প্রতীম দে
তিমির বরণ ঘোষ। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। চলতি বছর ৫ জানুয়ারি তাঁর স্মরণসভা হয়েছে বজবজে। কিন্তু যাদবপুর বিধানসভার ২৯ নম্বর পার্টের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম এখনও রয়েছে। একবার নয়। ওই একই তালিকায় দু’বার আছে তাঁর নাম। তালিকার প্রথম পাতায় ৭ নম্বরে রয়েছে তাঁর নাম। এপিক নম্বর SCG3009503। দ্বিতীয় বার নাম আছে শেষের দিকে ক্রমিক সংখ্যা ১২৪৫, এপিক নম্বর SCG2993301। একই ব্যক্তির দু’বার নাম রয়েছে একই ভোটার তালিকায়। পরিবারের দাবি তার নাকি একটাই ভোটার কার্ড। সেই কার্ড নিয়েই তিনি ভোট দিতে যেতেন। তাহলে একজন ব্যাক্তির যদি একটিই এপিক নম্বর থাকে তাহলে একই নামে একই ছবি দিয়ে একই তালিকায় আলাদা এপিক নম্বরে নাম উঠলো কিভাবে?
শুধু তিমির বরণ ঘোষ নয়। ওই ভোটার তালিকায় আরও একজন আছেন যার নাম রয়েছে দু’বার। তাও আবার পরপর! তিনি এখনও জীবিত। ৪৬৩ অমিত মজুমদার। বাবা ঋষিকেশ মজুমদার। আবার ৪৬৬ -এ তারই নাম । দুটি জায়গায় শুধু বয়স আলাদা। বাকি সব এক। ক্রমিক সংখ্যা ৪৬৩-এ এপিক নম্বর LMW5026166 । ৪৬৬ এ এপিক নম্বর SCG3202629। স্থানীয় সিপিআই(এম) কর্মীদের দাবি এই ব্যক্তিকে একাধিকবার জানানো হয়েছে তার নাম দু’বার আলাদা আলাদা এপিক নম্বরে ভোটার তালিকায় রয়েছে। যেই এপিক নম্বর সঠিক সেটা রেখে অন্যটা বাতিল করার জন্য।
বৃহস্পতিবার নেতাজী ইন্ডোরের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী সরব হয়েছেন ভোটার লিস্টে ভুয়ো ভোটার নিয়ে। সুব্রত বক্সীর নেতৃত্বে কমিটিও গঠন করেছে তৃণমূল ভুয়ো ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাদবপুর বিধানসভার এই পার্টে যে দু’জনের নাম দু’বার করে রয়েছে সেই বিষয় কেন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি জেলা প্রশাসন। ভোটার তালিকায় ভুয়ো নাম তুলে রাখা, নির্বাচনের দিন সেই নামের ভিত্তিতে ভোট দিয়ে জয়ী হওয়ার এক প্রবণতা রাজ্যে তৈরি করেছে তৃণমূল। বিজেপি কখনও এই নিয়ে সরব হয়নি। যাদবপুরের এই ২৯ নং পার্টেও বিজেপি’র কোনও প্রতিবাদ কখনও দেখা যায়নি। গত বেশ কয়েক বছর ভুয়ো নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি করে আসছে সিপিআই(এম)। একাধিকবার এই বিষয়ে রাজ্য নির্বাচন আধিকারিকের কাছে, জেলাসাসকদের কাছে দাবি জানিয়েছে পার্টি।
হালতু, কায়স্থ পাড়া নিয়ে এই ২৯ নম্বর পার্ট। মূলত মধ্যবিত্ত অঞ্চল। উদ্বাস্তু আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে এই এলাকা। এখন মাঠ, পুকুর বুজিয়ে হয়েছে ফ্ল্যাট। এলাকায় আনা গোনা হয়েছে অনেক নতুন মানুষের। তাঁদের অনেকে অনেককে জানে চেনেন আবার অনেকে চেনে না একে অপরকে।
বর্তমানে এই পার্টে মোট ভোটারের সংখ্যা ১৩৫০। গত লোকসভা নির্বাচনে এই বুথে ভোট পড়েছে ৮৫০। বিজেপি পেয়েছে ২৭২, তৃণমূল ২৯৬, সিপিআই(এম) ২৬৩ ভোট। এলাকার সিপিআই(এম) কর্মী সজ্ঞীত ঘোষ জানিয়েছেন ২৯ পার্টে প্রায় ১১৭ জনের নাম আছে যাদের অনেকে মারা গিয়েছেন বা অন্যত্র বসবাস করেন এখন। তিনি বলেন,‘‘আমরা অনেক বার ৭ নম্বর ফর্ম জমা দিয়েছিল কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। বিএলও বলে মৃতের শংসাপত্র দিতে হবে। কিন্তু এই নিয়ম কোথাও নেই। তাও বার বার দিয়ে কয়েকটা নাম বাদ দেওয়া গিয়েছে।’’
ওই পার্টের বিএলও ইতি মাইতির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,‘‘আমরা মানছি অনেক মৃত ভোটার আছে যাদের নাম বাদ যাওয়ার কথা। আমরা বার বার বাড়ির লোকদের বলেছি সার্টিফিকেট দিতে কিন্তু তাঁরা দেয়নি।’’ তিনি আরও বলেন,‘‘শেষ বার যখন আমাদের নিয়ে জেলার নির্বাচনী আধিকারিকরা বৈঠক করেন সেখানেও বিষয়টা জানাই যে পার্টে অনেক নাম বাদ যাবে। তারা বলে এখন নিয়ম হয়েছে একটি বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে ২০০ জনের বেশি নাকি নাম বাদ দেওয়া যাবে না। এই নিয়ম কবে হলো জানি না।’’
সূত্রের খবর ১৫০ যাদবপুর বিধানসভায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার নাম রয়েছে যা ভোটার তালিকা বাদ যাওয়ার কথা। শাসক দল নিজেদের স্বার্থে এই সব নাম তালিকায় রেখে দিচ্ছে।
যেমন প্রণতি বোস। ২০২১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম এখনও তালিকায় আছে। তার স্বামী মহাদেব বোস এলাকায় তৃণমূল ঘনিষ্ট বলেই পরিচিত। কমল চৌধুরি, ছেলে এলাকার তৃণমূল কর্মী তার নামও আছে তালিকায়।
এর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বার বার চেষ্টা করেছেন তালিকা থেকে পরিবারের মৃত সদস্যের নাম বাদ দেওয়ার জন্য কিন্তু তারা বাদ দিতে পারেননি। যেমন স্নিগ্ধা বোস, প্রায় সাত আট বছর আগে মারা গিয়েছেন, তার দেওর মানব বোসও মারা গিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের কথায় অনলাইন হোক বা অফলাইন বিভিন্ন ভাবে তারা চেষ্টা করেছে কিন্তু নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে তারা পারেনি। একই ঘটনা ঘটেছে সুজিত রক্ষিত এবং হীরা রক্ষিতের ক্ষেত্রেও। তাদের ছেলে বার বার আবেদন করেও নাম বাদ দিতে পারেননি। এখনও ভোটের সময় বাবা মায়ের নামে ভোটার স্লিপ তার কাছে আসে।
সনৎ দে, ২০১৬ সালে মারা গিয়েছেন। তাঁর নামও আছে তালিকায়। তাঁর স্ত্রী বলেন, আমি এখানে বেশি থাকি না। ছেলে মেয়ের কাছে থাকে বেশি সময়। দু’বার অনলাইনে আবেদন করেছি। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। ভোট দিতে গিয়ে অফিসারদের বলে দিতে হয় যে তারা মারা গিয়েছেন যাতে তাদের নামে কোনও ভোট না পড়ে।’’
এই ২৯ নম্বর পার্ট কলকাতা পৌরসভার ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডে পড়ে। এই ওয়ার্ড থেকে গত পৌর নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। যদিও জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ আছে। পাশের ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডেও একই ছবি। সেখানকার ১৩ নম্বর বুথে এক ব্যক্তির দু’বার করে নাম আছে তালিকায়। সেখানেও আবেদন করে বাদ দেওয়া যায়নি নাম।
Comments :0