Post Editorial

ঋত্বিক: এক অনন্য স্পর্ধা

উত্তর সম্পাদকীয়​

সুদীপ সরকার
 

জন্মের শত বছরে পা রেখেছেন মানুষটি। স্বল্প আয়ুর জীবনে অবহেলিত, মানুষটি বারবার বিপন্নতার সাথে জড়িয়ে। মাত্র আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র, এক-দু’টি অতি সফল চিত্রনাট্য, কিছু তথ্যচিত্র এবং কয়েকটি অসমাপ্ত ছবি নিয়ে, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ‘দেশভাগ-উদ্বাস্তু জীবনের বিশ্বস্ত ধারাভাষ্যকার’— এই তকমা সাঁটানো এক চলচ্চিত্র নির্মাতা আমাদের যেন নির্দেশ দিচ্ছেন “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিশ করো” এবং আমরা সম্ভবত এক অপরাধবোধে বিব্রত হতে থাকি।
মানুষটি ঋত্বিককুমার ঘটক। ঋত্বিকচর্চা এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পরিব্যাপ্ত নয়। তবুও সময়ের ধুলো সরিয়ে ঋত্বিক-চলচ্চিত্রে এক গভীর মনোনিবেশ, বিশ্লেষণমাত্রই আমরা পাই দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষদের হাহাকার, অজস্র কো-ইন্সিডেন্স, লোকগাথা, প্রতীকের ব্যবহার, মার্কসীয় দর্শন, আর্কিটাইপইমেজ, অচেনা সাংগীতিক ব্যবহার, ভরপুর মেলোড্রামা, আশ্চর্য সব ফ্রেম সহ বহুবিধ মণি-মাণক্যের সন্ধান যা পূর্ববর্তী ভারতীয় চলচ্চিত্রে এমনকি সমসময়ের চলচ্চিত্রেও ব্যবহৃত হয়নি।
‘অযান্ত্রিক’। বিশ্ব চলচ্চিত্রে কোথাও সেই সময়কালে এক যন্ত্রের সাথে মানুষের ভালোবাসা, প্রাণসঞ্চারের ভাবনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিল অকল্পনীয়। ত্বনিষ্ঠ অন্বেষণে এই প্রশ্ন কি ওঠে না, বাংলার সব শ্যামলিমা ছেড়ে ঋত্বিক কেন ছুটলেন রুখুশুকু পাথুরে প্রান্তরে? বিশেষ করে সেই সমাজে যন্ত্র যুগের অমানবিকতায় আছে ‘মুক্তধারা / রক্তকরবী! এ এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঋত্বিক-সৃজনকে খোঁজা। ডেরেক ম্যালকম উদ্ধৃত করি: “পরিচালক (ঋত্বিক) বলেন,..‘যন্ত্রের ধারণা সবসময়ই আমাদের কাছে বিকটাকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল; যেন যন্ত্র আমাদের সমস্ত ভালো কিছুকে, সমস্ত চিন্তাশীলতাও অধ্যাত্মিকতাকে ধ্বংস করে দেয়’। ঋত্বিকের ‘অযান্ত্রিক’ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করে, অথবা অন্ততপক্ষে রোমাঞ্চকরভাবে যাচাই করে নিতে চায় (টাইগার, ১৯৮২)”। আরও প্রশ্ন, ওঁরাওরা কেন? উত্তর দিয়েছেন স্বয়ং ঋত্বিক: “..বিমল তাকে পাগল বলতে পারেন, শিশু বলতে পারেন, আদিবাসী বলতে পারেন। কারণ এক জায়গাতে তিনজনই এক। সেটা হচ্ছে জড় বস্তুতে প্রাণ আবেগ করার প্রবণতা। এবং এটি একটি...আদিম প্রতিক্রিয়া” (চলচ্চিত্র চিন্তা)। বিমল অস্বাভাবিক, কল্পনাপ্রবণ এবং যখন তার সাথে যুক্ত হয়ে যায় ওঁরাওদের বহু সাংকেতিক নৃত্যের সমাবেশে মহাযাত্রা দৃশ্য, এক নতুনতর মাত্রা যুক্ত হয়। বুলাকি পাগলের নতুন গামলা পেয়ে পুরানোটিকে ভোলা, এক শিশুর হাতে জগদ্দলের  হর্নটি বাজানোর মধ্যে বিমলের উপলব্ধির হাসি—“অযান্ত্রিকের মৌল উপজীব্য ছিল এইটাই; যাকে আমরা...জীবনের নিয়ম বলতে পারি”(ঋত্বিক-ঐ)। যা আদতে ছিল এক কাহিনি মাত্র, ঋত্বিক তা রূপান্তরিত করেন এক সন্দর্ভে। কি দুরূহ সেই উপস্থাপন!
এই ‘অযান্ত্রিক’-এ আমরা দেখি চরিত্র স্থাপিত হচ্ছে নিসর্গের মধ্যে। নিসর্গঋত্বিক-চলচ্চিত্রে এক অনন্য উপস্থাপন বৈশিষ্ঠ্য, গভীরভাবে ব্যক্তি চরিত্রের সাথে সম্পৃক্ত। এই বিশিষ্ট ‘দেখার চোখ’ ঋত্বিক শুধুমাত্র আইজেনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, অবন ঠাকুর ইত্যাকার মনীষিদের থেকে আহরণ করেননি। অন্যতম পাথেয় ছিল দেশজ ঐতিহ্যের ঐশ্বর্য-গান, লোককথা, দেশজ উপাখ্যান।
লো আ্যঙ্গেল ঋত্বিকের খুব প্রিয়। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ঋত্বিক ব্যবহার করেছেন এক্সট্রিম লো আ্যঙ্গেল। সাথে জুড়ে দিয়েছেন ওয়াইড আ্যঙ্গেল লেন্স। ‘কইলকাত্তা’ ছিল কাঞ্চনের কাছে এক স্বপ্নের শহর। ক্যামেরার যে চোখ দিয়ে সে হাওড়া ব্রিজ দেখে, নিশ্চিতভাবেই কোনও ভারতীয় চলচ্চিত্রে এই উপস্থাপন সুদূর কল্পনার অতীত। কংক্রিটের জঙ্গলে আকাশ ফোঁড়া এই দানবসম অট্টালিকা আমরা দেখি কাঞ্চনের চোখে। ঠিক তার বিপরীতে নীচের মহলের হতদরিদ্র মানুষদের দেখে কাঞ্চন ভীত হয় না, অসহায় হয়ে পড়ে। এ শহরের পার্কের রেলিং কাঞ্চনের কাছে যেন জেলের গরাদ।
কাঞ্চন একমাত্র স্বস্তি পায় বুলবুল-ভাজা বেচনেওয়ালা হরিদাসের কাছে। স্বপ্নভঙ্গ ঘটে কাঞ্চনের। হরিদাসই কাঞ্চনকে নিজের গ্রামে ফিরতে সাহায্য করে। 
‘মেঘে ঢাকা তারা’। ঋত্বিক ব্যবহার করেছেন আর্কেটাইপ। সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনায়। শুরুতেই সেই বিশাল গাছ, যা একচালার বক্ররেখার অংশকে মনে পড়তে বাধ্য করে, সেই বক্ররেখার নিচে থেকেই বেরিয়ে আসে নীতা। যেন জন্ম নিচ্ছে নীতা! এবং ঠিক সেই সময়ে সাউন্ডট্র্যাক জুড়ে বাজে শঙ্করের মাতৃবন্দনার স্বর। কিছু পরেই জানা যায়, জগদ্ধাত্রী পূজার দিনেই নীতার জন্ম। এরপর নিয়মিত ব্যবধানে আমরা নীতাকে দেখি নানা শটে। শিরদাঁড়া সোজা, উন্নত গ্রীবা। লো আ্যঙ্গেল শট। দরমার বেড়ার মধ্যে দিয়ে বিচ্ছুরিত আলোককণার মধ্যে উন্নত গ্রীবায়নীতার মুখ নিশ্চিতভাবেই যেন এক দেবীপ্রতিমা। আর্কেটাইপেরএই অংশ সোফিয়া, বরাভয়দাত্রী। নীতাই অসচ্ছল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। 
এইখানেই ঋত্বিক আর্কেটাইপের সাথে ইতিহাসের অবতারণা করেন। আর্কেটাইপ ইতিহাসের পট পরিবর্তনের মধ্যেও অপরিবর্তিত। ইতিহাস ঢুকলেই তার ‘বিনির্মাণ’ ঘটে। নীতায় ‘দেবীত্ব’ আরোপ করেছিল নিষ্ঠুর পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু সমাজ আপন স্বার্থে। সংসার বাঁচানোর স্বার্থে। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’-ধরা পড়ে নীতা যক্ষ্মা রোগী। নীতার আর কোনও দেবী মূর্তি নেই। এমনকি পিতা তারণ মাস্টার নীতাকে ঘর ছাড়তে বলেন! সাউন্ডট্র্যাক জুড়ে বাজে মেনকার বিলাপ: ‘আয় লো উমা কোলে লই’। পাহাড়ি স্যানেটেরিয়ামে যক্ষ্মা রোগের জন্য নীতার পরিতাপ নেই। যখন শঙ্করের কাছে নীতা বারবার শোনে, নীতার অনুপস্থিতিতে পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য-উচ্ছল সংসারের কথা। তখনই নীতার আর্তনাদ-হাহাকার: ‘দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’। এবং এখানেই নীতার স্বর নিসর্গের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়। আমরা কুঁকড়ে যাই। সাউন্ডট্র্যাকে মেনকার বিজয়ার গান প্রথা সিদ্ধ আর্কেটাইপকে এলোমেলো করে দেয়। 
সঙ্গীত-ধ্বনির ব্যবহারে চলচ্চিত্র নির্মাণে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন ঋত্বিক। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র আবহ সম্পর্কে আ্যড্রিয়ান মার্টিন লিখছেন: “সাউন্ডস্কেপ বেশ সহজভাবে শ্বাসরুদ্ধকর। সাউন্ডট্র্যাকটি একটি সাহসী এবং মুক্ত উপায়ে অভিব্যক্তিবাদী:মিউজিক্যাল মুড এবং সেটিংসের এমন একটি অসাধারণ পরিসর রয়েছে– প্রাণবন্ত, বিষাদময়, হঠাৎ করে বেড়ে ওঠা এবং হঠাৎ করেই প্রতিটি দৃশ্যে কেটে যাওয়া। আপনি এটি দেখে অনুভব করছেন যে আপনি একটি শব্দ স্রোতে সাঁতার কাটছেন, জীবনের একটি সত্য সঙ্গীত”। ঋত্বিকের যে কোনও চলচ্চিত্রেই সাউন্ডস্কেপ অসাধারণ। বিশেষ করে রবীন্দ্র গান, লোকগানের ব্যবহারে। 
‘ কোমল গান্ধার’। রবীন্দ্রনাথ  লিখেছিলেন ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার মনে মনে’, বিষ্ণু দে তাঁকে টেনে আনলেন বাংলায়।  এখান থেকেই শুরু করলেন ঋত্বিক।  দেশভাগ, বাংলার গণনাট্য আন্দোলনের নেতৃত্বর বিরোধ এবং অনুসূয়ার দ্বিধাবিভক্ত মনের প্রেক্ষিতে এল বহু শতাব্দীর সুর কথা নিয়ে এক ভিন্নতর দ্যোতনা-বাজল মিলনের সুর। তাই শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা উদ্বাস্তুর গমনপথ। অনুসূয়া সাম্প্রদায়িক বিভেদে হারানো মা-কে খুঁজে ফেরে। দেশভাগের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হতে ভৃগু মগ্ন শিল্পের সাধনায়। কিন্তু সবাই যেন এক উত্তরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিখ্যাত ‘বাফার শট’ছড়ানো প্রান্তরে ভৃগু-অনসূয়া, হারিয়ে যাওয়া ট্রেন লাইন সামনে আড়াল ওঠা ‘বাফার’ এবং সাউন্ডট্রাকে আছড়ে পড়ে‘দোহাই আলি’। এক আনন্দগানে ঝরছে আকুল মিনতি: আর কোনও সর্বনাশ নয়--‘দোহাই আল্লা’। এক চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা- এক গৌরবজ্জ্বল সংগ্রামের অগৌরবজ্জ্বল পরিসমাপ্তি। মিশে যায় ভৃগু-অনুসূয়ার হাত। সাক্ষী এক পাতাবিহীন গাছ।       
স্বদেশের চলচ্চিত্রে যখন বাস্তববাদ শেষ কথা, সেই সময়ে ঋত্বিক চলচ্চিত্র নির্মাণে আনলেন মেলোড্রামার আঙ্গিক। একইসাথে ঋত্বিক চেয়েছেন: এই আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে এক ‘মহাকাব্যিয় মানসিকতা’ বা ‘মহাকাব্যিয় দৃষ্টি’ উপস্থাপন করতে। ব্রেশট যেভাবে এপিকের প্রতি টান থেকে আধুনিক এপিক থিয়েটারের জন্ম দেন, তার প্রতি ঋত্বিকের ছিল গভীর  আকর্ষণ। ঋত্বিকের ‘এপিক’ একটি জনগোষ্ঠীর জীবনের পর্বান্তর, ক্রান্তিকালীন অধ্যায়কে ব্যক্ত করে।  
‘সুবর্ণরেখা’। নবজীবন কলোনিতে অতর্কিতে জমিদারের লেঠেল বাহিনী অপহরণ করে বাগদি-বৌ, অভিরামের মা-কে। সংবাদপত্রে নিরুদ্দেশ সংবাদ প্রকাশের জন্য রিপোর্টারের উদ্দেশ্যে জনৈক কর্মচারী বলে ওঠে: ‘উদ্বাস্ত! কে না’? এই সংলাপ নিছক কোনও ব্যক্তি চরিত্রের সংলাপ নয়। হতে পারে না। ‘উদ্বাস্তু’ অর্থাৎ বাস্তুহীন। বাস্তু-বাড়ি-ভিটা-এর সাথে জড়িয়ে আছে নানা পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ক এবং বহু সময়ব্যাপী বহমান নানা রঙেরছন্দের সংস্কৃতির শিকড়। সব ফালাফালা হয়ে গিয়েছে। ঋত্বিক দেশভাগের মধ্যে দিয়ে ভৌগোলিক বাস্তুচ্যুতিকে সেইসময়ের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আলাদা করতে চান না। ঋত্বিকের ভাবনা মূলত আত্ম-চ্যুতির নির্মাণ। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সঙ্কট সব অংশের শিকড় ধরে টান দিয়েছে। সংবাদপত্রের অফিসে জনৈক কর্মচারীর হাহাকার আর ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়েছে সমষ্ঠিতে। এবং এই হাহাকার কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে পক্ষপাত করে না। ‘দেশভাগ’ নিয়ে এই-ই ঋত্বিক মননের বৈশিষ্ঠ্য। 
বাতিল এরোড্রামে ছোট্ট সীতা হাততালি দিয়ে গান গায়। গহীন জঙ্গল, এরোড্রোমের ফাটল, সীতার নাম-মাহাত্ম্য, ভূমি চিরে তার জন্ম এবং ভূমির গভীরেই সীতার শেষ আশ্রয় আমাদের মনে করিয়ে দেয় মহাকাব্যের অংশ। তখনি তার সামনে বিগ ক্লোজআপে আসে রুদ্ররূপী কালীমূর্তি! আর্কেটাইপের দ্বিতীয় অংশ: ‘টেরিবল মাদার আর্কেটাইপ’! আইসিস-কালী। শঙ্কাহরণ এবং ভয়প্রদা। বহুরূপী চৈতন্যা! এই কালীমূর্তি আমাদের পরিচিত নয়। কারণ ব্রেশটিয়ান ‘ডিফিমিলিয়া রাইজেশন’ ঘটিয়েছেন ঋত্বিক! বহুরূপী সেজে ভয় দেখানোর ‘ইমেজ’ কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হয় না। সে ভয় দেখিয়েছিল কনসেন্ট্রেশন শিবিরে, ভয় দেখায় উন্নাও-কাটুয়ায়-কখনও আরজিকর-এ!
ঋত্বিক মেলোড্রামার ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করেছেন বিপরীতভাবে। একটি পরিবারের টানাপোড়েন-চরিত্রের নানা অন্তর্কলহ-বিবাদের মধ্যে ঢুকে তারই যাবতীয় ইমোশনাল কনটেন্টকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটি একটি-দুটি মানুষের গল্প থাকেনি। হয়ে উঠেছে এক বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর কাহিনি।
সীতার আত্মহত্যার সিকোয়েন্স: কলকাতায় হরপ্রসাদের সাথে ‘বীভৎস মজা’ লুটতে আসা ঈশ্বর চুড়ান্ত নেশাগ্রস্ত। চশমা ভেঙেছে। ঈশ্বর স্খলিত নয়। ‘খদ্দের’ হয়ে দাঁড়ায় সীতার ঘরে। চলচ্চিত্রে নৈঃশব্দ ভালবাসেন ঋত্বিক। সীতার ঘরে পা দেওয়া থেকেই গোটা সিকোয়েন্স জুড়েই নৈঃশব্দ। সীতা দেখে ঈশ্বরকে। চশমাবিহীন ঈশ্বরের চোখ ঝাপসা। ফ্রেম জুড়ে সীতার বিস্ফারিত চোখ। সীতা বঁটি তুলে নেয়। ঈশ্বরের জামায় ছিটকে পড়ে রক্তের দাগ। আত্মহত্যা করেছে সীতা। হতবুদ্ধি ঈশ্বর। ঈশ্বরের চোখ দিয়ে ক্যামেরা দেখায় মৃত সীতার চোখখোলা মুখ। সাউন্ডট্র্যাকে এক চুড়ান্ত নৈবক্তিক শব্দবন্ধ শোনা যায়: ‘হে রাম’। এই দুই শব্দ কোনও চরিত্র উচ্চারণ করেনি। এক পরিবারের চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা জুড়ে যায় ঐতিহাসিকভাবে দেশের রাজনীতিতে চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার মুহূর্তে গান্ধীর প্রয়াণের সময় উচ্চারিত ‘হে রাম’ শব্দবন্ধের সাথে। দুই চরিত্রের সংঘাত-সঙ্কট, বর্তমানের সাথে অতীতের সংযোগে এক তীব্রতম অভিঘাত তৈরি করে। বিশ্বাসঘাতকতা ভিন্ন ব্যঞ্জনা নেয়। এই বিশ্বাসঘাতকতা ব্যষ্টিক গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের সর্বব্যাপী বিনাশের চিহ্ন হয়ে ওঠে। বিনা অপরাধে রামায়ণের সীতাকে ভূমির গভীরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ঋত্বিকের সীতা বিনা অপরাধেই আত্মহত্যায় বাধ্য হয়। সুবর্ণরেখার রুখুশুখু পাথুরে পাড়ে ঋত্বিক তাঁর সীতামা-কে নিয়ে চলচ্চিত্রে এক নতুন রামায়ণ নির্মাণ করেছেন। এই মহাকাব্যে কৌশল্যা রাজমাতা নন, একজন বাগদি বৌ। রামচন্দ্র উচ্চবর্ণের হিন্দু বর্ণেরহিন্দু নয়, এক দলিত। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ঋত্বিক চুড়ান্ত আশাবাদী। একসময়ের দুরন্ত তিতাসে শুকনো নদীতে চর জাগছে। মরছে বাসন্তী। মরণের মুহূর্তে সে দেখে ভেঁপু নিয়ে ছুটে আসছে এক শিশু। ঋত্বিক বলেছেনঃ “সভ্যতার মৃত্যু নেই। সভ্যতা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু সভ্যতা চিরদিনের সেখানে তিতাসে ধানের খেত জন্মেছে, সেখানে আর একটা সভ্যতার আরম্ভ”।  
‘তিতাস’-র আরও এক অনবদ্য দৃশ্য: মিলন-রজনীর দৃশ্যটি (যুক্তি তক্কো গপ্পো-তে পুনঃব্যবহৃত)। একটি দলিত মানুষ মিলিত হচ্ছে অপরিচিতা নারীর সঙ্গে। এ গরিবের ফুলশয্যা। পুরুষের হাঁটু অবধি ধুতি। নারীর আটপৌড়ে শাড়ি। শারীরিক নৈকট্য নেই। শুধু শ্বাসের শব্দ। যে মুহূর্তে সেই শ্বাসের শব্দটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে এবং বেড়ে যাওয়ার পরে চুড়ান্ত তৃপ্তির স্তরে ‘লীলাবালি লীলাবালি’গানটি আছড়ে পড়ে। লাভমেকিং। কিন্তু সম্পূর্ণ শরীরবর্জিত। শুধু শব্দের আশ্রয়। দৃশ্য এখানে বিন্দুমাত্র সহায়তা করেনি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই দৃশ্য ঋত্বিকের আগে কোথাও নির্মিত হয়নি। পরেও হয়নি।
ঋত্বিকের জীবনের শেষ নির্মাণ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। সময়ের মন্থনে বিষ গিলেছেন নীলকণ্ঠ। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছেন। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন “এই অপর-ঋত্বিকই ছবির নীলকণ্ঠ, যে ঋত্বিককে লক্ষ্য করছে। পর্যবেক্ষণ করছে। ঋত্বিকের দিকেই সে, অপর-ঋত্বিক, এর কোনও বন্ধন নেই, সে এলিমেন্টাল”  শেষ সিকোয়েন্স: স্ত্রীর কাছে একটিই আকুতি: শালবনে ভোরের আলোয় ছেলে সত্যর মুখ একবার দেখবেন। ভোরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে জানান দেন এবং সচকিত পুলিশগুলি চালায়। নীলকণ্ঠ বোঝেন: এলডোরাডো স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণারবৃত্ত পূর্ণ হচ্ছে। স্ত্রী-কে বলা শেষ কথাগুলি যেন এক মন্ত্রোচ্চারণঃ “সেই মদন তাঁতির কথা... তাঁত না চালিয়ে পায়ে গাঁটে বাত ধরে গেছে...তাই খালি তাঁত...খালি তাঁত চালালাম আর কী...কিছু একটা করতে হবে তো”! 
যাবতীয় দার্শনিক ভাবনা নিয়ে আশায় চির আবৃত ঋত্বিক দাঁড়িয়ে জন্মের শতবর্ষে। ঋত্বিকই একমাত্র পারেন সপাটে বলতে: “..আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। আমি আপনাকে হাতুড়ি মেরে বুঝাবো যে, যা দেখছেন তা একটি কল্পিত ঘটনা। কিন্ত এরমধ্যে যেটা বুঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটি বুঝুন। সেটা সম্পূর্ণ সত্যি” মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, মানব সভ্যতার অগ্রগতির পক্ষে দাঁড়ানো ঋত্বিককুমার ঘটক নিজ সৃজনের ব্যাকরণ আপন শিল্পবোধে নির্মাণ করেছেন। 
এই অতি ক্লেদাক্ত, আগ্রাসী অত্যাচার অবিচার দুর্নীতির সময়ে শিরদাঁড়া টান করা ঋত্বিকের মনন-দর্শন, তাঁর সৃজিত চলচ্চিত্রের ফ্রেমগুলি এক অনন্য স্পর্ধা। সেই স্পর্ধা আমাদের চর্চায় আসুক। ঋত্বিকচর্চা হোক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। মানুষ ও জীবনের স্বার্থে। সমষ্টির স্বার্থে।

 

Comments :0

Login to leave a comment