত্তরপত্র তৈরি করে তার হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিক্রি করা, পরীক্ষাহলে বিশেষ কয়েকজন এর জন্য টোকাটুকির ব্যবস্থা করা, পরীক্ষকদের ওপর চাপ তৈরি করা, এমনকি স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোন করে পরীক্ষার ফল পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে থাকলো। সোজা কথায় পড়াশোনা না করে পাশ করা, এমনকি বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পাওয়ার জন্য মেধার স্থান দখল করতে শুরু করল অর্থ। এমনও হয়েছে এধরনের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে বেশ কয়েকজন বরিষ্ঠ অধ্যাপক পরীক্ষক হতে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু এই অনাচার আটকানো যায়নি। যে শিক্ষকদের চাপের মুখে পরীক্ষার নম্বরে পরিবর্তন করতে হয়েছে তারা সাহস পাননি কোনও লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে। 
এটা মনে করার কোনও কারণ নেই এই দুর্নীতি চক্র শুধুমাত্র আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেই চালু ছিল। এখন তো আর ও অনেক কলেজের নাম আসছে সংবাদ-মাধ্যমে। তবে এর মধ্যে আর জি কর একদম প্রথম সারিতে উঠে আসে সন্দীপ ঘোষের সৌজন্যে। প্রথম যখন ২০২২ এ অভিযোগ উঠল তখনই বেশ কিছু তথ্য সহ স্বাস্থ্য ভবনে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক যোগ্য লোক থাকতেও, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল সেই সময় কারণ তার এম এস ভি পি হিসাবে কাজকর্ম নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সেই মানুষটিকে আর জি কর এ অধ্যক্ষ করায় বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো বলা চলে। একটা লুম্পেন রাজ একটি শতাব্দী-প্রাচীন ঐতিহ্যশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর দখল নিলো। তারপর যা যা ঘটনা ঘটেছে এবং দুর্নীতি কিভাবে সর্বব্যাপী হয়েছে তা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন।
যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফেরত আসি। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন রাত নিজে থেকে তৈরি হয় না, আমরাই তাদের তৈরি করি। যখন অপরাধ পাহাড় প্রমাণ হয়ে ওঠে, আমরা সব দায়ভার নিতে অস্বীকার করে ঐ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর ওপর সব দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা সাধু সাজি। যখন উপর্যুপরি অভিযোগ জানানো হয়েছিল তখন স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বোচ্চ কর্তারা চোখ কান বন্ধ করেছিলেন, তখনই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে আজকের এই বিপর্যয়কর দিন দেখতে হতো না। এখনও বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যে সব ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা বাড়ছে তাদের এখনই না রুখতে পারলে আবারও আমাদের আর জি কর এর মতো ঘটনা দেখতে হবে। প্রশাসনের ওপর অনাস্থা সাধারণ মানুষ খোলাখুলি রাস্তায় নেমে জানিয়েছেন। এবার এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনদের মোকাবিলা সাধারণ মানুষকেই করতে হবে রাস্তায় নেমে।

Comments :0

Login to leave a comment