শুভময়
কথার অধীনে কথাকার
গল্পকার গল্প লেখেন। গল্পও, হয়তো কদাচিৎ, লিখে ফেলে একজন গল্পকারকে।
নিশ্চয়ই বিরল, হয়তো বিরলেরও বিরলতম, তবু বিশ শতকের দুইয়ের দশকে এমনটাই ঘটে যায় সাত বছরের ছোট বড় দুই বাঙালি গল্পকারের বেলায়। গল্প শুরু হওয়ার ঠিক আগে এবং গল্প লেখা শেষ হওয়ার ঠিক পরে যে গল্প, যে গল্প আদৌ গল্প নয়, নেহাত নিপাট বাস্তব, তাঁদের জীবনের, অস্তিত্বের অনিবার্য গাঢ় গল্পটা লিখে দেয়। এবং সে-গল্প থেকে তাঁরা আর বার হতে পারবেন না কোনোদিন, কিছুতেই।
অতএব লিখিত গল্প শুরুর আগে গল্পের মতো বাস্তব, লিখিত গল্প সাঙ্গ ও প্রকাশনার পর গল্পের থেকেও অবিশ্বাস্য বাস্তব এবং মাঝের লিখিত গল্পটি— এই তিনে মিলে একটি চতুর্থ গল্পের জন্ম দেবে যা আসলে খোদ গল্পকারের জীবন এবং অলঙ্ঘ্য নিয়তি। এই তিনটি গল্পই, যাদের মধ্যে কেবল মাঝেরটাই লিখিত, একজন যুবাকে অমোঘ লিখে নেবে গল্পকার হিসাবে, গেঁথে নেবে তাঁর নির্বিকল্প গল্পকার বৃত্তিতে এবং যেহেতু ভাষার নাম বাংলা ও দেশটার নাম ভারত, অভাব অনটন অসহায়তা থেকে কথাকার হয়ে-ওঠা মানুষটির আর বার-হওয়া হবে না আমরণ।
গল্প লেখার আগের চকিত গল্প যা গল্প লেখার জন্যে মূল অভিঘাত, গল্প লেখা ও প্রকাশনার পর গল্পকারের জীবনে স্থির জড়িয়ে যাওয়ার গল্প মানিক বান্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে বহুবিদিত— অর্ধপরিচিত সহপাঠীদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর ‘অতসীমামি’ লিখে ফেলা, প্রায় ঔদ্ধত্যভরে সে গল্প ‘বিচিত্রা’ দপ্তরে ফেলে আসা, প্রকাশনার পর স্বয়ং দুঁদে সম্পাদকের কলেজ-পড়ুয়া গল্পকারের বাড়ি পৌঁছে-যাওয়া ছাপা গল্প আর অর্থমূল্য সহ, এসব এখন বিকীর্ণ প্রবাদ।
কিন্তু তাঁর থেকে সাত বছরের বড় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯.৩.১৯০১-০২.১.১৯৭৬)-এর বেলায় লেখা গল্পের আগের গল্প এবং লেখা গল্পের পরের গল্প আরও রোমহর্ষক, বস্তুত গল্পের থেকেও রোমাঞ্চকর। বীরভূমের রূপসীপুর গাঁয়ে এক ভরা বসন্তে তাঁর জন্ম মাটিতে মূর্তি গড়ে-তোলা, সাপ ধরে-বেড়ানো বাপের সন্তান হয়ে, রূপসীপুর ফেলে রানিগঞ্জে চলে আসা, রানিগঞ্জ আসানসোল, নাকড়াকোঁদে নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর মানিকজোড় সখ্য, এতটাই অবিচ্ছেদ্য ছিল সে বন্ধুত্ব যে দু’জনে একত্রে জলে ডুবে মরতে বসেছিলেন প্রায়, দুই কিশোরের একইসঙ্গে বাঙালি পল্টনে যোগ-দেওয়ার বাসনা, নজরুলের যোগদান এবং ছাতির-মাপে ঠেকে যাওয়া শৈলজানন্দের নাগরিক জীবনেই থেকে-যাওয়া— এসব নিয়েই একটি জীবনী-উপন্যাসের ভরপুর প্রথম পর্ব গড়ে উঠতে পারে। শৈলজানন্দ নিয়ে আমাদের সেই বিশেষ গল্পটা এসব, এই সব সময় সবে পার করে।
শৈলজানন্দের তখন সবে একুশ। কলকাতায় তাঁর ঠাঁই সুকিয়া স্ট্রিটে তাঁর মাতুলালয় ‘দ্য রিট্রিট’, যেখানে বসবাস করতেন তাঁর মাতামহ মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় এবং মাতুল ধরণীধর। দিদিমার উপস্থিতি সত্ত্বেও সেই বাড়িতেই বাস করছেন মাতামহের রক্ষিতা কৃষ্ণভামিনী। স্বভাবে তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং যথেষ্ঠ বিষয়বুদ্ধিশালিনীও বটে। তাঁর প্রতাপ, অন্যায্য কর্তৃত্ব ইত্যাদি নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে তাঁর অনিবার্য বিবাদ। রায়বাহাদুর-পুত্র কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না তাঁর মাকে উপেক্ষা করে সমগ্র বাড়ির উপর পিতার রক্ষিতার প্রতাপ। তাঁর ক্রমপ্রসারিত হতাশা, হতাশা ও অসহায়তা থেকে মদ্যপান। এবং সে অভ্যাস তাঁকে অধিকতর আসক্তি ও অন্তহীন হতাশায় ডুবিয়ে নেয়। সম্পর্কের এবংবিধ জটিলতা, আসক্তি আচ্ছন্নতা অসহায়তার নানা কাটাকুটি রেখা বটগাছের শিকড়ের মতো ফাটল হেনে দিচ্ছে যে সম্পন্ন গৃহস্থলীতে সেখানে বসবাস নবীন লেখক শৈলজানন্দের। বছর-চল্লিশেক বয়সের কৃষ্ণভামিনীর সদা আশঙ্কা এই বুঝি তার পরিচিতি, কর্তৃত্ব, অন্যায্য প্রতাপ নিয়ে ছোকরা শৈলজানন্দ আস্ত একটা গল্পই লিখে বসে। তাহলে সব গৃহ-কিসসা ফাঁস ! ফলে রায়বাহাদুর মাতামহের মোক্ষম ফতোয়া শৈলজানন্দের উপর—আর যাই করো, গল্প-কাহিনি-নভেল লেখা চলবে না।
সুকিয়া স্ট্রিটের একটি বনেদি বাড়ি, যে বাড়ির গৃহস্বামী রায়বাহাদুর খেতাবধারী এবং বিবিধ স্খলনে দুষ্ট, সে বাড়ির নানা স্তরে সম্পর্কের গেরো-পাকানো নানা অবিন্যাস ক্রমশ আরও নিরাময়হীন হয়ে উঠছে যখন, তখন বিনাশের বলিরেখা গাঢ়তর হয় সহসা শৈলজানন্দের একমাত্র মাতুলের মৃত্যুতে। লিভারের অসুখেই মৃত্যু, যা আসলে আত্মহননেরই প্রকারান্তর।
মাতুলের মৃত্যুর পরই শৈলজানন্দের হাতে আসে একটি ডায়েরি, রায়বাহাদুর-পুত্রের হতাশার রোজনামচা। সে-দিনপঞ্জিকার আর্ত অক্ষরে কৃষ্ণভামিনীর অন্ধকার অতীত, রায়বাহাদুর পিতার উপর সে-নারীর মোহবিস্তার, সেই মোহজাল ছিন্ন করে ফেলতে একমাত্র পুত্রের ব্যর্থতা, ব্যর্থতাজাত হতাশা, মদ্যপানের জন্য আত্মধিক্কার এবং রোগযন্ত্রণার কাতর হাহাকার।
তরুণ কথাকারের কাছে সে এক আবিষ্কার, যেন বেদনার লোনা জলে ডুবে-থাকা এক বিজন দ্বীপ, তার অক্ষরের মাটি জল ঘাসবন থেকে হুতাশের বাতাস উঠে এসে ঝাপটা মারছে মুখপটে। একমাত্র মামার প্রতি নিবিড় ভালোবাসা ছিল শৈলজানন্দের এবং কৃষ্ণভামিনীর প্রতি স্বভাবিক বিরাগ, যার জন্যে নাকি স্কুল শেষে তাঁর কলেজে ভরতি হওয়ার পথ বন্ধ হয়েছিল। সব মিলিয়ে শৈলজানন্দ লিখে ফেললেন মোক্ষম এক গল্প— ‘আত্মঘাতীর ডায়েরি’, ছাপাও হয়ে গেল সেই গল্প ‘বাঁশরী’ পত্রিকায়।
রায়বাহাদুর বাড়ির বেদনার ইতিবৃত্ত আখ্যান হয়ে বেরিয়ে এল দেওয়ালের বাইরে । আশ্চর্য, সে-গল্প নাকি পড়ে ফেলেছিলেন কৃষ্ণভামিনী। সেই গল্প, এবং রায়বাহাদুরের গুলিভরা রিভলভার, এই দুই নিয়ে কৃষ্ণভামিনী ঝাঁপিয়ে পড়েন শৈলজানন্দের উপর, ‘আজ আমি তোকে শেষ করে ফেলব।’
কোনোমতে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে এসে নিজের প্রাণরক্ষা করেন বাইশ বছরের শৈলজানন্দ।
সে-দিন ছিল নাকি দুর্গাষষ্ঠী। সেই যে প্রাণ নিয়ে বার হয়ে এসেছিলেন রায়বাহাদুর দাদামহাশয়ের বাড়ি থেকে সে-দিন থেকেই সম্পন্ন মামার বাড়ির সঙ্গে তাঁর সব সম্পর্কের চির বিসর্জন। আর কোনোদিন ফেরত যাননি সুকিয়া স্ট্রিটের আশ্রয়ে।
প্রায় বটতলা ঘরানার দু’-দু’খানা গল্প যে শুধুমাত্র বাইরের রেখায় রেখায় আমরা বলে ফেললাম, সে নেহাত শ্রদ্ধাগদ্য লিখতে বসে গল্পের মৌতাতে পাঠককে মজিয়ে রাখার লক্ষ্যে নয়। আমরা গল্প বলেছি এই কথাটা তুলে আনতে—গল্পও কখনো কখনো গল্পকারের বাকি জীবনটা লিখে নেয়। সেই যে বার হয়ে এলেন সম্পন্ন মাতামহের গৃহ থেকে, শৈলজানন্দ বুঝে নিলেন তখন তাঁর ক্ষুণ্ণিবৃত্তির ব্যবস্থা তাঁকে নিজেই করতে হবে। আমরা যে বারংবার ‘গল্প’ শব্দটার উপর কলম ঠুকেছি, সেও সামান্য অর্থে— সে-দিন থেকে কথাসাহিত্যই হয়ে উঠল শৈলজানন্দের জীবিকা, যে জীবিকায় প্রাণ ধরে রাখা খুব কঠিন, যে জীবিকায় ক্ষুধা আর অভাবের অসহায় নিত্য উপস্থিতিই স্বাভাবিক।
বাংলা দেশের বাংলা ভাষার সর্বক্ষণের লেখকদের জীবনধারণ প্রসঙ্গে অনেক পরে শৈলজানন্দদের অনুজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, বরং বলা ভালো, কবি ও গদ্যলিখিয়ের বেঁচে-থাকার একটি তুলনা টেনেছিলেন, ‘কবিতা লেখার মজুরিতে কবি বাঁচে না’ কিন্তু ‘গদ্য লেখার মজুরিতে যেমন করে হোক বেঁচে থাকাটা তার (গদ্যকারের) পক্ষে সম্ভব।’ ফলে বেঁচে থাকাটা প্রায় কোনোমতেই ঘটল শৈলজানন্দের প্রায় সারাজীবন। সুকিয়া স্ট্রিটের ‘দ্য রিট্রিট’-এর দৌহিত্রকে ভবানীপুরের বস্তিতেও বাস করতে হয়েছে তিন টাকা ঘর ভাড়ায়। আর অভাব-অনটন নাছোড় লতাপাতার মতো পায়ে পায়ে জড়িয়ে টেনে ধরেছে তাঁকে লেখকবৃত্তি গ্রহণের পর জীবনের শেষ দিন অবধি। শুধু অভাবের তাড়নায় পাণ্ডুলিপি পাঠানোর উপায়ও বন্ধ হয় মাঝে মাঝে। অভাবের এই অনিবার্য সঙ্গ নিয়ে নিদারুণ লিখেছেন শৈলজানন্দের চিরসুহৃদ মুরলীধর বসু, সে চিঠি উদ্ধৃত করেছেন তাঁর জীবনীকার বুদ্ধদেব দাশ: ‘যখন আগে থাকতে টাকা ঠিক করে লেখা দেওয়া হয়নি, তখন আর কোনও কথা বলার উপায় নেই। পনেরো টাকা কি কম টাকা ? কে দেয় ? ভারতবর্ষ তো টাকা দেয়ই না, বসুমতী দশ টাকা দিলেও কথা শোনায়, আর এরা…। সব এক চেহারা, ভাই, capitalist এর পেটমোটা কুৎসিত অর্থলোলুপ চেহারা। পারো যদি তাহলে নিজের জোরে যতটা পারো আদায় করে নাও। আর যদি তা না পারো, তাহলে মোটরের চাকার তলায় পড়ে প্রাণ দাও। এছাড়া অন্য গতি আছে কি ?’
নেই।
‘উদ্বৃত্ত-মূল্যের তত্ত্বসমূহ’-এ কার্ল মার্কস শৈলজানন্দদের এই বিশ শতকীয় পরিণতির আগের শতকেই লেখকের শ্রমের চরিত্র নিরুপন করে গেছেন অব্যর্থ। তাঁর উদাহরণ ছিল জন মিল্টন। ‘মিল্টন প্যারাডাইস লস্ট উৎপাদন করছেন একই কারণে যে কারণে একটি রেশম পোকা তাকে ঘিরে রেশম গুটি বুনে চলে। এ কাজ তার প্রকৃতির কাজ। পরে তিনি এই উৎপাদন পাঁচ পাউন্ডে বিক্রি করলেন। … একজন গায়ক যখন গাইছেন নিজের জন্যে সে অনুৎপাদনশীল শ্রম। কিন্তু একই গায়ককে যখন নিযুক্ত করছে উদ্যোগপতি তার গান উৎপাদনশীল শ্রম, কারণ সে পুঁজি তৈরি করছে।’
শৈলজানন্দদের ক্ষেত্রে সঙ্কট আরও শাণিত। তাঁদের নিহিত ‘প্রকৃতি’ অনুযায়ী শৈলজানন্দরা যে উৎপাদন করেছেন তা বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন নেহাত ক্ষুধার দায়ে স্বল্পেরও স্বল্প দামে। এবং ঔপনিবেশিক ধনবাদের শাসনে যাঁরা বিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা দেশে বাংলা ভাষায় পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতেন তাঁদের লেখককে এর থেকে বেশি শ্রমমূল্য প্রদান করার ক্ষমতাও ছিল না আদৌ।
সুকিয়া স্ট্রিটের রায়বাহাদুর খেতাবি মাতুলালয়ের গল্পগুলি শৈলজানন্দের বাকি জীবনের জন্যে অভাবের যে খাঁচা লিখে দিয়েছিল, সে শিক-বেড়ি ভেঙে একবারই বার হতে পেরেছিলেন তিনি— তাঁর চলচ্চিত্রকার জীবনে। বাড়িগাড়ি দুইই হয়েছিল তাঁর। কিন্তু ঔপনিবেশিক পুঁজি এবং তার দেশীয় পোষ্যরা যে ধূর্ত আচরণে দক্ষ ও স্বাভাবিক তা পড়ে নিতে পারেননি তিনি। স্টুডিওপাড়ার অন্দরে ঢুকেও । ফলে ফের অভাব, লেখকজীবনে ফিরে-আসা এবং নিশ্চিত নিরন্তর অভাব।
২. প্রকৃতির অধীনে কথাকার
কিন্তু নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী কথাশিল্পের রেশমগুটি বুনে যাওয়া থেকে কেউ বিরত করতে পারেনি তাঁকে।
নিজস্ব প্রকৃতি কথাটা আমরা এই জন্যেই বলেছি, রেশমকীট যেমন নিজের শরীর থেকেই উপাদান সংগ্রহ করে রেশম তন্তু বয়ন করে, শৈলজানন্দও তেমনি তাঁর যাবতীয় কথা-কাহিনি বয়ন করছেন তাঁর নিজের অভাব অনটন-অভিজ্ঞতা থেকে এবং তাঁকে ঘিরে পিঁজিয়ে-ওঠা জীবন থেকে। আর ঠিক ওইখানেই তিনি পেয়েছেন বাঙালি পাঠকের এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আদর। শৈলজানন্দের তখন ২৬, ‘প্রবাসী’ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪-এ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘শৈলজানন্দের গল্প আমি কিছু কিছু পড়েছি। দেখেছি দরিদ্র জীবনের যথার্থ অভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে লেখবার শক্তি তাঁর আছে বলেই তাঁর রচনায় দারিদ্র ঘোষণার কৃত্রিমতা নেই। তাঁর বিষয়গুলি সাহিত্যসভার মর্যাদা অতিক্রম করে নকল দারিদ্রের শখের যাত্রাপালায় এসে ঠেকেনি।’
নিহিত প্রকৃতিই তাঁকে নির্দেশ দেয় সাহিত্যের প্রাণরস সংগ্রহে, কাঁচামাল খুঁজতে শরীরের মতো চেনা অভিজ্ঞতার বাইরে যাওয়া চলে না কিছুতেই। যে কয়লাকুঠির জন্যে তাঁর অমন অবিনশ্বর যশ, সে কেমন করে ওই শরীরী অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় তার কথা শুনিয়েছেন শৈলজানন্দ স্বয়ং: ‘রবিবার ছুটির দিন পেলেই দু’জনে (শৈলজা ও নজরুল) দুটি খাতা হাতে নিয়ে চলে যাই বহুদূরে। একদিন এক কয়লা-খাদের পাশে সাঁওতালি কুলি-ধাওড়ার কাছে আমরা বসে গল্প করছি, আমার বেশ মনে আছে— দূরে প্রকাণ্ড চিমনির মুখে ধোয়াঁ উঠছে। চানকের মুখে হেড গিয়ারের চাকা ঘুরছে, তার উপর পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে, ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে, মাটির নিচ থেকে কয়লা বোঝাই টবগাড়ি উঠছে, দূরে একটি আমবাগানের পাশে হঠাৎ কোথায় যেন মাদল বেজে উঠল।’
বাড়ি ফিরেই গল্প লিখতে বসে গিয়েছিলেন শৈলজানন্দ। সে-গল্পই ‘কয়লাকুঠি’, এবং সে-গল্পের এক ও অদ্বিতীয় শ্রোতা নজরুল ইসলাম।
উনিশ শতকের ইংরেজ মধ্যবিত্তশ্রেণি প্রসঙ্গে আলোচনায় কার্ল মার্কস উজাড় করে প্রশংসা উচ্চারণ করেছিলেন ডিকেন্স থ্যাকারে ব্রন্টি গ্যাস্কেল-দের প্রতি। শিল্পবিপ্লবের দৈত্যপুরী ব্রিটেন তখন শাসনের সঙ্গে নিপুণ শোষণের জাল বুনেছে তার নিজের দেশেও। ইংরেজি ভাষার ওই কথাকার-কৌম, মার্কসের নিরূপণে, দর্শিয়ে দিলেন শোষণজালের অন্দরে-থাকা সেই বিবিধ মানুষদের যারা ‘তাদের উপরতলার কাছে দাস আর তাদের নিচের তলার কাছে দানব।’ বিশ শতকে বাংলা ভাষায় শৈলজানন্দ দেখিয়ে দিলেন উপনিবেশীকৃত একটি দেশে কয়লাখনি শোষণের একাধিক ধাপ ও স্তর। মালিক-ম্যানেজার-রিক্রুটার-আড়কাঠি-নানা স্তরের কর্মচারী, শৈলজানন্দের একালের সম্পাদক (শুভেন্দু দাশমুন্সী, কয়লাকুঠি সমগ্র, দে’জ, ২০২৪)-এর ভাষ্যে ‘বিরাট শোষণযন্ত্রের চালক বা এই ব্যবস্থা-পরিচালকের সরাসরি সহকারী।’ এবং আমাদের বলার কথা হলো এই, শৈলজানন্দের আঁকা ছবি খুললে ঠিক দেখে নেওয়া যায়, এরা প্রত্যেকেই তাদের ঠিক উপরতলার কাছে দাস, অব্যবহিত নিচের তলার কাছে দানব।
৩. দুঃখের অধীনে কথাকার
কিন্তু গল্পই যেখানে গল্পের প্রধান চরিত্র সেই সদাসক্রিয় গল্প শৈলজানন্দকে এবং তাঁর গল্প বলার কারিগরিকে ছেড়ে যাচ্ছে না আদৌ। এপ্রিল ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত তাঁর স্ব-নির্বাচিত গল্পগ্রন্থে প্রথমেই ঠাঁই দিয়েছিলেন ফাল্গুন ১৩৩৭ ‘ভারতবর্ষ’-এ প্রকাশিত ‘রাখালমাস্টার’ গল্পটিকে।
প্রথম বাক্য থেকেই চালক হিসাবে গল্পের সক্রিয়তা: ‘রাখাল-মাস্টারকে লইয়া গল্প লেখা চলে কি-না কে জানে।’ কিন্তু চালক হিসাবে গল্প যেন তুষ্ট হতে চায় না কিছুতেই। ফলে শিল্প হিসাবে গল্প সাঙ্গ হতে চায় না ন্যায্যত। গল্পের শেষ ভাগে এসে রাখাল-মাস্টার বলেন, ‘নাঃ, গল্প লিখতে তোরা জানিস না।’ এবং বলে দেন না লিখতে জানার কারণটাও, ‘দুঃখু তুই নিজে পাসনি কোনো দিন, দুঃখুর কথা তুই লিখবি কেমন করে ? আমি যদি লিখতে জানতাম ত’ দেখিয়ে দিতাম কেমন করে লিখতে হয়।’
আবহমানের বাংলা গল্পকে, গল্পকারকে এই সহজপাঠ পড়িয়ে দিতে চেয়েছেন রাখাল-মাস্টার। না, রাখাল-মাস্টারদের শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়।
Comments :0