ডাঃ সৌম্য চ্যাটার্জি
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা (WHO)। তাদের মতে বিস্তৃত আইনি অধিকার থাকলেও তা রক্ষিত হচ্ছে না কর্মক্ষেত্রে, সেই কারণেই বৈষম্যের শিকার হয়ে এবং নির্ভয়ে কথা বলার সুযোগ না পাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপের শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। দেশজুড়ে শ্রমজীবী মানুষকে সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা এবং পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ‘থ্রেট কালচার’এর বিষাক্ত পরিবেশ এই মানসিক স্বাস্থ্যের খারাপ অবস্থাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
গত ১০ অক্টোবর পালিত হয়েছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের বিষয় ছিল কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য। এরাজ্যে আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত তরুণী চিকিৎসক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, দেশজুড়ে তো বটেই বিশ্বের বহু জায়গায় সেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। মর্মান্তিক নিদারুণ ঘটনা যা আমাদের চেতনাতে ব্যাপকভাবে আঘাত হেনেছে, নিস্তরঙ্গ নাগরিক ও সামাজিক জীবনের ভিত কাঁপিয়ে তার মূল্যবোধকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। ন্যায়বিচারের দাবি উঠেছে, সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, আর কবে? ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার নাগরিক সমাজের আলোড়ন প্রশ্ন তুলছে, যেখানে কর্মরত একজন ডাক্তারকে তার নিজের হাসপাতালের, নিজের সেমিনার রুমে চূড়ান্ত নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরে জীবন হারাতে হয়েছে, যেখানে জীবনের নিশ্চয়তা নেই সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য তো অনেক পরের কথা। এমন প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শমতো মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কী করে!
বাস্তবে এরাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে শাসকদল যেভাবে দখলদারি কায়েম করেছে তাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ উবে গেছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। লুটের জন্য দুর্নীতিচক্র চালাতে দুষ্কৃতীতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। এটাকেই বলা হচ্ছে ‘থ্রেট কালচার’। আর জি কর হাসপাতালের ঘটনায় তা সামনে এসে গেছে। প্রতিবাদে নাগরিকরা সরব হতেই দেখা যাচ্ছে, সিইএসসি কিংবা টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়া থেকে শুরু করে আরও সব প্রতিষ্ঠানেই এই ‘থ্রেট কালচার’ চলছে। কেবল মেডিক্যাটল কলেজগুলোতে নয়, পঞ্চায়েতে, পৌরসভায়, অফিসে, ক্লাবে, ষ্টুডিওপাড়াতে সর্বত্র। প্রতিবাদ করলে জুটবে বদলি, নয়তো প্রমোশন নাকচ, কর্মক্ষেত্রে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি এবং গুরুতর হেনস্তা। বর্তমান শাসকদলের জমানায় এটা এমন জায়গায় পরিণত করা হয়েছে, যেখানে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর না শোনাটাই দস্তুর, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখতে বলেছেন। হয়তো আমাদের তরুণী চিকিৎসক তিলোত্তমা সেটা করেননি বলেই শাসক দলের চক্ষুশুল হয়েছিলেন, দেওয়া হয়েছে এমন পরিণতি যাতে সন্তর্পণে সমাজকে একটি ভয়ের বার্তা দেওয়া যায়। যেখানে একছত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে তাদের পরিণতি হবে এইরকম। সমস্যা হচ্ছে, এই পরিবেশে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা কী করে অগ্রাধিকার পাবে!
কিন্তু ইতিবাচক লক্ষ্মণও আছে। বাংলার মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মানুষ কিন্তু এইবার আর ব্যাকফুটে নয়, তাঁরা সরব হয়েছেন জাস্টিসের দাবিতে। বলছেন তাদের না পাওয়ার কথা, অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হওয়ার কথা, কর্মক্ষেত্রে আর তাদের দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এটা সর্বাগ্রে দরকার, কারণ ভয় যেমন সংক্রামক ভয় ভেঙে প্রতিবাদ করাটা কিন্তু তার থেকেও বেশি সংক্রামক।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন তিলোত্তমা একজন ডাক্তার বলেই কি এত বড় আন্দোলন হচ্ছে? তিনি যদি একজন পুরুষ হতেন, একজন ডাক্তার না হয়ে পরিচারিকা হতেন বা গৃহবধূ হতেন তাহলে কি একই ভাবে প্রতিবাদ হতো? সম্ভবত সমাজের সর্বস্তরের নানা পেশার নানা অংশের মানুষের মনে এই দখলদারির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে আছে বলেই মানুষ কিন্তু এভাবে প্রতিবাদে নেমেছেন, যাতে আর কাউকে তিলোত্তমার মতো বিপদে পড়তে না হয়।
কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজে মহিলাদের বিশেষভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয় এবং তার জন্য তাঁদের বিশেষভাবে মানসিক চাপের শিকারও হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষময়ের স্বীকার হন মহিলারা, যার জন্যে তাদের আজীবন লড়তে হয়, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই পিতৃতান্ত্রিকতার, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এর জন্য বিশেষ মানসিক শক্তির প্রয়োজন তো আছেই। কিন্তু প্রতিবাদ করাটা রপ্ত করানোর দায়িত্ব আমাদের এই সমাজের কৈশোর থেকে। শিশুকে বড় করে তোলার সময় যদি সমাজে নারী পুরুষ ভেদ করে বড় করা হয় তাহলে সেই পরিবার বা সমাজ কিন্তু মোক্ষম সময় নিশ্চুপ থাকবে, তার থেকে ভালো কিছু আশা করা বৃথা।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য লক্ষণীয়। কর্মক্ষেত্রে ওয়ার্কিংলোড নিয়ে কোনও পুরুষ কর্মচারী প্রশ্ন করলে তার ক্ষেত্রে বলা হয় স্ট্রেস হ্যান্ডেল করা বা চাপের মোকাবিলা করা শিখতেই হবে। তুমি আনফিট হলে কাজ ছেড়ে দাও, অন্য অনেকে অপেক্ষা করছে (survival of the fittest!) আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বলা হয়, কী দরকার এত চাপ নেওয়ার, যা হয়েছে জীবনে যথেষ্ট, এবার সুখে সংসার করো। মানে এই কর্ম সঙ্কটের সময় মেয়েদের চাকরি করা মানেই জায়গা নষ্ট। তারপর আবার মেটারনিটি লিভ সহ নানা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে মেয়েদের। তাই চাকরির বাজারে উপযুক্ত প্রার্থী হওয়া মানে তোমার মৌলিক অধিকার ভুলে গিয়ে কোম্পানির স্বার্থে (মালিকের স্বার্থে) কোনও প্রশ্ন না করে কাজ করে যাও, যার কোনও সময়সীমা নেই সে তুমি ওয়ার্ক ফ্রম হোমই করো আর অফিসে বসে থেকে কাজ করো।
শোষণের চূড়ান্ত জায়গায় আজকের কর্পোরেট ব্যবস্থা। অসংগঠিত শ্রমিকদের কথা তো বাদই দিলাম। একটি ঘটনার উল্লেখ করি। পুনেতে এক টেক তরুণীর অকাল মৃত্যু ঘটেছে, যা নিয়ে তাঁর মা প্রশ্ন তুলেছে, কর্মস্থলের পরিবেশ ও নীতি নিয়ে। শোনা গেছে রাহুল গান্ধী নাকি এটা পার্লামেন্টে তুলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কোভিড পরবর্তী সময় পুঁজিবাদের দৈন্যতা চূড়ান্ত, সর্বক্ষেত্রে কর্মসঙ্কোচন আর এই অস্থিরতার অনিশ্চিয়তার সুযোগ নিয়ে চলছে যথেচ্ছ অন্যায় শোষণ, পরিবর্তিত হচ্ছে শ্রম কোড যাতে একদিকে তুচ্ছ কারণে চলে কর্মী ছাটাই অন্যদিকে রয়ে যাওয়া কর্মীদের আরও কম বেতনে বেশি খাটিয়ে কি করে মালিকের হাতে মুনাফা তুলে দেওয়া যায়। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। মালিকের ঠিক করে দেওয়া কাজের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে কীভাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় কর্মীদের, কীভাবে লাঞ্চিত করা হয় তার অজস্র উদাহরণ সমাজে ছড়িয়ে আছে। যাদের নিয়োগই অস্থায়ী, উর্ধ্বতনকে সন্তুষ্ট করে চলা ছাড়া কাজ টিকিয়ে রাখার কোনও শর্তই নেই, তাদের কাছে প্রতিদিনই মানসিক চাপের।
বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগে তাই মানসিক স্বাস্থ্যর কথা শুনতে ভালো লাগে, সেমিনার কিংবা ওয়ার্কশপের আলোচনাতে ভালো লাগে বাস্তব মাটিতে দাঁড়িয়ে তার প্রয়োগ নিয়ে ভাবা খুবই কঠিন। কিন্তু আজকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ বুঝছে কেন দরকার সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া, কেন প্রতিবাদ করা দরকার কর্মক্ষেত্রে, কেন শ্রমিক মজুরদের ইউনিয়ন দরকার, কেন দরকার ধর্মঘটের। এমনি এমনি জোমাটো সুইগির বা টেকনোলজি গ্রুপের কর্মীরা ইউনিয়ন খোলেননি, অনেক অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে জেনেছে তাদের কর্মক্ষেত্র মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে গেলে একটা ধর্মঘটের অধিকার দরকার ন্যায্য দাবি আদায় করতে। তবে বাকিদের টনক নড়বে।
আর যে মহিলা গৃহবধূ সে তো এই সমাজে এমনিতেই পরাধীন, পরনির্ভরশীল। সে তো নাকি কোনো মুনাফা উৎপাদন করতেই পারে না উলটে তাকে নাকি ভরনপোষণে খরচ। তার কর্মস্থল তো দূরের কথা (সংসারের জোয়ালে উদয়-অস্ত খেটে যেতে হবে), প্রাত্যহিক জীবনে তার পছন্দ অপছন্দের, চাওয়া পাওয়ার হিসাব রাখা হয় ক’টা সংসারে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্যে জোর দেওয়ার পরে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও এই ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ কি ভাববে?
আর বৈবাহিক ধর্ষণ! সে তো আরও ভয়ানক। সমাজে নারী কেবল ভোগ্য বস্তু, এই মানসিকতা থেকে জন্মায় অধিকারবোধ, তারই চূড়ান্ত পরিণতি ধর্ষণ। বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমনকি বৈবাহিক ধর্ষণও। অথচ বিষয়টা এত সেনসিটিভ যে বহু মহিলাই এর সম্পর্কে অবগত নয়, ভাবেন তাঁদের কর্তব্য স্বামীকে এভাবেই তুষ্ট করা।
পরিশেষে বলি হোমো সেপিয়েন্সের গঠন এই রকম যে সে ইঞ্জিনিয়ার হোক, ডাক্তার হোক আর গৃহপরিচারক বা পরিচারিকা হোক, প্রভাবিত হয় পরিবেশের প্রভাবে। যে অভাগা কাজ করতে এসে প্রত্যহ তাঁর মালিকের কাছে যৌন হেনস্তার স্বীকার হয় তাঁরও মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। সমস্যা হলো সেটাকে সে দেখছে কেমনভাবে, যদি ভেবে থাকে এটাই তার ভবিতব্য (যেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে) তাহলে দোষ আমাদের, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়। আর্থিকভাবে দুর্বল মানে তাঁর প্রতিবাদের মৌলিক অধিকার নেই এটা ভাবা ভুল। আবার বলবো অন্যায়ের প্রতিবাদ অত্যন্ত সংক্রামক, একবার রপ্ত করলে কখনো ভুল হবে না। আর তাহলেই মানসিক স্বাস্থ্য বলিষ্ঠ হবে।
এই জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, lets talk, speak out...। তাই গলা ছাড়ো, দৃপ্ত কণ্ঠে বলো- আর কবে? আর কবে?
Mental Health
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বাধা ভীতির পরিবেশ
×
Comments :0