সাধারণ মানুষের করের টাকায় কলকাতা শহর জুড়ে লাগানো হয়েছিল ১২ হাজারের বেশি ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ। সবটাই হয়েছিল মমতা ব্যানার্জির সৌন্দর্যায়নের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। সেই সময় বামপন্থীদের তরফে বারবার বলা হয়েছিল, ত্রিফলার ফলে বাড়তি খরচের বোঝা চাপবে কর্পোরেশনের ঘাড়ে। কিন্তু শোনা হয়নি সেই কথা। যদিও ১০০ কোটি টাকার কাছে খরচ হয়ে যাওয়ার পরে হুঁশ ফিরেছে কর্পোরেশনের। পাকাপাকি ভাবে ত্রিফলা থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিম। যদিও কর্পোরেশনের সাফাই, বিদ্যুতের খরচ কমাতেই রাশ টানা হয়েছে ত্রিফলায়।
কিন্তু তাহলে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভগুলির কী হবে?
কলকাতা কর্পোরেশনের আলোক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ সদস্য সন্দীপ রঞ্জন বক্সি জানিয়েছেন, ত্রিফলাগুলিকে একফলায় রূপান্তরিত করার কাজ চলছে। নতুন করে শহরের কোথাও ত্রিফলা বসানো হবেনা। কাজ চালানো হবে একফলা কিংবা সৌর বিদ্যুৎ চালিত বাতিস্তম্ভ দিয়ে।
একই সুর কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের গলাতেও। তাঁদের দুজনেরই দাবি, কলকাতা শহরে প্রায় ৫০০-৭০০ মতো ত্রিফলা বাতিস্তম্ভকে একফলা স্তম্ভে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
কিন্তু বাকি প্রায় ১১ হাজার ত্রিফলা স্তম্ভের ভবিষ্যত কি?
এর কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই কলকাতা কর্পোরেশনের কাছে।
চলতি বছরের গোড়া থেকেই ত্রিফলার দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা শুরু করে কলকাতা কর্পোরেশন। ২০২২ সালের আগস্ট মাস নাগাদ পৌর কমিশনার বিনোদ কুমারকে দিয়ে ত্রিফলার একটি অডিট সমীক্ষা করায় কর্পোরেশন। সেই সমীক্ষায় এবং অন্যান্য সমীক্ষাগুলি থেকে উঠে আসে, কলকাতা শহরে ১২ হাজার ত্রিফলার মধ্যে সিংহভাগ অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলি কার্যত মৃত্যুফাঁদ। কিছু বাতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ করার চেষ্টা হলেও ‘চোরের’ উপদ্রবে পিছিয়ে আসতে হয়েছে কর্পোরেশনকে।
এই মৃত্যুফাঁদের অস্তিত্ব হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন শহরের মানুষ। ত্রিফলায় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ১০ ছাড়িয়েছে। যদিও কলকাতা কর্পোরেশন প্রত্যেক বার নিজেদের দায় এড়িয়ে গিয়েছেন।
এই ‘হিউম্যান কস্টের’ সঙ্গে রয়েছে ত্রিফলা ‘পোষার’ বাড়তি খরচ। তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা কর্পোরেশনের একটি অংশের বক্তব্য, ২০১২ সালে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের বিদ্যুতের বিল ছিল ২ কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০১৪ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে হয় ১৮ কোটি টাকা। কর্পোরেশনের তরফে ২০২২ সালে সেই বিলের পরিমাণ জানানো না হলেও, তা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। তার তুলনায় একফলা আলোকস্তম্ভের খরচ স্বাভাবিক ভাবেই কম।
কলকাতা কর্পোরেশনের আলোক বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা জানাচ্ছেন, ত্রিফলায় একটির জায়গায় তিনটি বাল্ব লাগাতে হয়। একইসঙ্গে এই স্তম্ভের কাঠামো একফলা কিংবা অন্য স্তম্ভের তুলনায় অনেকটাই পলকা। তারফলে অল্প ঝড়েই এর ভারসাম্য টলে যায়। একইসঙ্গে বাহারি হওয়ায় একেবারেই টেকসই নয়। তাই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ। বর্তমানে কর্পোরেশনের ভাড়ারে মা ভবানী। তাই লেনিন সরণী হোক কিংবা হরিশ মুখার্জি রোড, সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ত্রিফলার কঙ্কাল।
এই ‘কঙ্কাল’গুলির একেকটার খরচ কমবেশি ১২ হাজার টাকা। কর্পোরেশনের এন্টালি ওয়ার্কশপে তৈরি করলে দাম পড়ার কথা আরও কম। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১২ হাজার ত্রিফলা বসাতে কর্পোরেশনের খরচ হওয়ার কথা কমবেশি ১৪ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। কিন্তু তা হয়নি। কারণ কলকাতার তৎকালীন মেয়র শোভন চ্যাটার্জির উদ্যোগে একেকটি বাতিস্তম্ভ কিনতে খরচ হয়েছিল ১৭ হাজার টাকা। শহর জুড়ে মমতা ব্যানার্জির স্বপ্ন সার্থক করার নামে কর্পোরেশনের ৩০ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করেছিলেন শোভন চ্যাটার্জি। কেন্দ্রীয় সংস্থা ক্যাগের রিপোর্টে সেই দুর্নীতি ফাঁস হয়। দায় ঝেড়ে ফেলতে আলোক বিভাগের তৎকালীন ডিজি সহ কয়েকজন অধস্তন আধিকারিককে বলির পাঁঠা বানায় তৃণমূল।
কলকাতার বর্তমান মেয়র নিজের দলের প্রাক্তনের দায় কোনও ভাবেই বয়ে নিয়ে রাজি নন। তাঁর সাফাই, কর্পোরেশনের হাতে টাকা নেই। তাই ত্রিফলার বদলে অন্য কিছু ভাবা হচ্ছে। সেই ভাবনার ফসল হিসেবে ইতিমধ্যেই হাজরা সহ শহরের বেশ কিছু জায়গায় সৌর বিদ্যুৎ চালিত স্তম্ভের দেখা মিলেছে। কিন্তু এই বিলম্বিত বোধোদয়ের খেসারত দিতে হল শহরের সাধারণ মানুষকেই। ত্রিফলা ব্যর্থতার দায় কি সরাসরি স্বীকার করবে তৃণমূল?
Comments :0