বিশ্বরূপ দাশগুপ্ত
এই বছর ২০২৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গতবছরের তুলনায় প্রায় চারলক্ষ কম। গত প্রায় পনেরো বছর ধরে এই সংখ্যাটা দশলক্ষের আশেপাশে থাকছিল। কখনও কিছুটা বৃদ্ধিও পাচ্ছিল। সর্বশিক্ষা অভিযান ইত্যাদির ফলে শিক্ষার একরকম প্রসার ঘটছিল। কিন্তু এই বছর সংখ্যাটা একেবারে ছয়লক্ষে নেমে আসাটা বেশ একটা ভীতিপ্রদ ব্যাপার। অবশ্য অনেকে বলছেন এটা একটা বয়স সংক্রান্ত বিধিনিষেধের ফল। কিন্তু তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় ২০২১ সালে যে আটলক্ষ ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছিল সেখান থেকে দুই লক্ষ কোথায় গেল? নবম-দশমে দুই লক্ষ ড্রপ আউট ছাড়া আর কোনও হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ দুই বছরে পঁচিশ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যালয়ের আওতার বাইরে চলে গেছে। যথেষ্ট ভয়ংকর একটা পরিসংখ্যান। আমাদের রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সিংহভাগ আসে সরকার পোষিত অবৈতনিক বিদ্যালয় ব্যবস্থা থেকে। সুতরাং বিদ্যালয়শিক্ষা আলাদা করে কোনও আর্থিক দায় সৃষ্টি করে না। উপরন্তু বিদ্যালয়ে এখন বিভিন্ন ধরনের ক্যাশ ইনসেন্টিভ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে বলে সরকার থেকে দাবি করা হয়। তাহলে এমন করুণ দশা কেন?
কোভিডজনিত আর্থিক বিপর্যয় অবশ্যই একটা কারণ। অপরিকল্পিত লকডাউন সবথেকে বেশি ক্ষতি করেছে জনসাধারণের দরিদ্রতম অংশকে। এই আর্থিক বিপর্যয়ের ফলে শিক্ষা অবৈতনিক হওয়া সত্ত্বেও একটা লাক্সারিতে পরিণত হয়েছে। পনেরো ষোলো বছরের ছেলেটিকে তার পরিবারের জন্য উপার্জন করার প্রয়াসে পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু কোভিড তো সারা দেশেই ছিল। সবচেয়ে বেশি কোভিড আক্রান্ত রাজ্যগুলির মধ্যে একটা হলো কেরালা। কেরালাতে ২০২২ সালের তুলনাতে ২০২৩ সালে প্রায় পঁচিশ হাজার বেশি ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস টেনের মাধ্যমিক সমতুল পরীক্ষা দেবে। পাশের রাজ্য ওড়িশাতে ২০২২ সালের তুলনায় বৃদ্ধি প্রায় কুড়ি হাজার। আর আমাদের রাজ্যে দুই লক্ষ হ্রাস। আসলে রাজ্যের অর্থনীতির অন্তঃসারশূন্য চেহারাটা একেবারে আবরণ-মুক্ত হয়ে গেল। তবে অর্থনীতির দৈন্যদশা বড় কারণ হলেও একমাত্র কারণ মোটেই না।
কোভিডের সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয় হলো ডিজিট্যাল ডিভাইড। কোভিডকালে বিভিন্ন স্কুল অনলাইন ক্লাস নিয়েছে। কিন্তু সব ছাত্র-ছাত্রী এর আওতায় আসেনি। তাদের পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। কোথাও এক্ষেত্রে আর্থিক অক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আবার কোথাও প্রযুক্তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সব জায়গাতে ইন্টারনেট পরিষেবা সমান শক্তিশালী না। সব সার্ভিস প্রোভাইডারও সমান ভালো পরিষেবা দেয়নি। তথ্য বলছে দেশে মাত্র চল্লিশ শতাংশের মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তাহলে প্রায় ষাট শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী কোভিডকালে বিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এদের একটা বড় অংশকে বিদ্যালয়ের আঙিনায় ফেরানোর জন্য কোনও প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়নি। বরং যখন রাজ্যে রাজ্যে স্কুল খুলে গিয়েছিল তখনও আমাদের রাজ্যে স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। স্কুল কলেজ খোলার জন্য ছাত্র শিক্ষকদের আমাদের রাজ্যে পথে নামতে হয়েছিল এমন নজিরও রয়েছে। স্কুল খোলার পরে ডিজিট্যাল ডিভাইড ও অন্যান্য কারণে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের তুলে আনার জন্য সিলেবাস পুনর্বিন্যাসের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। সেখানে ‘সেতু’ নামক এক দিশাহীন, নামসর্বস্ব চমক ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। এরফলে পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা ধীরে ধীরে ক্লাসে আসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, কারণ ক্লাসে শিক্ষক শিক্ষিকার পাঠদান তারা বুঝতে পারে না। আর শিক্ষক-শিক্ষিকারাও সিলেবাস শেষ করার তাগিদে এ ব্যাপারে সময় দিতে অপারগ। ইতিমধ্যে সরকারের ট্রান্সফার সংক্রান্ত নীতি এবং শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ার ফলে গ্রামাঞ্চলে স্কুলগুলি শিক্ষকশূন্য হয়ে গেছে। এবার ছাত্রশূন্যও হতে শুরু করল। এরপরে বোধহয় স্কুলগুলিই তুলে দেওয়া হবে।
ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য অভিভাবক সভার নিদান দেওয়া হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো দিন-আনা-দিন খাওয়া অভিভাবকদের পক্ষে একটা গোটা দিন সন্তানের স্কুলে গিয়ে মিটিং-এ বসে খরচ করাটা বিলাসিতা।
এবার আসি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রসঙ্গে। ২০২১ সালে অনেক রাজ্যেই সেকেন্ডারি লেভেলের পরীক্ষা হয়েছে। আমাদের রাজ্যে ভোট হয়েছে। নির্বাচন এবং পরে উপনির্বাচন। কিন্তু পরীক্ষা হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার অভ্যাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা কিছু করার ছিল সবই করা হয়েছে। এখনও আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বড় অংশ পড়াশোনার অভ্যাসে ফিরতে পারেনি। আর ফেরার দরকারই বা কী! যখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই তাদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তখন পড়াশোনার কী দরকার! তাদের পড়াশোনায় ফেরার ক্ষেত্রে আরেকটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন। অনস্ক্রিন টাইম ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। পাল্লা দিয়ে কমেছে ছেলেমেয়েদের বইপত্র পাঠে মনসংযোগের ক্ষমতা। বহু ছাত্র-ছাত্রী কেবলমাত্র মোবাইলের নেশায় স্কুলে আসছে না। তবে এই কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে কিনা তা বলা যাবে না। তেমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে নির্দিষ্ট সমীক্ষা প্রয়োজন। আপাতত এটাকে একটা সমস্যা বলে গণ্য করাই যায়। একদিকে পড়াশোনার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা যুক্ত মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে, ছেলেমেয়েদের মোবাইলের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, অথচ মোবাইল ফোনের গঠনমূলক ব্যবহার কীভাবে করতে হবে, কীভাবে শিক্ষা সহায়তায় ব্যবহার করতে হবে, সোসাল মিডিয়ার আসক্তি এড়াতে হবে এই সব বিষয় শেখানোর জন্য তাদের গাইড করার কোনও ব্যবস্থাই নেই।
তবে ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়ে বলার ক্ষেত্রে আমাদের আরেকটু বিশ্লেষণ করা জরুরি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোভিডের আগে থেকেই, গত প্রায় সাত-আট বছর ধরে পড়াশোনার ব্যাপারে ছাত্রদের কেমন একটা গাছাড়া ভাব। এটা যেন একটা ওদের ভাষায় বলতে গেলে ‘টাইমপাস’। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্ররা প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে আসে না, প্রোজেক্ট জমা করে না, অনেক সময়ে পরীক্ষা দিতে আসতেও ভুলে যায়। আগে তাদের পড়াশোনাতে মনযোগী করার জন্য ভালো চাকরির লোভ দেখাতাম, অর্জিত শিক্ষাকে ব্যবহার করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কথা বলতাম। কিন্তু এখন তো আর লেখাপড়া করে চাকরি পাওয়া যায় না। চাকরি পাওয়া যায় কন্ট্যাক্ট-এ আর উৎকোচে। একটা স্কুলে শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রথমে অনার্স বা মাস্টার্স করার পরে আবার বিএড করার খরচ। তারপরে আবার চাকরি পেতে খরচ। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের এই স্বপ্ন দেখাবো কেমন করে! আর দেখালেই বা তারা দেখবে কেন! তাদের পাড়াতে তো তারা দেখছে যে কয়েকজন বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী আছেন তাঁরা কেউই তেমন লেখাপড়া করেননি। তাই ছেলেমেয়েরাও বুঝে গেছে লেখাপড়া করে বিশেষ কিছু হওয়ার নেই। বরং পাড়ার ওইসব লোকজনদের কাছাকাছি থাকতে পারলে ‘লাইফ সেট’ হয়ে যাবে। চরম দুর্নীতি আর তোষামোদের এই কাঠামোতে লেখাপড়া কোনও যোগ্যতার মাপকাঠিও নয়, শিক্ষা আদৌ খাপ খায় না। লেখাপড়া শিখলে আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়ে যায়। তখন তোষামোদ করতে অসুবিধা হয়। সরকার-প্রশাসন–রাজনীতি সব স্তর থেকেই এই দুর্নীতি আর তোষামোদের সংস্কৃতির নির্মাণ কাজ গত দশ বছর ধরে চলছে। ‘ডহরবাবু’, ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’ ইত্যাদি দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তা’ এখন ‘যুবরাজ’এ এসে পৌঁছেছে। এই সংস্কৃতিতে শিক্ষা দপ্তর জেলে যেতে পারে, শিক্ষার প্রসার হয় না।
তাহলে সবই কি সরকারের হাতে? আমরা কি শুধু ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে থাকব? না। এদের মূল লক্ষ্য সরকারপোষিত শিক্ষাব্যবস্থাকে লুপ্ত করা। তাহলে বেসরকারি বাণিজ্যিক শিক্ষা কোম্পানিগুলির মুনাফালোটার ময়দান চওড়া হবে। কিন্তু সরকারপোষিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছেন যে লক্ষাধিক শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মী তাঁরা পারেন চাকাটা উলটো দিকে ঘোরানোর মনোভাব জাগাতে। একাজ কঠিন কিন্তু অসম্ভব না। প্রয়োজন অভিভাবকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। নিজের পরিবারের কাছ থেকে সময় বের করে হলেও এই কাজে দিতে হবে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত। তাঁদের সময় নেই অভিভাবক সভাতে আসার। আমাদের যেতে হবে তাঁদের কাছে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আঙিনায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সন্তানস্নেহে তাদের পড়াশোনায় দুর্বলতা অপনয়ন করতে হবে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের প্রাণভোমরা। ছাত্র-ছাত্রীদের কলরব মুখরিত বিদ্যালয়ই পারে সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে নতুন দিন নিয়ে আসতে।
Comments :0