শান্তনু চক্রবর্তী
ছবি: মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে
অভিনয়ে: রানী মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, জিম সারাড, বরুণ চন্দ, নীনা গুপ্তা।
পরিচালনা: অসীমা ছিব্বার।
যে ছবির নামেই একটা ‘বনাম’ বা সংঘর্ষের ইঙ্গিত জুড়ে দেওয়া আছে। লড়াইটাও সেখানে একেবারে গোড়ার দৃশ্য থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে! একটা গাড়ি পোর্টিকো ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে! গাড়ির বন্ধ কাচের আড়ালে কয়েকজন বিদেশিনী, তাদের কোলে একটি শিশুকে আবছা দেখা যাচ্ছে। শাড়ি পড়া এক ভারতীয় যুবতী, আকুল হয়ে সেই গাড়ির সঙ্গে দৌড়চ্ছেন, গাড়ির কাচের গায়ে পাগলের মত দু’হাতে চাপড় মারছেন। গাড়ির গতি বাড়তেই যুবতী ছিটকে পড়ে গেলেন। আবার উঠে দাঁড়িয়ে মরিয়া ছুট। গাড়ি ততক্ষণে বড় রাস্তায়। নাগাল পাওয়া অসম্ভব জেনেও মেয়েটি পেছন-পেছন দৌড়ে যান কিছুটা। হুমড়ি খেয়ে পড়েও যান রাস্তার ওপর। নিষ্ঠুর পাথুরে রাস্তায় মাথা ঠুকে রক্ত বেরোয়। আহত, আর্ত মেয়েটি জল আর যন্ত্রণা ভরা চোখে সামনের দিকে তাকিয়েই থাকেন।
এভাবেই ছবির একেবারে শুরু থেকেই এক সাধারণ ভারতীয় নারীর এক নাটকীয় ব্যক্তিগত প্রতিরোধের ন্যারেটিভটাকে সরাসরি সামনে নিয়ে আসা হয়। এবং বেশ খানিকটা চড়া, অতিনাটকীয় ভঙ্গিতেই সেটা করা হয়। হয়তো ছবির নির্মাতাদের মনে হয়েছিল, সুর একটু বেশি না চড়ালে, তাঁরা যে মানবিক পারিবারিক ট্র্যাজেডিটার কথা বলতে চাইছে, সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শকের কাছে পৌঁছাবে না! তাঁদের এই ভাবনাটা ঠিক না ভুল, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে প্রথম সিকোয়েন্সেই আমরা যে মেয়েটিকে নরওয়ের একটি বন্দর শহরের রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে দেখি, চিত্রনাট্য কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে সেই মেয়েটি মানে মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জি ও তাঁর স্বামী অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে। সেখানে আড়াই-তিন বছরের ছেলে শুভ আর কয়েক মাসের শিশু কন্যা শুচিকে নিয়ে দেবিকার আপাত-সুখের সংসার। সেখানে অশান্তির খচখচে কাঁটা বলতে নরওয়ে সরকারের শিশু সুরক্ষা সংস্থা। সংস্থার দু’জন মহিলা কর্মী যখন তখন দেবিকাদের বাড়ি চলে আসেন। দুই সন্তানকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত দেবিকার ঘরকন্নার ওপর কড়া নজর রাখেন। রান্নাঘর থেকে খাওয়ার টেবিল। বাগানের দোলনা থেকে শোওয়ার ঘরের বিছানা— দেবিকার ব্যক্তিগত পরিসরের সমস্তটাই প্রবল শিশু যেন কল্যাণকামী এবং নিজেদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বে মশগুল এবং রাষ্ট্রের ভয়ানক নজরদারির সামনে বেআব্রু পড়ে থাকে! সারাক্ষণের অস্বস্তি সুদ্ধই দেবিকা তবু তাঁর ভারতীয় তথা বাঙালি সুলভ সৌজন্যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করেন। তাদের আতিথেয়তা দেখান। এমন কি ব্রেকফাস্টে গরম ফুলকো লুচি খাইয়ে আপ্যায়নেরও চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরেও সে দেশের শিশু সুরক্ষা নিয়ামক নিজেদের বিবেচনা মাফিক এবং রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়। বাচ্চাদের মা-বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে রাষ্ট্রের হেপাজতে নেওয়া হয়। এমন কি আদালতেও ‘প্রমাণ’ হয়ে যায়, বাবা-মা হিসেবে দেবিকা আর অনিরুদ্ধের ছেলে-মেয়ে মানুষ করার যোগ্যতা নেই। বিশেষ করে দেবিকার মানসিক স্বাস্থ্যের যা হাল,তাতে তাঁর কাছে তো বাচ্চাদের ফেলে ‘বিপজ্জনক’! সুতরাং বিচারপতির রায় বাচ্চারা বড় হবে ‘ফস্টার’ বা ‘পালক’ পরিবারের আশ্রয়ে। ১৮ বছর বয়েস অবধি দেবিকারা শুধু বছরে দুবার সন্তানদের মুখ দেখতে পাবেন। এখান থেকেই ‘মিসেস চ্যাটার্জি বনাম নরওয়ের’ যুদ্ধটা শুরু হয়ে যাচ্ছে! আর যুদ্ধটা চলতে চলতেই শ্রীমতী দেবিকা চ্যাটার্জি ক্রমশ বুঝতে পারেন, তাঁর এই লড়াই যেমন একটা আস্ত রাষ্ট্র; সরকার ও সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সেদেশের কিছু ধারণার বিরুদ্ধে তেমনই তাঁর নিজের পরিবার সমাজ, সেই সমাজের মগজে গেড়ে বসে থাকা অজস্র পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গেও।
এই মূল্যবোধই তো দেবিকা-অনিরুদ্ধের দাম্পত্যের চলতি কাঠামো বা ব্যবস্থাটাকে বৈধতা দেয়। সেখানে বধূটি ঘর সংসার সন্তান সামলাবেন। বরের ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনার সময়মতো যোগাবেন। বাড়ির আরও পাঁচটা হিজিবিজি ঝামেলা মেটাবেন আর পতিদেবতাটি শুধু নিজের চাকরি-কেরিয়ার ও সম্ভাব্য নাগরিকত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। দেবিকা তাঁর ছেলেকে চামচের বদলে হাতে করে মেখে খাওয়ান, বাচ্চাকে সঙ্গে করে এক ঘরে, একই বিছানায় ঘুমোতে যান এইসব অভিযোগের পাশাপাশি অনিরুদ্ধ সংসারের কাজে দেবিকাকে সাহায্য করেন না, শিশু সুরক্ষা সংস্থার তরফে এই নালিশটাও গুঁজে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু। এমনকি গার্হস্থ্য হিংসার একটি ঘটনায় অনিরুদ্ধ যে একবার আক্ষরিক অর্থেই মেরে দেবিকার হাড় ভেঙে দিয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষের কাছে সেই খবরটাও ছিল। এবং চ্যাটার্জি পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নরওয়ে সরকার এইসব তথ্যের তিরগুলোও সযত্নে তূণ থেকে বের করে এনেছিল। এখন গড়পড়তা ভারতীয় তথা বাঙালি দাম্পত্যে স্বামীটি সংসারের কুটোটি না ভাঙলেও মস্ত কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। এমন কি একটু আধটু গৃহ হিংসাও বধূটি হজম করে নিতে পারে! অনাবাসী পরিবারেরও এর ব্যতিক্রম হয় না। মেয়েটির পরিস্থিতি, অসহায়তা তাকে মেনে নিতে বাধ্য করে।
দেবিকাও এভাবে মেনে বা মানিয়ে নিয়ে তাঁর দাম্পত্যের চাকাটা মোটামুটি গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একদিকে একটা সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা ভিনদেশি সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং অন্যদিকে পরিবারের ভেতরেই পুরুষের স্বার্থকেন্দ্রিক একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ যখন একজন মা হিসেবে তাঁর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে, তখন তিনি ঘুরে বা রুখে দাঁড়ান। তাঁকে রুখে দাঁড়াতেই হয়। এভাবেই ছবির একটা ন্যারেটিভের ভেতর আরেকটা ন্যারেটিড, একটা লড়াইয়ের মধ্যে অন্য একটা লড়াই ঢুকে পড়ে। ফলে শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়ের একক প্রতিরোধের যুদ্ধটা শুধু ‘বনাম নরওয়ে’ হয়েই থাকে না। বনাম স্বদেশী পিতৃতন্ত্রও হয়ে ওঠে। ছবিতে এই সুপ্ত জাতীয়তাবোধ আর সূক্ষ্ম পুরুষতন্ত্র বিরোধিতার ন্যারেটিভের মাঝখানে সেতুর কাজটা করেছে দেবিকার মাতৃত্বের আবেগ। শুরুতে যে লড়াইটা ছিল চ্যাটার্জি পরিবার বনাম নরওয়ে সরকারের। সেটাই কিভাবে শুধু দেবিকার একার লড়াই হয়ে উঠল, চিত্রনাট্যকার দেখিয়েছেন। তবে চিত্রনাট্যে গোটা প্রক্রিয়াটা যেভাবে ঘটেছে, তাতে দর্শকদের মনে হতে পারে, নারী পরিচালক এখানে ছবির নারী প্রোটাগনিস্টের প্রতি একটু বেশি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। ফল অনিরুদ্ধের চরিত্রটা মোটামুটি একটা ভারসাম্যের ধূসর এলাকা থেকে সরতে সরতে একেবারে পাকা ভিলেনের কালি গোটা গায়ে মেখে ফেলেন। এই চরিত্র রূপায়ণে কলকাতার অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য অবশ্য যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। স্বার্থপর, ম্যাসিপুলেটিভ স্বামী, খান্ডারনী মায়ের আদূরে খোকা থেকে ঘোর ষড়যন্ত্রকারী খলনায়ক তাঁকে কখনোই কোনো বেমানান ভূমিকাতেই লাগেনি। কিন্তু ছবির বিশ্বাসযোগ্যতা বোধহয় কোথাও একটু টাল খেয়েছে।
আসলে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ তথাকথিত ‘ফিক্সন’ ছবিতে এটাই সমস্যা। এতদিনে আমরা সব্বাই জেনে গেছি যে এই ছবির চ্যাটার্জি দম্পতি আসলে সাগরিকা চক্রবর্তী ও ভূপদার্থবিদ অনুরূপ ভট্টাচার্য, যাঁরা সদ্য বিয়ের পর ২০০৭ সালে নরওয়ে যান। ২০০৮ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান অভিজ্ঞানের জন্ম হয়। ২০১০-এ কন্যা ঐশ্বর্য পৃথিবীতে আসে। সমস্যার শুরু তারপরেই। ২০১১-য় নরওয়ের শিশু সুরক্ষা সংস্থা ‘বারানভেরেন্ট’ দুটি শিশুকেই মা-বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পালিকা পরিবারের কাছে জমা করে দেয়। আর এখান থেকেই সাগরিকাদের (যা শুধু সাগরিকার) লড়াই শুরু হয়। যা শেষ হচ্ছে ২০১৩-য় কলকাতায় যখন কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি দুটি বাচ্চার মাতৃত্বের সম্পূর্ণ অধিকার সাগরিকাকে ফিরিয়ে দেন। এই আসল ‘মিসেস চ্যাটার্জি’র অগ্নিপথ যাত্রার আখ্যান ধরা আছে ২০২১ সালে প্রকাশিত সাগরিকার দুঃসহ স্মৃতিকথা ‘দ্য জার্নি অফ এ মাদার’ বইটায়। এই বই, সেই সঙ্গে সাগরিকার সঙ্গে নানান সময় লম্বা লম্বা ভিডিও চ্যাট-ই অসীমার এই তথাকথিত কল্পকাহিনিচিত্রের ভরকেন্দ্র এখন অসীমা যদি আইন বাঁচাতে সব চরিত্র কাল্পনিক গোছের ‘ডিসক্লেইমার’ এর আড়ালে না লুকোতেন, তাহলে তিনি হয়তো সাগরিকার বইয়ের তথ্য ও তাঁর নিজের বিবৃতিকে আরও অন্যান্য ‘সোর্স’ থেকেও যাচাই করে নিতেন। ছবির সময় ও ঘটনাক্রমকেও আরও নির্দিষ্ট করতেন। তাহলে জানা যেত, যে ছবির পুরো ঘটনাটাই কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়ে ঘটছে। সেখানে অতিথি শিল্পী নীনা গুপ্তা অভিনীত শ্রীমতী কামাথের মতো কোনো বিদেশমন্ত্রীর চরিত্র থাকতে পারে না। হ্যাঁ, এটা ঘটনা যে সিপিআই(এম)-এর পলিট ব্যুরোর সদস্য ও সর্বভারতীয় গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী বৃন্দা কারাতের পাশাপাশি লোকসভায় তখনকার বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজও, সাগরিকার ঘটনায় ভারতীয় বিদেশমন্ত্রককে সজাগ ও সক্রিয় করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তো কিছুতেই বিদেশমন্ত্রী থাকতে পারেন না!
আসলে এই ধরনের ছবিতে স্থান-কাল-ঘটনাক্রম ঠিকঠাক রাখাটা খুব জরুরি। নইলে নরওয়ে সরকার এই ঘটনায় যথেষ্ট অমানবিক, অসংবেদনশীল ও অনেকটাই জাতি বিদ্বেষী মনোভাব দেখালেও, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত পুরো ছবিটাকেই কাল্পনিক বা মনগড়া বলে উড়িয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন। আসলে শিশু সুরক্ষা সংস্থা ‘বারানভেরেন্ট্’-এর নাম পালটে ছবিতে ‘ভেলফ্রেড’ করলে তেমন সমস্যা নেই। সংস্থার দুই মহিলা কর্মীকে যদি সারাক্ষণ হলিউড হরর যদি ভ্যাম্পের মতো মনে হয়, তখন যেন ছবিটা একটু খেলো হয়ে যায়! কিংবা অনিরুদ্ধের মাকে যদি প্রথম থেকেই মেগাসিরিয়ালের বউকাটকি শাশুড়ি লাগে তাহলেও দেবিকা তথা সাগরিকার দ্বিমুখী লড়াইয়ের গুরুত্ব ও অভিঘাতটাও যেন একটু হালকা লাগে। দেবিকার ভূমিকায় রানি মুখোপাধ্যায়ের আসল কৃতিত্ব, চিত্রনাট্যের নানান দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা পেরিয়েও তিনি একজন একলা মায়ের আবেগ ও সংগ্রামের শুদ্ধতাকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। সেটাই আসল কথা। পুনশ্চ ছবির এন্ড টাইটেল-এ এই মুহূর্তে জার্মানিতে এক গুজরাটি দম্পতিকে, তাঁদের শিশুকন্যার অধিকার নিয়ে যে একই রকম জাতিবিদ্বেষ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর একটা অঙ্গীকার থাকতে পারত। তাহলে ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে’-র প্রাসঙ্গিকতা আরও একটু বাড়ত।
Comments :0