প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতির মিছিলে দুনিয়াজুড়েই দেখা যাচ্ছে কয়েকটি প্রতীক। সাদা-কালো রঙের কাফিয়ে বা কুফিয়া সবচেয়ে জনপ্রিয়। কাফিয়ে আরব বিশ্বেই দেখা যায়। কেউ মাথায় পড়েন, কেউ গলায় জড়ান, কেউ চাদরের মতো করে শরীরে জড়িয়ে নেন। সূর্যের উত্তাপ থেকে মাথা বাঁচতে ব্যবহার করা এই পোশাক ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের সময়ে জাতীয় পোশাক হয়ে গেছে। প্যালেস্তাইনের বিশ্ববিশ্রুত নেতা ইয়াসের আরাফত সর্বক্ষণ কাফিয়ে পড়ে থাকতেন। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কাফিয়ের নকশা তিন রকমের। একটি মাছ ধরার জালের মতো, প্যালেস্তাইনের মৎস্যজীবীদের কথা মাথায় রেখে। ‘নদী থেকে সাগর’ স্লোগানের সাগর, অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে প্যালেস্তাইনের সম্পর্ক প্রতিফলিত এই নকশায়। আরেকটি নকশা জলপাই (অলিভ) পাতার ধরনে। অলিভের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্যালেস্তিনীয়দের জীবন-জীবিকা। আরেকটি নকশা মোটা রেখার— এটি বাণিজ্যপথের সড়ক। প্যালেস্তাইনের সঙ্গে বহু দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল।
জলপাই গাছের ডাল নিয়েও প্রতিবাদের মিছিল সংগঠিত হচ্ছে। জলপাই গাছ সমস্ত রকম আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। খরা, প্রবল শীত, বর্ষা, এমনকি আগুনেও সহজে পোড়ে না। তার শিকড়ও খুব গভীর। এই অর্থে জলপাই গাছ প্যালেস্তাইনের ইতিহাসের মতো, ইজরায়েলের দখলদারির মধ্যে টিকে থাকা প্যালেস্তাইনের মতো। প্রায় এক লক্ষ প্যালেস্তিনীয় অলিভ গাছকে কেন্দ্র করে জীবিকা অর্জন করেন। অলিভ তেল, সাবান উৎপাদনে তা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জলপাইয়ের পাতা শান্তির প্রতীক। ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে আরাফত বলেছিলেন, ‘আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি এক হাতে অলিভের ডাল, অন্য হাতে স্বাধীনতা সংগ্রামীর রাইফেল নিয়ে। আমার হাতে থেকে অলিভের ডাল ফেলে দেবেন না, আমি আবার বলছি আমার হাত থেকে অলিভের ডাল ফেলে দেবেন না।’ অধিকৃত এলাকায় ইজরায়েলী আগ্রাসনের একটি অন্যতম চেহারা অলিভ গাছ কেটে ফেলা। প্যালেস্তাইনের কবি মাহমুদ দারউইশ লিখেছিলেন, ‘যদি অলিভ গাছ চিনত/ সেইসব হাত যারা তাদের বপন করেছে/ তাদের তেল হয়ে যেত চোখের জলের ফোঁটা’।
আরেকটি প্রতীক চাবি। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল গঠিত হবার পরে সাড়ে সাত লক্ষ প্যালেস্তিনীয়কে নিজেদের ভূমি থেকে উৎখাত করা হয়। বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু স্রোত চলে আসে গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, কেউ চলে যান অনেক দূরে। প্যালেস্তিনীয়রা এই ঘটনাকে বলেন ‘নাকবা’ —বিপর্যয়। অনেকেই চাবি নিয়ে ফিরেছিলেন—এই আশায় যে ফের তাঁরা ফিরে যাবেন নিজের গ্রাম-শহরে, নিজেদের বাড়িতে। সেই অপেক্ষার ৭৫ বছর হয়ে গেছে। প্যালেস্তাইনের স্বদেশভূমি ক্রমে দখল করে নিয়েছে ইজরায়েল। গাজায় এবারের আক্রমণে ইতিমধ্যেই গৃহহীন দেড় লক্ষ মানুষ। অনেকেই বলছেন, ‘দ্বিতীয় নাকবা’। চাবি হলো ঘরে ফেরার অধিকারের প্রতীক, স্বাধীন প্যালেস্তাইনের প্রতীক। একদিন ফেরা হবেই, এই চিরন্তন আশারও প্রতীক।
নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনের সংহতি মিছিলে দেখা যাচ্ছে কাটা একফালি তরমুজ। প্যালেস্তাইনে সবচেয়ে বেশি ফসল হয় তরমুজের। এমনিতেই এই ফল প্যালেস্তাইনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। তার ওপরে কাটা তরমুজের রং লাল, সবুজ, কালো বীজ। প্যালেস্তাইনের পতাকার রং। ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের পতাকা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৮০ সালে তিন শিল্পীকে ইজরায়েলী সেনারা এই বলে সাবধান করে প্যালেস্তাইনের রঙে কিছুই আঁকা যাবে না, এমনকি তরমুজ আঁকলেও গ্রেপ্তার হবে। সেই থেকে তরমুজই হয়ে উঠেছে প্যালেস্তাইনের পতাকার প্রতীক। তেল আভিভেই শান্তি আন্দোলনের কর্মীরা এ বছরেই ট্যাক্সিতে সেঁটে দিয়েছেন তরমুজের স্টিকার। সেখানে লেখা ‘এটি প্যালেস্তাইনের পতাকা না’। সোশাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞা এড়াতেও প্যালেস্তাইনের পতাকার বদলে ফালি তরমুজ ব্যবহার করছেন অনেকে।
Comments :0