অনিন্দ্য হাজরা
ইজরায়েল প্যালেস্তাইন সংঘাতকে মুসলিম বনাম ইহুদি সংঘাত বলে দেখাতে নেমেছে বিজেপি এবং আরএসএস’র অনুগামীরা। সোশাল মিডিয়ায় কিছু পোস্টে সভ্যতায় ইহুদিদের অবদানের প্রসঙ্গ তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইহুদিদের নিকেশ করতে নেমেছে মুসলিমরা। মুসলিম বিদ্বেষ চাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে একেবারে ভারতে নির্বাচনী সমীকরণ মাথায় রেখে। স্বাধীন প্যালেস্তাইনের দাবিতে সমর্থন জানালে তাকেই বলা হচ্ছে ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ রাজনীতি।
বাস্তবে বহু ইহুদি ইজরায়েলের এই দখলদারির বিরুদ্ধে। মুসলিম জনগোষ্ঠী নেই এমন বহু দেশ বা নাগরিক আন্দোলনও প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেমন ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ চালানোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন সারা বিশ্বের অসংখ্য মুসলিম। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়েও সামিল হয়েছেন মুসলিমরা।
আমেরিকা, ইউরোপ সহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদি পরিবারের অনেকেই কড়া ভাষায় নিন্দা করছে অবরুদ্ধ ভূখণ্ডের নিরপরাধ জনগোষ্ঠীর উপর বোমাবর্ষণকে। সেই তালিকায় যেমন রয়েছেন নোয়াম চমস্কি, মরিয়ম মারগোলেস, হেনরি সিগম্যানের মতো বিশিষ্ট। রয়েছেন বস্টন, হার্ভার্ডের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, যাঁরা জন্মসূত্রে ইজরায়েলি এবং ধর্মে ইহুদি।
নোয়াম চমস্কি বলছেন, ‘‘দখল করা অঞ্চলে ইজরায়েল যা করছে, সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসনের থেকেও ভয়ঙ্কর। আসলে আমরা যদি বলি যে ইজরায়েল বর্ণ বৈষম্যবাদী অত্যাচার চালাচ্ছে, তাহলে সেটি খুবই মৃদু সমালোচনা হবে। দখলকৃত অঞ্চলগুলির অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’’
ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী মরিয়ম মারগোলেস বলছেন, ‘‘এক সময় কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানরা আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। আজ প্যালেস্তিনীয়রা আমাদের সমর্থন চাইছেন। ইজরায়েল যা করছে তাকে ধিক্কার জানাই।’’
জার্মান আমেরিকান রাব্বি বা ইহুদি ধর্মের প্রচারক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মধ্যপ্রাচ্য প্রোজেক্টের ডিরেক্টর হেনরি সিগম্যানও ইজরায়েলের দখলদারির কড়া সমালোচক। তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্যালেস্তাইনের দখল করা এলাকাগুলিকে ছোট ছোট পকেটে ভাগ করে ফেলেছে ইজরায়েল। গাজা ভূখণ্ডের মানুষের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সমস্ত সংযোগ নষ্ট হয়ে গিয়েছে ইজরায়েলের অবৈধ দখলদারির ফলে।’’
রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে দখলীকৃত প্যালেস্তাইন বা ‘অকুপাইড প্যালেস্তিনিয়ান টেরিটরি’ বা ওপিটি’র বিশেষ রিপোর্টার পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন রিচার্ড ফক। তিনি ইজরায়েলের নীতিকে সরাসরি ‘মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের সঙ্গে যা আচরণ করা হত, প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে একই আচরণ করছে ইজরায়েল।’’
ইজরায়েলকে মার্কিন সামরিক সাহায্য পাঠানোর প্রতিবাদে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠে বামপন্থী মঞ্চ ‘ইফ নট নাও’। এই মঞ্চের সদস্যরা মূলত যুব সম্প্রদায়ের। তাঁরা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পড়ুয়া, এবং ইজরায়েলি বংশোদ্ভুত। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমরা বলতে পারি না যে প্যালেস্তিনীয়দের প্রত্যাঘাত বিনা প্ররোচনায় হয়েছে। ইজরায়েল রাষ্ট্রের হাতে হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয় পুরুষ, মহিলা এবং শিশুর রক্ত লেগে রয়েছে। এই সংঘর্ষের দায় যাঁরা ইজরায়েলকে অস্ত্র সাহায্য করে যাচ্ছে (পড়ুন আমেরিকা), এবং যেই রাষ্ট্রনেতারা সব দেখেও চোখ বন্ধ করে রেখেছেন তাঁদের।’’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা রবিবার থেকে গাজায় বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। বিভিন্ন অংশের পড়ুয়াদের পাশাপাশি ইজরায়েলি বংশোদ্ভুত পড়ুয়ারাও এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। ‘টাইমস অফ ইজরায়েল’ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্যালেস্তাইন মুক্তি আন্দোলনকে সংহতি জানাতে প্রতি বৃহস্পতিবার পড়ুয়ারা কেফিয়ে নামে এক ধরণের চেক স্কার্ফ পরে আসেন। তথাকথিত রাজনীতি বিমুখ হিসেবে পরিচিত পড়ুয়ারাও কেফিয়ে পরা শুরু করেছেন!
লাতিন আমেরিকা থেকেও ভেসে এসেছে গাজার মানুষের প্রতি সংহতি বার্তা। কলোম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পেত্রো বলেছেন, ‘‘আমি যদি ১৯৩৩ সালের জার্মানিতে থাকতাম, তাহলে ইহুদিদের হয়ে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়তাম। কিন্তু আমি যদি ১৯৪৮ সালের প্যালেস্তাইনের থাকতাম, তাহলে অবশ্যই প্যালেস্তিনীয়দের হয়েই পক্ষ নিতাম।’’
রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে কাঠগড়ায় তুলে বলিভিয়া বলছে, ‘‘যে সংস্থার মূল দায়িত্ব হিংসা বন্ধ করা এবং মানবাধিকার রক্ষা করা, তাঁরা দিনের পর দিন নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।’’
কিউবা এবং ভেনেজুয়েলার তরফেও গোটা ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে গাজায় ইজরায়েল হামলা চালানোয় ইজরায়েলের সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক রদ করে বলিভিয়া এবং ভেনেজুয়েলা।
চিলি, ব্রাজিল এবং মেক্সিকোর তরফেও নিন্দা জানানো হয়েছে গাজায় চলা হামলা’র ঘটনাকে। মেক্সিকোর বিদেশমন্ত্রক মনে করছে, রাষ্ট্রসংঘের নির্ধারিত পৃথক ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন গঠনই শান্তি স্থাপনের একমাত্র পথ। সাম্প্রতিক হিংসা থামাতে আলোচনার সাহায্য নেওয়ার কথাও জানিয়েছে মেক্সিকো। এই দেশগুলির অনেকেই হামাস’র গত শনিবারের হামলাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু দায়ী করেছে দশকের পর দশক ধরে চালানো দখলদারিকে।
Comments :0