শুভ্রজ্যোতি মজুমদার
বাস্তুতন্ত্রের বদলে গঙ্গা হারাচ্ছে মৎস্যসম্পদ। ক্রমান্বয়ে দূষণ বর্জ্যের আধিক্য যেমন গঙ্গার দূষণ বাড়াচ্ছে তেমনই মাছের প্রজনন থেকে মাছের পরিযান সবক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করছে। মাঝখান থেকে জীবিকা হারাচ্ছেন গঙ্গাকে নিয়ে জীবিকার সন্ধান করা মৎস্যজীবীরা।
বলাগড় থেকে উত্তরপাড়া গঙ্গার পূর্বপাড় জুড়ে মৎস্যজীবীদের বাস। বহু কালের আগেকার কথা। শুনতাম গঙ্গাপাড়ের নৌকা ভিড়তো মৎস্যজীবীদের। রুপোলি মাছ দরদাম করে ঘরে নিয়ে যেতেন মানুষ। বর্ষাকালের গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে চেনা ছবি ছিলো। দিনকাল বদলেছে এককালের রুপোলি জলের শস্য আজ শুধুমাত্র মধুর স্বপ্ন। অর্থবান ছাড়া তার দেখা মেলা যায়না।
এককালে গঙ্গা পার্শ্ববর্তী মৎস্যজীবীদের আয়ের মূল উৎস ছিলো এই ইলিশ। গঙ্গায় ইলিশের পরিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আড়, রিটে বেলে ইত্যাদি মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন মৎস্যজীবীরা। ক্রমশ হুগলী নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং দূষণ পরিযায়ী মাছের ঝাঁক কে নদীর মোহনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারপর বেলে, রিটে, কুচো মাছ, চিংড়ি এগুলো ধরে আয় করতেন মৎস্যজীবীরা কিন্তু ক্রমশ সেই সুযোগ ও কমছে। মৎস্যজীবীরা বলছেন পঞ্চায়েত ভোটের আগে তড়িঘড়ি অবৈজ্ঞানিক ভাবে সেচখালগুলি পরিস্কার করার জন্য ক্রমশ পানা ও দূষিত গাদ চলে আসছে নদীতে। বেলে, রিটে চিংড়ি কাঁকড়া ক্রমশ কমছে গঙ্গায়। তারওপর অবৈজ্ঞানিক ভাবে ঘিঞ্জি জাল ব্যাবহার করায় মীন কমে যাচ্ছে গঙ্গায়। তারওপর গঙ্গার নাব্যতার তারতম্যের জন্য ক্রমাগত মাছের পরিযান মোহনার দিকে সরে যাচ্ছে। ক্রমাগত দূষণ ও প্লাষ্টিক প্রভৃতি বর্জ্য নদীতে পড়ায় মাছের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন হচ্ছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত ব্যারাকপুরে অবস্থিত সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ র মিড টার্ম রিপোর্ট থেকে মেলে বলাগড়ে ৬৭ রকমের ও গোদাখালিতে ২৪ রকমের মপ্রজাতি খুঁজে পাওয়া গেছে। সিফরি বলছে বলাগড় থেকে গোদাখালি পর্যন্ত প্রতি ১১৯ কিলোমিটার পিছু একটি করে স্যাম্পেল সংগ্রকেন্দ্র আছে। প্রতি ৫ কিলোমিটার পিছু সয়েল স্যাম্পেল ও জলের স্যাম্পেল সংগ্রহ করা হয়। রিপোর্ট বলছে গঙ্গায় ৪ টি অতি সংকটাপন্ন ৪ প্রজাতির মাছ, মাঝারি সংকটাপন্ন ১২ প্রজাতির মাছ, সংকটাপন্ন ৩ প্রজাতির মাছ, গুরুত্ব দিতে হবে এমন ১২০ টি প্রজাতির মাছ কে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত করা হয়নি এমন ৪৫ টি প্রজাতি রয়েছে তালিকায়।
সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজের রিপোর্ট বলছে বর্ষাকালে জলের তাপমাত্রা বলাগড় থেকে ত্রিবেণীর মধ্যে ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকে অন্যসময়ে তা থাকে ২২ থেকে ২৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। অন্যসময়ে জলের গভীরতা ৫ মিটার হলেও বলাগড় ত্রিবেণী ও গোদাখালির মধ্যে জলের গভীরতা বর্ষাকালে তার দ্বিগুণ ১০ মিটার পৌঁছে যায়। বর্ষাকালে বলাগড় ত্রিবেণি ও গোদাখালির মধ্যে জলের অম্লতার তারতম্য দেখা যায়। সমীক্ষা বলছে ত্রিবেণী ও গোদাখালির তূলণায় বলাগড়ের জলে অম্লতা দাড়ায় ৮ মাত্রা। সেখানে ত্রিবেণী ও গোদাখালির অম্লতার পরিমান দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮.৫ ও ৯ র কাছাকাছি। সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান বর্ষাকালে বলাগড় থেকে গোদাখালির মধ্যে অনেকটাই কমে যায়। সারা বছর যেখানে ৮ পিপিএম র কাছাকাছি মাত্রা থাকে সেখানে বর্ষাকালে নেমে যায় অনেকটাই। জিপিপি অর্থাৎ গ্রস প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি রিপোর্ট অনুসারে এলাহাবাদ ও বারানসীর তূলণায় বলাগড় ও গোদাখালিতে প্লাংটনের পরিমান কম। সে তুলনায় এলাহাবাদ ও বারানসিতে প্লাংটনের পরিমান বেড়েছে। সে তুলণায় জলে ক্লোরোফিলের মাত্রা সারা বছরে বলাগড় থেকে গোদাখালির মধ্যে প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ মিলিগ্রাম করে থাকে। বর্ষাকালে সেটা অনেকটা কমে ঠিকই তবে সারা বছর তার পরিমান মোটামুটি একরকম থাকে। এটাই কি মাছের পরিমান কমার মূল কারণ সেটা বলা মুশকিল বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক ভবানীশঙ্কর জোয়ারদার বলেন আমি সেই অর্থে ফিশারির লোক নই আমি আশুতোষ কলেজের স্নাতকোত্তর পরিবেশ বিভাগ যখন হয় আমি কাজ শুরু করেছিলাম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঐ দায়িত্বে ছিলাম। তারপর অন্য একজন দায়িত্বে এসেছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে আশুতোষ কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম ২০০৩ সালে আমি অবসর নিয়েছি। অবসরের পর স্নাতকোত্তর পরিবেশ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিবেশ চর্চায় অভিজ্ঞতা আছে বলে সেই হিসেবে ফিশারির কথাটা কিছুটা বলতে পারি তবে সেটা খুব একটা এক্সপার্ট ওপিনিয়ন হবেনা। তবে প্রাণীবিজ্ঞানের লোক হিসেবে কিছুটা কথা বলা যায়।
বলাগড়ের ওই অঞ্চলে নদী বেশ চওড়া আবার তার মাঝে চর পড়েছে। ওখানে সবুজদ্বীপ আছে গাছপালা লাগানো হয়েছে পিকনিক করতে যায় অনেকে। বলাগড়ে গঙ্গার স্রোত গত ২০ বছরে পরিবর্তিত হয়েছে। বলাগড়ের ওপরের দিকে পূর্বস্থলী পর্যন্ত এমন একটা জায়গা আছে সেখানে কিছু মাছের প্রজাতি মেলে যারা ওই এলাকায় জন্মায় ও সেইখানেই বংশবিস্তার করে থাকে। আমাদের দক্ষিণবঙ্গে জেলাগুলিতে বানের জল আসে। বানের জল আসা মানেই মীন ছোট মাছের বাচ্ছা চলে আসা। যার ফলে আমরা অবিভক্ত মেদিনিপুর, ২৪ পরগণা, হুগলীতে যে মাছ দেখতে পাই তার অধিকাংশও বানের জলে আসতো। সেই বিষয়টি দেখার প্রয়োজন আছে। সেই মাছ উর্ধমূখী বা নিম্নমুখী স্রোতে কোথাও যাচ্ছে কিনা, বলাগড় সহ হুগলী জেলার অন্যত্র গঙ্গায় মাছগুলি ওই এলাকা থেকে বেরোতে পারছে কিনা এটা নিয়ে তথ্য খোঁজা হল ফিশারির নিয়ম। ওই এলাকায় মাছ আর নেই মাছ জালে মিলছে না। সেটা নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। সমীক্ষা না করে এ নিয়ে কিছু বলা যাবেনা। একমাসের সমীক্ষা করে এগুলো জানা যাবেনা। কয়েক মাস ধরে সমীক্ষা করতে হবে।
বজবজ থেকে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত শিল্পক্ষেত্রের দূষণ গঙ্গাকে দূষিত করছে দেড়শো বছর ধরে। দেড়শো বছর ধরে ধিরে ধিরে নদী দূষিত করছে। এখনও গৃহস্থালীর তরল আবর্জনা গঙ্গারজলে পড়ছে শিল্পক্ষেত্র পৌরসভা এখন দাবি করে আমরা ব্যাবস্থা নিয়েছি কিন্তু তাদের দাবি কত সংগত সে নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি জানিনা যে ইতিমধ্যে ওখানে ফিশারির লোকেরা আছেন তারা পলিউশন বোর্ডে জানিয়েছেন কিনা। তবে তারা ক্লেম করতে পারেন পলিউশন বোর্ডে যে আমাদের এখানে গঙ্গা থেকে জলের স্যাম্পেল নেওয়া হোক। সেখানে জলে অক্সিজেনের পরিমান, বায়োলজিক্যাল কনটেন্ট কত আছে। এই সমীক্ষা ছাড়া কিছু বলা খুব মুশকিল। গঙ্গার মোহনা থেকে বলাগড় পর্যন্ত ইলিশ মাছ কমে গেছেন হয়ত মৎসজীবীরা এটা বলবেন। আগে হয়ত বলাগড়ে বা অন্যত্র প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়তো। এটা বুঝতে হবে ইলিশ মাছ মোহনার মাছ। এটা স্বাদু জলের নদীর মাছ নয়। গর্ভবতী ইলিশ কম লবনাক্ত জলে ডিম পাড়ে। যেগুলো ঢুকলো তারাই হয়ত জালে ধরা পড়লো। জলের গুণগত মান খারাপ হলে মাছের এই জলে ঢোকার পরিস্থিতি থাকেনা। আমর কাছে এই ডেটা নেই তবে ব্যারাকপুরে ইনল্যান্ড ফিশারির কাছে তথ্য থাকতে পারে। গর্ভবতী ইলিশ গঙ্গায় ঢুকছে কিনা বা কতটা ঢুকছে সেটা নিয়ে তারা সমীক্ষা থাকতে পারে। মোহনায় পলি জমে জমে উঁচু হয়ে গেছে যাদবপুরে ওশিওনোগ্রাফি কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা হয়ত বলতে পরবেন তার গভীরতা কমাও মাছ কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক উত্তরণ মজুমদার জানান অন্যান্য প্রাণীদের মতোই মাছেরও বংশবৃদ্ধির জন্য সঠিক পরিবেশ প্রয়োজন। তাদের বংশবৃদ্ধি তাদের সুস্থ আকার আয়তন বাড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবেশের অবদান কম নয়।
বিগত কিছু বছরে গঙ্গায় মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপের দরুন গঙ্গার পরিবেশের দ্রুত বদল হয়েছে। গঙ্গার তীর সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ এলাকা। বিভিন্ন কারণ রয়েছে যা মাছের পরিযান সহ গঙ্গায় মাছের বসবাসের যোগ্য পরিবেশের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। যার জন্য মাছ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই যেমন পয়প্রণালীর দূষিত বর্জ্য, শেষকৃত্যের পর আধপোড়া দেহ, জীবজন্তুর পচে যাওয়া দেহ, বিভিন্ন দূষণকারী পদার্থ কীটনাশক সব গিয়ে গঙ্গায় পড়ছে। যার জন্য মাছ তার স্থায়ী আবাস হারাচ্ছে।
বৈদ্যবাটি রাজবংশিপাড়ার মৎস্যজীবী হরিহর মন্ডল বলেন মাছ নেই গঙ্গায় তাই এখন বাধ্য হয়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ বা কলের কাজে যেতে হচ্ছে। গঙ্গা ক্রমশ পানা ও বিষাক্ত গাদে ভরে যাচ্ছে। আগে ভাদ্রমাসে পানা আসতো এখন বছরে তিন চারবার পানা আর বিষাক্ত গাদ আসছে গঙ্গায় ফলে মাছ ক্রমশ গঙ্গায় কমছে। আমরা জাল দিয়েও মাছ পাচ্ছিনা। গত মাসে ৪০০ গ্রামের একটা ইলিশ ধরেছিলাম ৬৫০ টাকায় বেচেছিলাম। তারপর আর তেমন মাছ পাইনি। আড় রিটে মাছ গঙ্গায় মেলে। কিন্তু সেগুলোও আর দেখতে পাচ্ছিনা।
বলাগড়ের মৎস্যজীবী কানাই বিশ্বাস প্রবীর বিশ্বাসেরা জানান। তেমন মাছ পাচ্ছিনা গঙ্গায়। আগে এক দেড় কেজির মাছ পাওয়া যেত। বিক্রি করে কোনরকমে চলতো। তারওপর বলাগড় জিরাট এলাকা গঙ্গার পাড় ভাঙন প্রবণ। দিনের একটা সময় মাছ খাবারের জন্য তীরের খুব কাছাকাছি আসে তখনই আমরা মাছ ধরি। কিন্তু এখন পাড় যেভাবে ধ্বসে যাচ্ছে ক্রমশ মাছ নদীর মাঝ বরাবর গভীর জলে চলে যাচ্ছে। আমরাও তো গঙ্গার পাড়েই থাকি ভয় হয় কখন বাড়িটা পাড় ভেঙে গঙ্গায় তলিয়ে যাবে। এখন গঙ্গায় মাছ কমে যাওয়ায় জোগাড়ের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। কি যে হবে ভবিষ্যতে ভেবে কুল পাচ্ছিনা।
হুগলী জেলা মৎসজীবী সমিতি হুগলী জেলা সম্পাদক পাঁচুগোপাল মন্ডল বলেন গঙ্গাতে মাছ দিনদিন কমছে। কিছু অসাধু মানুষ আছেন তারা কীটনাশক ব্যাবহার করেন মাছ ধরতে। যার জেরে ক্রমশ মীন ধ্বংস হচ্ছে হুগলী নদীতে। অন্যদিকে কর্পোরেটতন্ত্রের প্রভাব এসে পড়েছে ভেড়িতেও। সরকার এখন কর্পোরেটদের সুযোগ দিতে চাইছে ভেড়ির মাছ ধরার কাজে। ফলে মৎস্যজীবীদের সমিতি বা কো অপারেটিভ সোসাইটি গুলি যেগুলি ছিলো ক্রমশ তারা প্রভাবিত হচ্ছে। গরীব মানুষগুলি যৌথ ভাবে মাছ ধরে আয় করছিলেন তারা বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির প্রতিযোগীতার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে গঙ্গাতীরবর্তী কারখানার দূষিত বর্জ্য শোধন না করেই হুগলী নদীতে পড়ছে এতে যেমন নদী দূষিত হচ্ছে তেমনই মাছ কমছে। বহু মৎস্যজীবী তাদের জীবিকা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। বামফ্রন্ট আমলে মৎস্যসঞ্চার প্রকল্প চালু ছিলো। বিভিন্ন মাছের মীন গঙ্গায় ছেড়ে তাদের কিত্রিম বিকাশ যাতে শুরু হয়। বলাগড় থেকে ত্রিবেণী বিভিন্ন মাছ এমনকি ইলিশ মাছেরাও বংশবিস্তার করে। এবার মাছের প্রজননের একটা চক্র বা সময় থাকে। অন্য দেশে এই সময় মৎস্যজীবীরা মাছ ধরেন না। সে দেশের সরকার সেইসময় মৎস্যজীবীদের সহায়তা করে গ্রামীণ ও শহরে বিকল্প রোজকার তৈরি করে। মৎস্যজীবীতে রক্ষার্থে বিশেষ প্রকল্প কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি মাছের পরিযান বজায় রাখতে ব্যারেজ গুলিতে মাছের চলাচলের বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মাছের পরিযান ও প্রকৃতির ওপর প্রভাবের কথা মাথায় রেখে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে।
Comments :0