Post editorial

সিঁদুরে মেঘ আকাশে

উত্তর সম্পাদকীয়​

সমন্বয় রাহা

১০ মে বিকেল ৫টা থেকে সংঘর্ষ বিরতি'র সূচনা হলো দুই রাষ্ট্রের মধ্যে। বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি ঘোষণা করলেন সে কথা।
এরই খানিক আগে ট্রাম্প সাহেব অবতীর্ণ হলেন। এক্স হ্যান্ডেল-এ লিখলেন, দুই রাষ্ট্র বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজি হয়েছে সংঘর্ষ বিরতিতে। অর্থাৎ সেই আমেরিকা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।
আমেরিকার অবস্থান ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে বুঝতে হলে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। তার আগে পহেলগামের ঘটনা এবং তার পরবর্তী বিষয়ে খানিক আলোচনা প্রয়োজন।
২২ এপ্রিল। রক্তাক্ত কাশ্মীর। রক্তাক্ত দেশের নাগরিকদের হৃদয়। যাঁরা কাশ্মীরের সৌন্দর্য দেখতে গেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ২৫ জন এক্কেবারে মুছে গেলেন এই দেশের টুকরো হয়ে যাওয়া মানচিত্র থেকে। এই ইনফর্মেশনের যুগে আমরা বেমালুম ভুলে যাই (পড়ুন ভুলিয়ে দেওয়া হয়) আদিল শাহ নামের একজন ব্যক্তিও ছিলেন সেদিনের নিহত'র তালিকায়। তিনিও মুছে গেছেন এই মানচিত্র থেকে। সাথে সাথেই অনেকের স্মৃতি থেকেও!
অবশ্য তা ভুলিয়ে দিতে না পারলে উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম বিদ্বেষ গড়ে তোলা যাবে কী করে! তাই প্রেস মিডিয়া যা আছে সব একসাথে কাজে লাগাও। গড়ে তোলো তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ। ধর্মকে ব্যবহার করা কিছু মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের ধর্মকে চিহ্নিত করে, সেই ধর্মকেই আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলো।
যে আদিল শাহ সেদিন পহেলগামে উপস্থিত পর্যটকদের (ঘটনাচক্রে যাঁরা হিন্দু) বাঁচাতে, নিজের শরীরকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করালেন, তাঁর কথা আমরা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারি না। এই স্মৃতি নিয়ে এগতে এগতেই দেশের সব রাজনৈতিক দল এককাট্টা বার্তা দিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধের লড়াইয়ে সরকারের পাশেই থাকার।
আত্মরক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্র পালটা আক্রমণ হানলো সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলোতে। কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ সহ ১৪০ কোটি ভারতীয় দেশ বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়ছে। ৩৫ বছর বাদে কাশ্মীরের ধর্মঘটে সব সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে ভাবে রাস্তায় নামলেন ‘কাশ্মীরিয়ত’-কে বাঁচাতে।
এর থেকে শিখবো না আমরা কিছু? নাকি একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সব মানুষ এবং কিছু সন্ত্রাসবাদীকে এক ব্র্যাকেটে ফেলে প্রশ্ন তুলবো ভারতবর্ষের সেকুলার শব্দ নিয়ে? এবং এখানেই আসে ওই গালভরা কথাটি, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এককাট্টা লড়াই। এটাই তো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমাজ সচেতন সব মানুষেরই মনোভাব হওয়া উচিত।
এই একবিংশ শতাব্দীতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বারংবার দেশি-বিদেশি মিডিয়া আমাদের সামনে তুলে ধরেছে আমেরিকাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন দেশ। কী করেছে তারা? ওসামা-বিন-লাদেনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজের প্রয়োজনে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক চালচিত্র পালটে দিয়েছে আমেরিকা। এককালে এই আমেরিকার সিআইএ’র হাতেই তৈরি হয়েছিল লাদেন, আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই ইতিহাস। আফগানিস্তানে হাত ধরে চরম মৌলবাদী ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদী তালিবানদের সেদেশের মসনদে বসিয়ে এসেছে, আসরাফ গণির সরকারকে তাড়িয়ে, এই আমেরিকাই। ভুলে যায়নি তা এই পৃথিবী। 
নিজের অর্থের বলে অন্য গরিব দেশগুলিকে প্রথমে সাহায্য করো। তারপর আস্তে আস্তে দখল নাও তার বাজার। দখল নাও তার ভূখণ্ডের। দখল নাও তার সার্বভৌমত্বের। তারপরে তাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করো। আধিপত্যবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে আমেরিকার কাজই তাই।
গত তিন দশকে পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনৈতিক চালচিত্রে আইএমএফ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। দেখানো হয়েছে এই ঋণ পরিকাঠামো উন্নতির জন্য। আসলে সন্ত্রাসবাদের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে সেই অর্থ, কে না জানে! এই আইএমএফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৈরি হয়েছিল, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে শায়েস্তা করতে। যার হর্তাকর্তা প্রথম থেকেই আমেরিকা। গত তিন দশকে ২৮ বার আর্থিক প্যাকেজ মঞ্জুর হয়েছে পাকিস্তানের জন্য, বারংবার ঋণ মেটাতে বিফল হওয়া সত্ত্বেও। পহেলগাম ঘটনার পরে পাকিস্তানে অবস্থিত সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি ধ্বংস করতে এদেশের জওয়ানরা যখন রক্ত ঝরাচ্ছেন, সেই সময়েই গত ৯ মে আরও ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে এই আমেরিকাই পাকিস্তানকে। ভারত ভোটদানে বিরত থাকার পরেও এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ট্রাম্প এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ৯ মে গোটা রাত বারংবার আমেরিকার তরফে কথা বলা হয়েছে দুই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে। অর্থাৎ একদিকে আইএমএফ থেকে পাকিস্তানকে অর্থ দেওয়া হলো, আরেক দিকে দুই রাষ্ট্রের উপর চাপ বাড়ানো হলো। সাপ ব্যাঙ দু’জনের গালেই চুমু খাচ্ছেন ট্রাম্প।
এই ঘটনা দুটি বিষয় সামনে এনেছে।
১। ভারত রাষ্ট্রের কুটনৈতিক দুর্বলতা, যা আইএমএফ’র নীতি নির্ধারকদের বোঝাতে অক্ষম, যে এই অর্থ আদতে সন্ত্রাসবাদের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়, সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হয় না। উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদীদের সাথে হাতে হাত রেখে চলছে। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাথে সাথে নরেন্দ্র মোদী ওয়াইট হাউসে লাইন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রাম্পের সাথে দেখা করলেন। আগেরবার হাউডি ট্রাম্প প্রোগ্রাম করে গুজরাট-আমেরিকায় হইচই ফেলে সব আমেরিকাবাসী ভারতীয়দের নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করতে বললেন। তারপরেও ট্রাম্পকে বোঝাতে পারলেন না কেন মোদী?
২। উপরের কথাগুলো আমেরিকা জানে না, তা নয়। তারা খুব ভালোই জানে। তবুও এই অর্থ বরাদ্দ। কারণ সে চায় দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদজনিত অশান্তি বজায় থাকুক।

আর্থিক কারণে পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা বাড়তেই থাকবে। ফলে পাকিস্তানের ভূখণ্ড কাজে লাগিয়ে আমেরিকা আরব দেশগুলিতে নিজের ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়াবে। ফুলে ফেঁপে উঠবে ইলন মাস্ক থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ট্রাম্প। আর এ প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের ওপাশে তো ইজরায়েল আমেরিকার পকেটে আছেই।
আবার উলটোদিকে কূটনৈতিক স্তরে ভারত এখন অনেকখানি নির্ভরশীল হয়ে গেছে আমেরিকার উপর। ভারতের মতন বিশাল বাজার, তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের শ্রমিক পাবার প্রশ্নে আমেরিকার কাছে বিশেষত ইলন মাস্কের মতন শিল্পপতিদের কাছে খুবই লোভনীয়। একই সাথে এই মুহূর্তে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ পুঁজিপতি আম্বানি-আদানি। তাদেরও মুনাফার প্রশ্ন লুকিয়ে আছে এক্ষেত্রে। অর্থাৎ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণির লাভক্ষতির অঙ্ক জড়িয়ে আছে। তাই ধর্মীয় উন্মাদনা এবং কর্পোরেট পুঁজির ব্লেন্ডেড কম্বিনেশন হচ্ছে বর্তমান সন্ত্রাসবাদ আর ‘মলম আমেরিকা’।
একই সাথে মোদীর সরকারি নীতিগুলো খেয়ালে রাখতে হবে। বর্তমানে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজি লগ্নি করা যাবে প্রতিরক্ষা খাতে। অর্থাৎ কপাল চকচক করছে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইজরায়েলের। খুব ভেবেচিন্তেই রাশিয়াকে রাখলাম না এর মধ্যে। কারণ রাশিয়া সোভিয়েতের সময় থেকেই ভারতবর্ষের বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু। এর পেছনে মোদীর বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব নেই। খেয়াল করে দেখুন এই আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের সময়ে বারবার উঠে এসেছে ভারতের দ্বারা ব্যবহৃত ইজরায়েলী ড্রোন, ফ্রান্সের রাফায়েল যুদ্ধবিমান, বিভিন্ন রকম মেশিনগান থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমেরিকার কথা। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যুদ্ধ নামক ব্যবসায় লাভ হয় আন্তর্জাতিক পুঁজিপতি শ্রেণির।
এই যুদ্ধে ভারতের মানচিত্রকে সবচেয়ে বেশি রক্ষা করেছে ‘এস ৪০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যা রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত। এই প্রশ্নে আগাগোড়াই সোভিয়েতের সময় থেকে সাহায্য করে এসেছে তারা। কিন্তু ব্যবহারকারী ডিফেন্স সিস্টেমের ভারতীয় নাম হচ্ছে ‘সুদর্শন চক্র’। যে সুদর্শন চক্র হিন্দু পৌরাণিক গল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। আপনার অজান্তেই আপনার বাড়ির ভেতরে আদানি-আম্বানি'র মিডিয়া মারফত ঢুকে পড়লো হিন্দুত্বের অ্যা জেন্ডা। ঠিক যে ভাবে প্লেনের আগে পুষ্পক রথের গল্প আওড়ায় ওরা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে খেয়াল করলেই দেখবেন মোদীর ছবিকে বিভিন্ন সময়ে আর্মি অফিসারের পোশাকে সাজিয়ে বারংবার আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। লার্জার দ্যান লাইফ মোদীই রক্ষাকর্তা আমাদের! আর অন্য দিকে শহীদ হওয়া জওয়ানের স্ত্রী পাহেলগামের নৃশংস ঘটনার পরে যখন বলেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম বিবাদ তৈরি করা ঠিক হবে না, তখন তাকে সমাজমাধ্যমে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে আরএসএস-বিজেপি-হিন্দুত্ববাদীরা।
ঠিক এই সময়ই স্মৃতিতে চলে আসে বেশ কয়েক বছর আগে কাশ্মীর উপত্যকারই ৮ বছরের আসিফার কথা। মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়ে। যাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হিন্দু মন্দিরের ভেতরে। টানা বেশ কয়েকদিন ধরে চলে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ, তারপর খুন করা হয়। এবং তারপরই মহা উল্লাসে হিন্দুত্ববাদীরা মিছিল করে এই ধর্ষণের সমর্থনে। স্মৃতিতে আসে উত্তর প্রদেশে ধর্ষিতার শরীর জ্বালিয়ে মহাউল্লাসে ধর্ষণের সমর্থনে মিছিল করার কথা। শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার জন্য, কখনও সেই মেয়ে মুসলমান, কখনও সেই মেয়ে হিন্দু কিন্তু দলিত। শুধু মেয়ে বলেই যখন তাকে ধর্ষণ করার অধিকার জন্মায়! কি বিচিত্র এই হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেডের ভাবনা!
যখন আত্মরক্ষার স্বার্থে পাল্টা আঘাত নামানো হলো সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলিতে, তখন এই অপারেশনের নাম দেওয়া হলো ‘অপারেশন সিঁদুর’। হিন্দু মহিলাদের কাছে সিঁদুর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যাকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করল রাষ্ট্র। মাথায় এল না আদিল শাহর কথা! মাথায় এল না ঝন্টু আলি শেখের কথা! ভুলে গেলাম তাদের বাড়ির মেয়েদের কথা? নিজের অজান্তেই অপর বানিয়ে ফেললাম তাদের। মতামত নির্মান করার চেষ্টা হলো, মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী।
তাহলে প্রতিশোধ? যে প্রতিশোধ ২৫টা পরিবারের জন্য দরকার। সেই প্রতিশোধ তো আদিল, ঝন্টু এমনকি এই সময়কালে পাকিস্তানের বোমা ড্রোন হামলায় এখনও অব্দি নিহত ৫ জন শিশু, মহিলা সহ অন্যান্য নাগরিকদের জন্যও দরকার।
অথচ সিঁদুর একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসের চিহ্ন। সুতরাং এই অপারেশনে এই নাম ব্যবহার করার অর্থই হলো জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাকে আরও উগ্র ধর্মান্ধ করে তোলা। কেউ বলতেই পারেন এই সময়ে তো সেনার প্রেস মিটে বারংবার সোফিয়া কুরেশিকে দেখছি উইং কমান্ডার ভমিকার সাথে। তিনিও তো এই অপারেশনে আছেন। এই প্রেস মিট দেখে তো বলাই যায়, এটাই তো আমাদের ভারতবর্ষ। যেখানে বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রির সাথে সোফিয়া এবং ভমিকাও উপস্থিত। এই ভারতবর্ষকেই তো দেখতে চাই আমরা।
অথচ মাঠে ঘাটে ময়দানে সমাজ মাধ্যমে বিজেপি’র সুব্রহ্মণ্যম স্বামী থেকে শুরু করে বিজেপি আরএসএস বাহিনী যেভাবে আগ্রাসী হয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, যেভাবে কলকাতার খিদিরপুর গার্ডেনরিচ পার্কসার্কাস সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মিসাইল আক্রমণ করার হুমকি দেওয়া সমাজ মাধ্যমে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রশ্ন জাগে একাধিক। তখনই আসিফা, উত্তর প্রদেশে ধর্ষিত হওয়া মেয়েটির স্মৃতি উস্কে ওঠে।
কোথাও গিয়ে এমনটা মনে হচ্ছে না যে, তুমি ভারতে থাকতে চাইলে আমার টার্মসে চলো। অর্থাৎ আমি বর্ণহিন্দু। আমি সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধিত্ব করি। তোমায় থাকতে গেলে, দেশপ্রেম দেখাতে গেলে ‘আমার’ শর্তে চলতে হবে।
এরই ফলশ্রুতি গত বেশ কয়েকদিন ধরে মিডিয়ার ফেক প্রোপাগান্ডা, যা বীভৎসতাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান কে ৪/৫ টুকরো করে দেওয়ার জন্য আওয়াজ তোলো। যে সমস্ত মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে কথা বলবেন, তাদের জুটবে দেশদ্রোহিতার তকমা। সে বামপন্থীরা বললেও তাই, এমনকি সরকারের মুখপাত্র বিক্রম মিস্রিকেও দেশদ্রোহী বলে দেগে দিচ্ছে এরা!
অথচ খেয়াল করে দেখুন সেই একই কাজ করলো আমেরিকা। এখন সেই তথাকথিত ‘দেশপ্রেমিক’রা কী বলবেন?
আসলে আমেরিকাকে করতেই হতো এই কাজ। নাহলে তার কপালে দুঃখ ছিল। এবারের অবস্থা যে দিকে যাচ্ছে তাতে প্রভাব বাড়চ্ছিল রাশিয়া এবং চীন। রাশিয়া প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে ভারতকে। অন্য দিকে চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ। রাশিয়ার পাঠানো এস ৪০০ এয়ার ডিফেন্সিভ সিস্টেম প্রভূত সাফল্য পেয়েছে এদেশের সুরক্ষার প্রশ্নে। ফলে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার এই প্রশ্নে দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর এটাই আমেরিকার কাছে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ। একবার যদি এই প্রশ্নে আমেরিকা দুর্বল হয়, তাহলে এশিয়ার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব ভূখণ্ডে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে চীন।
বর্তমানে গোটা বিশ্ব-রাজনীতিতে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী শক্তি হিসেবে চীন রাশিয়া সহ অন্যান্য বেশ কিছু শক্তি কাছাকাছি এসেছে। গত ৯ মে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েতের বিজয় দিবসের ৮০তম বর্ষ পালন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লাতিন আমেরিকার নিকোলাস মদুরো, চীনের প্রেসিডেন্ট সহ অন্যান্য রাষ্ট্র প্রধানেরা। তাই বিপদ বুঝে আমেরিকা নামে মধ্যস্ততায়। ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও ১.৩ মিলিয়ন ডলার আইএমএফ থেকে আবার মঞ্জুর হলো,পাকিস্তানের জন্য। পেছনে অবশ্যই আমেরিকা। অন্য দিকে রইলেন মোদী যিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফ্ল্যাগ বেয়ারার। আর এর মাঝে রইলেন অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ। যারা ২২ মে’র অনেক আগে থেকেই লড়ছেন।
রয়ে গেল কাশ্মীর সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
নাশকতায় যুক্ত সন্ত্রাসবাদীদের কি খুঁজে পাওয়া যাবে? সরকারের কাছে কি আগে থেকেই খবর ছিল এরকম নাশকতার? নাহলে মোদীজি'র কাশ্মীর সফর ওই ঘটনার আগে বাতিল হলো কেন? জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ছেলের ব্যবসার সাথে পাকিস্তান ঠিক কেমন ভাবে জড়িত? আদানি ইন্দো-পাক বর্ডারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রোজেক্ট পেলো কেমন করে? তার মানে কি দেশের সুরক্ষার চাইতে আদানি'র মুনাফা বেশি ভাবাচ্ছে মোদীজিকে?
সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে আজ অব্দি কিছু কী উপকার হলো কাশ্মীরের? নাকি কাশ্মীরের জমি আদানি-আম্বানি'র হাতে বিনা বাধায় তুলে দিতেই এই ব্যবস্থা? ঠিক কোন অধিকার বলে ৭২ সালের সিমলা চুক্তি ভেঙে দেশের সুরক্ষা নিয়ে ট্রাম্প দর কষাকষির সুযোগ পেলেন?
এই প্রশ্নগুলো থাকবেই। সাথে সাম্রাজ্যবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইও নিরন্তর চলবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment