দেবাশিস চক্রবর্তী
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত সম্প্রতি সঙ্ঘের পত্রিকাগুলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘হিন্দুত্ব’ সম্পর্কে সঙ্ঘের মৌলিক ধারণাগুলিকে নতুন করে বলেছেন। একটি কথা স্পষ্ট, সাভারকার, হেগড়েওয়ার, গোলওয়ালকারের সময় থেকে এই ধারণার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। যেভাবে এতকাল সঙ্ঘ ভেবে এসেছে, সেভাবেই এখনও সঙ্ঘ ভাবছে যে এই দেশ শুধু হিন্দুদের, হিন্দু ‘জাতির’। হিন্দুরা বহুকাল ধরে যুদ্ধে রয়েছে। নতুন হলো তথাকথিত ‘হিন্দু সমাজ’ এখন জেগে উঠেছে, ‘যুদ্ধরত’ সুতরাং আগ্রাসী হওয়া স্বাভাবিক। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের গন্ধ পেয়েছেন সঙ্ঘের নেতারা, তা বোঝা যাচ্ছে।
ভাগবতের সাক্ষাৎকারের একটি কথা যথেচ্ছ প্রচারিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘হিন্দুস্থান হিন্দুস্থানই থাকবে’। তিনি বা সঙ্ঘ যে-অর্থে ‘হিন্দুস্থান’ বলে থাকে, তার সোজা সাপটা ব্যাখ্যা হলো ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে হিন্দুদের দেশ। এই বিষয়ে ভাগবতের ধারণা মাঝে মাঝে মূর্খতার স্তরে নামে। যেমন কিছুদিন আগেই তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশদের দেশ ব্রিটেন, জার্মানদের দেশ জার্মানি। এ তো স্বাভাবিক যে হিন্দুদের দেশ হিন্দুস্থান হবে। আজকের সংযুক্ত যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশদের জন্য ব্রিটেন বললে আগুন জ্বলে যাবে, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড থেকে ওয়েলশে। তেমনই জার্মানরা জার্মানি বলেন না, ডয়েশল্যান্ড বলেন। পরিভাষায় এইসব হচ্ছে ‘এক্সোনিম’, এক অঞ্চলের লোক যে নামে নিজেদের ডাকে না, বাইরে থেকে আসা নাম।
ইতিহাসের সূক্ষ্ণতর গবেষণায় না ঢুকেও বলা যায় হিন্দুস্থানও একরকমের এক্সোনিম, অন্তত ছিল। কথাটি ফারসি। ‘স্থান’ শব্দটিই ফারসি। শুধু হিন্দুস্থানই না, উজবেকিস্থান, কাজাখস্থান, আফগানিস্থানে যে অর্থে ওই শব্দ ব্যবহার হয়, অর্থাৎ জমি বা ভূখণ্ড। অজস্র গবেষণায় দেখা গেছে ‘সিন্ধু’ অথবা ‘ইন্দাস’ থেকে ক্রমে এই ‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি। এর সঙ্গে ধর্ম হিসাবে ‘হিন্দু’ ধর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। বস্তুত যে সময় থেকে এই নামের প্রচলন তখন ‘হিন্দু’ ধর্ম বলে সনাতন ভারতের ধর্ম পরিচিতই ছিল না।
হিন্দুস্থানের ধারণা
তা বলে কি হিন্দুস্থানের ধারণা কল্পিত? মোটেই নয়, কখনো আজকের ভারতের খণ্ডিত অংশ, পরে গোটা দেশের ভূখণ্ডই এই নামে পরিচিত হয়েছে। অন্তত দশম শতাব্দী থেকে এই ধারণা চলে এসেছে। এর সঙ্গে ধর্ম বা জাতির কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমরা এই নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাসে একবার অন্যরকমভাবে চোখ বোলাতে পারি।
১৩১৮-এ আমির খুসরু ‘নুহ সিফির’ (নয় আকাশ) –এ হিন্দুস্থানের গুণবর্ণনা করেছিলেন। তাঁর এই কবিতায় হিন্দুস্থান আর মুসলিম বিশ্বের সীমান্ত দেশ নয়, মাতৃভূমি। বর্ডারল্যান্ড থেকে হোমল্যান্ড। খুসরুর ভাষায়, ‘ওয়াতন’।
খুসরু সাতটি কারণ দেখাচ্ছেন যে হিন্দুস্থানই কেন স্বর্গ বা ভূস্বর্গ। এর মধ্যে যুক্তি খোঁজা ঠিক হবে না, ধারণা বা আবেগটা লক্ষ্য করার। ১. হিন্দুস্থানের আবহাওয়া স্বর্গের মতো। ওই জন্য আদমকে স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করার পরে আদম হিন্দুস্থানে চলে এসেছিলেন। তার বদলে খুরাসান, আরব বা চীনে পাঠালে তিনি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পালাতেন। ২. ময়ূরকেও স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ময়ূর শুধু হিন্দুস্থানেই পাওয়া যায়— কেননা সে এখানে স্বর্গের সৌরভ পায়। ৩. সাপকেও স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সাপ পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই থাকে। কিন্তু হিন্দুস্থানই একমাত্র দেশ যেখানে প্ররোচিত না হলে সে কাউকে কামড়ায় না। ৪. আদম শুধু হিন্দুস্থানেই খেয়েছিল কেননা এখানেই স্বর্গীয় খাবারের মতো খাবার পাওয়া যায়। ৫. হজরত মহম্মদ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন হিন্দুস্থানের ফুল-ফল কেন সারা বছর ফুটে থাকে। ৬. যারা বহু দেবতার পূজা করে, তারা হিন্দুস্থানে স্বর্গ খুঁজে পায়, এই স্বর্গেই তারা বাঁচে এবং বড় হয়। ৭. খলিফা এখন হিন্দুস্থানেই থাকেন (এটি মনে হয় রাজপ্রশস্তি)।
খুসরু হিন্দুস্থানের ভাষাগুলিরও চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। ভৌগোলিক মানচিত্র ধরেই উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত আঞ্চলিক ভাষার কথা বলেছেন। কাশ্মীরি থেকে বাংলা। সংস্কৃতকে ‘সর্বজনীন’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে তা কিছু ব্রাহ্মণরাই বলতে পারেন। জটিল কিন্তু গভীর ভাষা। ভাষার মাধ্যমেও ‘হিন্দুস্থান’-এর ধারণা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।
মহম্মদ কাশিম ফিরিস্থা ‘তারিখ-ই—ফিরিস্থা’ লিখেছিলেন। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের আগে-পরে। ফিরিস্থার এই বইয়ে হিন্দুস্থানের রাজবংশের বর্ণনা রয়েছে। নিজে বিজাপুরের লোক ছিলেন, সেই অর্থে ডেকান বা দাক্ষিণাত্য। গজনী থেকে গুলবর্গা, গুজরাট থেকে বাংলা, মুলতান থেকে মালাবারের ইতিহাস নিয়ে সুবিশাল গ্রন্থ। ফারসি ভাষায় লেখা এই ইতিহাসে হিন্দুস্থানের ধারণা রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা এই বই অনুবাদ করেন, এই বইয়ের ওপরে ভিত্তিও করেন।
উপনিবেশের শক্তিই হিন্দুস্থানের এই ধারণাকে ক্রমশ মুছে দিতে থাকে। বিশেষ করে ফারসি, আরাবিক, হিন্দি, উর্দুতে লেখা ইতিহাসকে ধর্তব্যের বাইরে ঠেলে দিতে থাকে। মিলিত সংস্কৃতির ‘হিন্দুস্থান’-এর ধারণাকে মূল্যহীন করে দেওয়া হতে থাকে। যদিও ব্রিটিশ ‘রাজ’-এ হিন্দুস্থানের ধারণায় সমগ্র ভারতই এসে গিয়েছিল, শুধু উত্তর ভারত নয়।
তবে, হিন্দুস্থানের ধারণাকে শেষ করে দেওয়া যায়নি। ১৮৫৭’র বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিদ্রোহীরা ‘শাহেনশাহ-ই-হিন্দুস্থান’-কে ফের ক্ষমতায় বসাতে চেয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন।
১৯০৪ সালে লাহোরে তরুণ বিপ্লবী হর দয়াল এক সভার আয়োজন করেন। সেখানে তাঁর বন্ধু তরুণ কবি মহম্মদ ইকবালকে আমন্ত্রণ জানান। সভায় ইকবাল তাঁর নতুন লেখা কবিতা ‘হমারা দেশ’ গেয়ে শোনান। তার প্রথম লাইন ছিলো: ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা’। এই গানে স্পষ্ট যে আগে হিন্দুস্থানি, তারপর ধর্মীয় পরিচিতি।
ভগৎ সিং ছিলেন হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মির (পরে হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন) সদস্য, প্রাণের বিনিময়ে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তাঁর সাধের হিন্দুস্থানকে।
স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার সময়ে গণপরিষদের প্রথম দিকের বিতর্কে ‘ইন্ডিয়া’, ‘ভারত’-এর সঙ্গে হিন্দুস্থানও নাম হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। পরে, অবশ্য এই নাম সংবিধানে নেওয়া হয়নি। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, আধুনিক ভারত, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরে ভারতের রূপ কী হবে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ধারাগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের ধারণাই পরিস্ফুট হচ্ছিল।
১৯৫৫-তে রিলিজ করা রাজ কাপুরের ‘শ্রী ৪২০’ ছবিতে মুকেশের গাওয়া গান অমর হয়ে গেল। গীতিকার ছিলেন শৈলেন্দ্র।
‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি
ইয়ে পাতলুন ইংলিশতানি
সর পে লাল টোপি রুশী
ফির ভি দিল হিন্দুস্থানি’
এই হিন্দুস্থান এখনও চলছে।
২০১৭ সালে নেট-মাধ্যমে হুসেন হায়দারির একটি কবিতা জনপ্রিয় হয়। যার প্রথম লাইন ‘ম্যায় ক্যায়সা মুসলমান হুঁ ভাই?’ এই কবিতার কয়েকটি লাইন এইরকম:
মুঝ মে গীতা কা সর ভি হ্যায়
এক উর্দু কা আখবর ভি হ্যায়
সউ মে সে ১৪ হুঁ লেকিন
১৪ ইয়ে কম নহি পরতে হ্যায়
ম্যায় পুরে সউ মে বসতা হুঁ
পুরে সউ মুঝে মে বসতে হ্যায়
শেষ লাইন: ‘ ম্যায় হিন্দুস্থানি মুসলমান হুঁ’।
এই হিন্দুস্থানে ধর্মের তুলনায় অনেক বেশি জোরদার মিশ্র সংস্কৃতি।
হিন্দুত্বের বিকৃতি
ভাগবত যে হিন্দুস্থানের কথা ভাবছেন, তা সাভারকারই বলেছিলেন। সাভারকার যখন ‘হিন্দুত্বের’ ধারণাগত তত্ত্ব হাজির করছেন তখন সেখানে ধর্মের উপাদান প্রায় নেই। ‘হিন্দুত্ব অর হু ইজ এ হিন্দু’ বইতে সাভারকার হিন্দু পরিচিতিসত্তা তৈরির জন্য ধর্মের কথা বলেননি, বলেছিলেন জাতি, ভাষা এবং সেই প্রয়োজনেই এক অভিন্ন ভূখণ্ডের কথা। সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকার বলেছিলেন ‘নেশন’-এর কথা। সেই নেশন তৈরি হবে জাতির ভিত্তিতে। স্পষ্টই বলেছিলেন তিনি, জার্মানিতে ( হিটলারের জার্মানিতে) জাতিগত গর্ব সর্বোচ্চ রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন জাতি, যাদের শিকড় আলাদা, তারা কেন ঐক্যবদ্ধ সমগ্রে মিলতে পারে না, জার্মানি তা দেখিয়ে দিয়েছে। হিন্দুস্থানের জন্য এ খুব ভালো শিক্ষা। গোলওয়ালকার আরও লিখেছিলেন, হয় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করো, নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব ফেলে দিয়ে হিন্দু জাতিতে মিশে যাও অথবা দেশে থাকতে হলে তাদের পূর্ণ পদানত হয়ে থাক। ভাগবত সেদিন যা বলেছেন তা একথারই প্রতিধ্বনি। কী কী হলে মুসলমানরা ‘নিরাপদে’ থাকতে পারবেন, তারও শর্ত দিয়ে দিয়েছেন সঙ্ঘপ্রধান।
সঙ্ঘের হিন্দুস্থান আমাদের হিন্দুস্থান না। আমাদের হিন্দুস্থান বহু শতাব্দীর মিলিত সংস্কৃতির ফসল। কোনোই সন্দেহ নেই, এই প্রবহমান সমাজ শ্রেণি সমাজ ছিল এবং আছে। সুতরাং তাতে সংঘাত রয়েছে। ধর্ম শাসকের বর্ম হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু ধর্মীয় পরিচিতিসত্তার ভিত্তিতে জাতিগঠন, ধর্মীয় সংঘাতকে কেন্দ্রে রেখে সেই জাতির তথাকথিত ‘আগ্রাসী’ রূপ আমাদের হিন্দুস্থানের স্বরূপ না। ভাগবত বলেছেন, এখন যে যুদ্ধ হচ্ছে তা ‘অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে’। বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি কাদের ‘শত্রু’ হিসাবে খাড়া করছেন। দুনিয়া জুড়ে অতি দক্ষিণপন্থীরা এইরকমই অভ্যন্তরীণ ‘শত্রু’ খুঁজে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সমাবেশের চেষ্টা করছে। কোথাও কৃষ্ণাঙ্গ, কোথাও অভিবাসী, কোথাও অন্য ধর্মের মানুষ।
আমাদেরও একটা হিন্দুস্থান আছে। যেখানে কলে কারখানায় মজদুর রক্ত তুলে কাজ করে, মহামারীর সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোত যার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, দেনার দায়ে কৃষক যেখানে আত্মঘাতী, কাজ খুঁজে উন্মাদ হওয়া যুবক যেখানে তিল তিল করে মরছে। আমাদের মিলিত হিন্দুস্থান, আমাদের মার খাওয়া হিন্দুস্থান।
Comments :0