জয়ন্ত সাহা
আদালতের রায়ের পরেও চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি সেই ২৫০ টাকাতেই আটকে আছে। অথচ গত ১৩ বছরে রাজ্য সরকারের বদান্যতায় বাগান মালিকরা শ্রমিকদের অধিকার একের পর এক কেড়ে নিয়েছে। আলিপুরদুয়ার জেলার চালু ৬২টি বাগানে খোঁজ নিলেই শ্রমিকদের অসন্তোষ টের পাওয়া যাচ্ছে।
সেই ব্রিটশ আমল থেকে নিয়ম চালু ছিল বাগানের হাসপাতালে শ্রমিকদের চিকিৎসা যথেষ্ট মনে না হলে সেখানকার চিকিৎসকেরা রোগীকে বাইরের হাসপাতালে রেফার করতেন। সেক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সের খরচ থেকে শুরু করে বিভিন্ন টেস্ট ও ওষুধের দাম মেটাতেন বাগান মালিকরা। তৃণমুল সরকারে আসার পর বাগান মালিকরা আর মেডিক্যাসল অ্যালাউন্স দিচ্ছে না। আলিপুরদুয়ারের হাতে গোনা কয়েকটি বাগান বাদ দিলে কোনও বাগানেই চিকিৎসক নেই। শ্রমিকদের বাইরে থেকে পকেটের টাকায় পরিষেবা পেতে হয়। এখন আর বাগান মালিকরা শ্রমিকদের জ্বালানির জন্য মাসিক টাকাও দেয় না। বাগানে আর মেলে না ছাতা, অ্যাপ্রন, কম্বল। শ্রমিকদের আবাসনের মেরামতি থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে মালিকরা।
চা বাগান শ্রমিকদের সিআইটিইউ নেতা বিদ্যুৎ গুন শনিবার বলেন, শ্রমিকদের দিনের শেষে হাতে মেলে মজুরির ২৫০ টাকা। সেই টাকা থেকে সাড়ে ১২শতাংশ কেটে নেওয়া হয় প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য। জেলায় খোলা বাগানের হাতে গোনা ১০/১২টি বাদ দিলে কেউই সেই টাকা জমা করে না সরকারের অ্যাকাউন্টে। এর ফলে চাকরি শেষে প্রতারিত হচ্ছেন জেলার লক্ষাধিক চা-শ্রমিক।
এদিকে আলিপুরদুয়ার জেলায় শারদ উৎসবের আগে থেকে নতুন করে বন্ধ হয়েছে ৮টি চা বাগান। এই বন্ধ বাগানগুলিতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অস্থায়ী শ্রমিক আরও ১০ হাজার। চা বাগান অ্যাক্ট অনুয়ায়ী বাগান বন্ধ হলে বামফ্রন্ট সরকারের আমল থেকে ১৫০০ টাকা অনুদান দেওয়া হয় ফি মাসে। অভিযোগ গত ১৩ বছরে এই অনুদান বাড়েনি এক টাকাও! নিয়ম অনুযায়ী বাগান বন্ধ হওয়ার তিন মাস পর থেকেই এই মাসিক অনুদান পাওয়ার কথা বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের। কিন্তু বাগান বন্ধ হওয়ার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কোনও শ্রমিক সেই টাকা পাচ্ছেন না। তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট এখন বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের।
ভালো নেই বাগানের কাজ থেকে অবসর নেওয়া শ্রমিকেরাও। গ্র্যাচুইটি দেওয়ার ক্ষেত্রেও মালিকদের অনীহা। আদলতে মামলা করে শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি আদায় করতে লেগে যাচ্ছে দেড়-দু বছর। অবসর নেওয়ার পর পেনশন নিয়েও সমস্যার মুখে অবসরপ্রাপ্ত বাগান শ্রমিকরা।
অবসর নেওয়া ৫০ শতাংশ শ্রমিকের পেনশন আটকে থাকছে তিন কারনে। কখনও বলা হচ্ছে আধার কার্ডে নাম ঠিক নেই। আবার কখনও বলা হচ্ছে আধারের সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লিংক নেই। এসব জটিলতা কাটিয়ে শ্রমিকরা জানতে পারছেন বাগান মালিক পেনশনের টাকাই জমা করেনি। বাগান শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি নিয়ে লং মার্চ হয়েছে, কলকাতা-শিলিগুড়ির রাজপথে লড়াই দেখেছে রাজ্য। তবুও টনক নড়েনি রাজ্যের শ্রম দপ্তরের।
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আইনী লড়াইয়ে জয় এসেছে বাগান শ্রমিকদের। গত বছরের ১ আগস্ট কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজা বসু চৌধুরির সিঙ্গল বেঞ্চ বর্ধিত হারের চা মজুরি নিয়ে শ্রম দপ্তরের জারি করা অ্যাডভাইজারিকে চ্যালেঞ্জ করে মালিকদের একাংশের দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছে। আদালত ন্যুনতম মজুরি ঠিক করার জন্য ৬ মাস সময় বেঁধে দেয়। আদালতের দেওয়া সেই সময় পেরিয়ে গেছে। শ্রমিকরা চাইছেন দ্রুত ন্যুনতম মজুরি চালু হোক বাগানে বাগানে। বাগানের জন্য রাজ্য সরকার চা শিল্প নিয়ে লোক দেখানো মন্ত্রীগোষ্ঠী গড়েছে। গত নভেম্বরে এই মন্ত্রীগোষ্ঠী পুনর্গঠন হয়েছে। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক এই মন্ত্রীগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান। মন্ত্রীগোষ্ঠীর বক্তব্য তারা একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে রাজ্য সরকারকে।
এই বিষয়ে চা-শ্রমিকদের নেতা বিদ্যুৎ গুন বলেন, আমরা কোন প্রতিশ্রুতি শুনতে চাই না। শ্রমিকদের আর্থিক দৈন্যদশা কাটাতে ন্যুনতম মজুরি চালুর পাশাপাশি যেসব অধিকার গত ১৩ বছরে শ্রমিকরা হারিয়েছেন সেগুলি ফেরাতে হবে। মালিকরা বিনা কারনে তিন মাসের বেশি বাগান বন্ধ রাখলে মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক আলিপুরদুয়ার সফরে এসে বন্ধ বাগান অধিগ্রহনের প্রতিশ্রুতির পর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হল সেটা শ্রমিকদের সামনে স্পষ্ট হওয়া জরুরী। কারন এর সাথে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। গত লোকসভার ভোটের আগে মোদীজী এবং নির্মলা সীতারামন উত্তরবঙ্গে এসে বাগান অধিগ্রহনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেননি। তৃণমূল সরকারও বন্ধ বাগান খোলার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
Comments :0