শঙ্কর ঘোষাল: বর্ধমান,
 
রেশন চাইতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন স্বপন মালিক ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সেই ঘটনা রাজ্যবাসী যেমন প্রথম দেখেছিলেন, তেমনই রায়নার উচিতপুরও।  যিনি সকলের কাছে এককথায় ভালো মানুষ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। পেশায় খেতমজুর এই মানুষকে সকলের জন্য রেশন চাইতে গিয়ে খুন হতে হয়েছিল। 
তৃণমূলের বোমার আঘাতে এই শহীদের মৃত্যুই আজও জাগিয়ে রেখেছে কমরেড স্বপন মালিককে। এই হত্যাকাণ্ড যেন গোটা রায়নার গরিব মানুষকে প্রতিবাদের এক মঞ্চে সেই সময় এনে হাজির করেছিল। বর্ধমান-কারালাঘাট রোডে শোকার্ত উচিতপুর আজও স্মরণে রেখেছে শহীদকে।  গ্রামের মানুষ অঞ্জনা হাজরা’রা  বলেছেন, রেশনে যে বিরাট চুরি ছিল বঞ্চিত মানুষকে রেশন দিতে হবে এই দাবি করে আন্দোলনে এসেছিলেন অনেক মানুষ। ৭বছর পর রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জেলে, হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে। সেই ঘটনা জানতে পেরে রায়নার উচিতপুরের মানুষ রেশন কাণ্ড নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন। 
শাসকদলের মদতে বেশিরভাগ মানুষই রেশন কার্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাউকে কাউকে বলা হয়েছিল শাসকদলের নেতাদের বাড়ি থেকে রেশন কার্ড আনতে। স্বপন মালিকরা  তারই প্রতিবাদ করেছিলেন। সেদিনটা ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি, শত শত মানুষের সঙ্গে স্বপন মালিকও সকলের জন্য রেশনের দাবি নিয়েই বিডিও অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু  পুলিশের সামনে রেশনের দাবিতে প্রতিবাদী মিছিলের উপর তৃণমূল বস্তা বস্তা বোমা ছুঁড়েছিল। এই হামলার প্রত্যক্ষদর্শী এবং পঞ্চায়েত সদস্য গণেশ সাঁতরা বলেছেন, পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা আক্রমণ করেছিল আমাদের উপর।  দেখা হলো তৃণমলের ঘাতকবাহিনীর ছোঁড়া বোমাতে আহত বেরুল গ্রামের কৃষক শেখ হবিবর রহমান সঙ্গে। তিনি বলেছেন, অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলাম। যা বোমা ফেলা হয়েছিল আরও অনেক মানুষের প্রাণ যেতে পারতো। তিনিও আঘাত পেয়েছেন শরীরে। গোটা ঘটনা পুলিশ ও শাসকদল এক সঙ্গে বসেই ছক কষে পরিকল্পনা করেছিল। লক্ষ্য একটা  মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে রেশন কেলেঙ্কারিকে আড়াল করা।
সেদিন মিছিলের মানুষ ছাড়াও নিরীহ সাধারণবাসের যাত্রীকেও  মারধর করা হয়েছিল। ভাঙা হয়েছিল একাধিক বাস ও ট্রেকার, ভুটভুটি। সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়ে আক্ষেপ করেই বলেছেন সাধন মাজি,মন্ত্রীর দুষ্কর্মের জন্য গাঁয়ের জনরোষ থেকে বাঁচাতে পঞ্চায়েত মন্ত্রীর বাড়ি রক্ষার জন্য কত পুলিশ, র্যা ফ নামানো হয়েছে।  কিন্তু ঘটনার দিন যদি এর সামান্য পুলিশ তৎপর থাকত তাহলে একজন খেতমজুরকেও রেশন চাইতে এসে শহীদ হতে  হতো না। 
স্বপন মালিক খুনের ৭বছর পর ইডি তদন্তে নেমে রেশন কেলেঙ্কারি সামনে এসে পড়েছে। মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জেলে। কিন্তু সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী রেশন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে বিরোধীদের উপরই সব দায় চাপিয়েছিলেন। কিন্তু রায়নার মানুষ প্রশ্ন তুলছেন আর কত মন্ত্রী জেলে গেলে মুখ্যমন্ত্রী  পদত্যাগ করবেন?  এই একই প্রশ্নই করেছেন রায়নার উচিত পুরের গৃহবধূ, চোখের জল ফেলে রাই সাঁতরাও মনে করেন চোরের সরকারটা আর থাকার দরকার নেই। রক্তে ভেসে গেল রায়নার মাটি, এই সময়ে শুধু বিরোধীদল নয় শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দলেও অসংখ্য মানুষ খুন হয়েছেন। স্বপন মালিক তার মধ্যে অন্যতম। তিনি তো নিজের জন্য নয়, শ্যামসুন্দর গিয়েছিলেন রেশন চাইতে, সবার জন্য। তাহলে কেন এত ভালো মানুষটাকে খুন করলো ওরা? রেশন চাইতে যাওয়াটা কি অপরাধ, বলুন না আপনারা? অঝোরে চোখের জল যেন বাঁধ মানছে না উচিতপুরের বহু মানুষের ৭বছর পরেও শহীদের জন্য কাঁদছে গ্রাম। 
কান্নায় কণ্ঠ বুঝে এলেও তাঁর স্ত্রী বলেছেন, একদিন আমরা বিচার পাবোই। রেশন দুর্নীতি নিয়ে মানুষ চাইছেন এর একটা জোরালো প্রতিবাদ দরকার। ঘটনাস্থলে ৭বছর পর উচিতপুরে গিয়ে  মনে হয়েছে  আবাল বৃদ্ধ-বনিতার একটাই আওয়াজ  খুন করে প্রতিবাদী মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারবে না আর শাসকদল।  শহীদ কমরেড স্বপন মালিকের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে আজও অনড় এখানকার মানুষ। প্রতিবছর ১১ ফেব্রুয়ারি উচিতপুরে কমরেড স্বপন মালিকের স্মরণসভা হয়। এখানকার মানুষ সেই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আসছেন। 
বর্ধমান-কারালাঘাটের রাস্তার পাশেই উচিতপুর। সেই গ্রামে শহীদ স্বপন মালিকের ভাঙা ঘরের দিকে তাকালেই মনে ভেসে ওঠে রেশন আন্দোলনের স্মৃতি। রাজ্যে প্রথম তৃণমূলের সরকার আসার পর রেশন চাইতে এসে এই খেতমজুর খুন হয়েছিলেন তৃণমূলের বোমার আঘাতে। 
তখন দুপুরবেলা,  সূর্য মধ্য গগনে,  পিচরাস্তা ভেঙে লাল মোরাম রাস্তা ধরে এগোলেই উচিতপুর গ্রাম, ধান কাটা শুরু হয়েছে মাঠে কৃষকদের ব্যস্ততা। সেখানেই আতসী সিট কেঁদেই বলেছেন, সেদিন  সাড়ে তিনটের সময় মিছিল নিয়ে আমরা রেশন চাইতে গিয়েছিলাম ব্লক অফিসে, সাড়ে চারটে নাগাদ বোমার আঘাতে লুটিয়ে পড়ে স্বপন মালিক। তাঁর একটাই কথা, রেশন চাইতে গিয়ে খুন হতে হয় যে রাজ্যে সেটাতো জঙ্গলের রাজত্ব। ফিরিয়ে দিতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী স্বপন মালিকের স্ত্রীর সিঁন্দুর? খেতমজুরি, কখনো সবজি বিক্রি করে সংসার চালাতেন খুবই অভাবী স্বপন মালিক। তাঁর একটি মাত্র ছেলে সেও খেতমজুর, তার নাম পিন্টু মালিক। তৃণমূলের খুনিরা এই পরিবারের একমাত্র রোজগেরেকে খুন করে গোটা পরিবারকেই অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। 
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0