আপাতদৃষ্টিতে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি ইতিবাচক অর্থ বহন করলেও সাম্প্রতিককালে এই বঙ্গে বুদ্ধিজীবী কথাটা অনেকের কাছেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা হাস্যকর লঘু শব্দের মতোই হয়ে উঠেছে। আরও এক ধাপ এগিয়ে বলা যায় অনেকের কাছেই বুদ্ধিজীবী শব্দটি আজকাল বিবেকহীন, ঘৃণ্যতম নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। একটি ইতিবাচক শব্দ চূড়ান্ত নেতিবাচক শব্দে পরিণত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকে। হয়তো অনেকেই মুহূর্তের মধ্যে সেইসব নানা কারণ খুঁজে পাবেন তাঁদের যাপিত জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতায়।
তবে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের স্পন্দন শাখা কিন্তু তাঁদের নতুন প্রযোজনা ‘মুখোশ’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে তুলে ধরেছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের আসল রূপ। বুদ্ধিজীবীর মতো একটি ইতিবাচক শব্দ কিভাবে ঘৃণ্যতম নেতিবাচক শব্দে পরিণত হয়ে ওঠে তা এই ঘটমান নাট্যকাহিনীর প্রতিটি ছত্রে-ছত্রে ক্রমেই প্রস্ফুটিত হয়েছে।
প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় সুশৃঙ্খল, চিন্তাশীল কিছু মানুষ উৎশৃঙ্খলময় কু-প্রভাবের ক্রমাগত হাতছানিতে ভয়ঙ্কর অসন্তুষ্ট। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুহুর্মুহু ঘনীভূত হয় সু এবং কু’য়ের সংঘাত। কিন্তু নাট্যসংঘটনের ঘটমান ব্যঞ্জনায় অবশেষে উন্মোচিত হয় আসল রহস্য।
কি সেই রহস্য ? সেটা না হয় অনুল্লেখিতই থাক। অবশ্য এই কৌতূহল নিবারণের জন্য প্রেক্ষাগৃহের দর্শক আসন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াই শ্রেয়।
যে কারণে আজ এ বঙ্গে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নামক বস্তুটি অনেকের কাছেই অপ্রিয় এবং অশ্রদ্ধার বিষয় হয়ে উঠেছে, বহুকাল আগেই এদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে রাশিয়ার সুচিন্তক, বলিষ্ঠ রচয়িতা আন্তন পাবলোভিচ চেকভের লেখা ‘দ্যা মাস্ক’-এ এহেন বুদ্ধিজীবীদের কথা উল্লেখিত হয়েছে। চেকভের সেই ‘মাস্ক’ অবলম্বনে সুনীত কুমার ‘মুখোশ’ নাটকটি রচনা করেছেন। সুমিত কুমার রচিত এই নাটকের কয়েকটি চরিত্রের কথোপকথনেই স্পষ্ট হয় বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণ্য অবনমন।
আদঁরে : পা চাটবো !
ঝেস্তিয়াকভ : জুতো পরা রয়েছে যে !
স্পিরিদোনিচ : তার ওপর থেকেই চাটুন- বাঁচার ওই একটাই রাস্তা।
চেকভের ‘মাস্ক’ অবলম্বনে সুনীত কুমারের মুখোশ নাটক প্রযোজনায় এভাবেই বুদ্ধিজীবীদের বিকিয়ে যাওয়া চৌচির মেরুদণ্ডের ছবি ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের স্পন্দন শাখা কলকাতার শিশির মঞ্চে তাঁদের ‘মুখোশ’ মঞ্চাভিনয়ের মাধ্যমে এ যুগের নির্মম বাস্তবতার কথা তুলে ধরে বিকিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবী নামক মুখোশধারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।
নাট্যনির্দেশক সমুদ্র গুহ সময়ের চাহিদা অনুসারে প্রাসঙ্গিকভাবেই নাটকীয় চরিত্রগুলির আগমন, নির্গমন, মঞ্চে উপস্থিতির বিষয়ে এবং দলগত উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন। চরিত্রগুলির মুখনিঃসৃত সংলাপ অভিনয়ের গুণে অনেক ক্ষেত্রেই বেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
দেশের শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী আদঁরে পেত্রোভিচ চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবব্রত মণ্ডল। সমবায় ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর তথা স্বনামধন্য আর এক বুদ্ধিজীবী ঝেস্তিয়াকভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনিমেষ রায়। অন্যদিকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ প্রখ্যাত সাংবাদিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৃজনী গুহ।
নাট্যসংঘটনের বহমানতায় এঁদের মুখোশ খসে পড়েছে এবং ক্রমেই প্রস্ফুটিত হয়েছে এইসব বুদ্ধিজীবীদের আসল রূপ। নাটকের অন্যতম চরিত্র ধনকুবের পিয়াতিগোরভ ওরফে মুখোশ'র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাপী দাশগুপ্ত। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন পিনাকি মুখার্জি, সুমিতা দত্ত, নির্মলেন্দু ভাণ্ডারি, সোহিনী চক্রবর্তী এবং অমিত পাল।
শশাঙ্ক মণ্ডলের আলো নাট্যকাহিনীর গুরুত্বকে যথাযথভাবে আলোকিত করেছে। নাটকের আবহ এবং মুখোশ নির্মাণ করেছেন যথাক্রমে দেবব্রত মণ্ডল ও ইন্দ্রজিৎ নারায়ণ। প্রসঙ্গক্রমে অবশেষে উল্লেখ করাই যায়, প্রেক্ষাগৃহে বসে এ নাটক দেখে মনে হতেই পারে স্পন্দন প্রযোজিত ‘মুখোশ’ই বুদ্ধিজীবীদের আসল রূপ।
Comments :0