Kolkata Book Fair 2024

বইমেলা: বিদ্বেষবিহীন উৎসবের সুবাতাস

ফিচার পাতা


ঘনশ্যাম চৌধুরি
কেমন করে কলকাতা বইমেলা বাংলাভাষী পাঠককুলের ‘হৃদমাঝারে’ স্পন্দন তুলে দি‍‌ল? সে বোধহয় রূপকথার কাহিনি থেকে নেহাত কম অপরূপ নয়। ১৯৭৬-এ মুষ্টিমেয় কিছু প্রকাশক যখন প্রথমবার বইমেলার উদ্যোগটি নিলেন, সেদিন এই অনাসৃষ্টি কাণ্ডকে হজম করতেই পারেননি অনেকে। বইয়ের মেলা? পাগল নাকি! মাত্র ৩৬ জন প্রকাশককে নিয়ে সেই প্রথম মেলা। তাই-ই জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল উদ্যোক্তাদের। তা আজ ফলে-ফুলে-পত্রে-পল্লবে মহীরূহ। রবীন্দ্র সদনের উলটোদিকের মাঠে সেই মেলা বাড়ছিল। সরকারি গ্রন্থমেলা, তার কিছু পরেই পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’। গ্রন্থমেলায় জেলাগুলি থেকে লাইব্রেরির বই কিনতে গ্রন্থাগারিকরা যেমন আসতেন, তেমনি ইউনিফর্ম পরা ছাত্র-ছাত্রীদের সার বেঁধে নিয়ে আসতেন স্কুলের দিদিমণি-মাস্টারমশাইরা। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নতুন বইয়ের গন্ধ— সে এক আশ্চর্য অনুভব! অনেকের স্মৃতিতে হয়তো আজও জ্বলজ্বল করছে, বইমেলা প্রাঙ্গণে আলাদা করে শামিয়ানা খাটিয়ে টেবিল পেতে পুরানো বই বিক্রি— বাংলা-ইংরেজি অপূর্ব সেসব বই খুবই অল্প দামে বিক্রি করা হতো। যাঁরা তখন বই কিনতেন, অথবা বিক্রেতারা, দু’পক্ষেরই আন্তরিকতার নিবিড়তা মনকে ছুঁয়ে যেত। 
আজকে বইমেলার বৃহত্তর আয়োজনে পেশাদারিত্ব কিংবা ডিজিটাল নেটওয়ার্কের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েও সেই সময়ের আরও একটি সুখস্মৃতি এখনও জাগরুক। ১৯৯৪-’৯৫ সময়কাল থেকে কলকাতা বইমেলায় বিদেশি প্রকাশকদের আগমনের সাথে সাথে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেলার কারুকাজ বা সংস্কৃতি পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে প্রথম দিকে কফিহাউসের উপস্থিতি কিন্তু মনে করিয়ে দেয় কলকাতার নিজস্ব ঘরানার কথা। কফি হাউসকে কম পয়সায় ভাড়া দেওয়া হতো। সেইসব ওয়েটারদের মুখগুলি তো আমাদের চেনা! বইমেলার মাঠে কফির কাপে চুমুক দিয়ে আমরা সবাই যেন সেই যৌথ পরিবারেরই সদস্য। কিন্তু তখন থেকেই কফি হাউস ক্রমশ গরিব হয়ে পড়ছে। বইমেলা-মাঠে আসার সঙ্গতি হারিয়ে বিদায় নিলেন তাঁরা। সেই বিরহ-বিধূরতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।
গ্রন্থমেলা, পুস্তকমেলা মিশে গেল। মেলা যখন বাড়ছে, তা ময়দানে স্থানান্তরিত হলো। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু উদ্যোক্তাদের স্পষ্টই বললেন, কাঠামোগত এই বড় পরিসর সামলাতে ‘সরকারি সাপোর্ট পুরোপুরি থাকবে। ঘাবড়াবেন না। সেই সময় থেকে শুরু করে যখন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সহযোগিতার আন্তরিক ধারাটি ছিল জোরালোভাবে বহমান। সেই বহমান ধারার বিরতি ঘটানো সম্ভবত কোনও সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। লক্ষণীয় যে ধীরে ধীরে কলকাতা পুস্তকমেলার চরিত্রগত পরিবর্তন হচ্ছিল। পেশাদারিত্বের পাশাপা‍‌শি মেলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও রূপান্তর আসছে। নানা বাদানুবাদের পরেও বলা যায়, পেশাদারিত্ব, ব্যবসা সব মিলে কলকাতা বইমেলা আজ ‘আন্তর্জাতিক কলিকাতা পুস্তকমেলা’, যার জন্য বাংলার শিল্প-সাহিত্য জগতের মানুষ, আকাডেমিক ক্ষেত্রের বিদ্বজ্জন, বড়-মাঝারি লেখক, নবীন কিংবা উঠতি লেখক-কবিরা উন্মুখ হয়ে থাকেন। ধর্ম-বর্ণের প্রাচীরমুক্ত সেই প্রবহমান সুবাতাসে সৃষ্টিশীলতার অর্গল উন্মুক্ত হয়ে মেলা মাঠের জনকল্লোল যে আজও সমানভাবে আবেগে ভেসে ওঠে তা অনস্বীকার্য।
বর্ষীয়ান প্রকাশক তাপস সাহা বললেন, কলকাতা বইমেলা বেইপ্রেমী মানুষের আকাঙ্ক্ষার রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়েছে। প্রতিটি জেলায় সরকারি বইমেলা শুরু হয়ে গেল শুধু তাই-ই নয়, কোনও কোনও অঞ্চল বা সংগঠনভিত্তিক বইমেলাও শুরু হয়ে গেল। বাংলার নিজস্ব উৎসব-পার্বণগুলির সঙ্গে যুক্ত হলো বইমেলা। শতাধিক বইমেলা হয় পশ্চিমবঙ্গে। গিল্ড কর্মকর্তা সুধাংশু দে বললেন, বৃহত্তর বাঙালি জনসমাজের মধ্যে আমরা বইমেলাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। আসামের শিলচর বইমেলা ওখানকার বইপ্রেমী মানুষের প্রিয়তম উৎসব। গুয়াহাটি বইমেলা, দিল্লি বইমেলা, ত্রিপুরায় আগরতলা বইমেলা, ওপার বাংলার ঢাকায় একুশে ছাড়াও ডিসেম্বরে হয় ঢাকা বইমেলা। যখন এই দেশে মিথ্যাচার, অনৈতিকতা, বিদ্বেষের দাপাদাপি, তার মধ্যেও বইমেলা প্রাঙ্গণে লাখো মানুষের প্রাণবন্ত উপস্থিতি সুস্থতার সাহস জোগায়।
পিছন ফিরলে শুরুর দিককার বইমেলার নানা চূর্ণ চূর্ণ রঙিন খণ্ডচিত্র সুখস্মৃতিকে উসকে দেয়। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা প্লাস্টিক পেতে বসে পড়ত গ্রিটিংস কার্ড আঁকতে। আঁকত পোর্ট্রেট অথবা ল্যান্ডস্কেপ। চটজলদি এঁকেই চারটি পয়সা উপার্জন। ওদের কাজ দেখতেও ভিড় জমে যেত। মমাঁর্ততে সেই সব নবীন আর্টিস্টদের অঙ্কনশৈলীর সঙ্গে উচ্ছ্বলতার জলতরঙ্গ বইমেলাকে স্নিগ্ধ-সহজতায় আচ্ছন্ন করত। ময়দান, মিলনমেলা ঘুরে ‘আন্তর্জাতিক কলিকাতা পুস্তকমেলা’ সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে থিতু হয়েছে ‘বইমেলা প্রাঙ্গণে’। এবার ফোকাল থিম ব্রিটেন সহ ২০টি দেশের উপস্থিতি থাকছে। থাকছে বাংলাদেশের প্রকাশকদের বিপুল আয়োজন। নতুন নতুন প্রকাশকদের এবারের মেলায় জায়গা করে দিতে পেরে গিল্ডকর্তা ত্রিদিব চ্যাটার্জি উচ্ছ্বসিত। এ প্রজন্মের প্রকাশক শুভঙ্কর দে জানালেন, প্রোডাকশনের ক্ষেত্রেও বাংলা বইয়ের নতুন যুগ শুরু হয়ে গেছে। মেলার সাজসজ্জা, আলোকসজ্জাও আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখেই চলেছে। আর যাঁদের কথা কেউই বলেন না, তাঁরা হলেন ডেকরেটার কর্মীরা। নয়নাভিরাম স্টলগুলি বানাতে তাঁদের শিল্পবোধ, চিন্তা, রুচিশীলতার কথাও বলা দরকার। কাজ করতে করতে স্ব-শিক্ষাতেই তাঁরা জাত শিল্পী। তাঁদের দিবারাত্রির কঠিন শ্রমের সঙ্গে স্টলগুলির কারুকৃতি, সবমিলে বইমেলা প্রাঙ্গণকে উৎসবে উদ্বেল করবে। সেই শ্রমজীবী মানুষগুলোর সামনে আমাদের একটু নত হওয়া দরকার।
বইমেলার কথা প্রসঙ্গে ছাপাখানার কর্মীদের দিনলিপির কথাও ভুললে চলবে না। একটি বই যদি একটি জীবনের অভিজ্ঞতার সারাৎসার হতে পারে, একটি গ্রন্থাগার যদি বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের মেধা-সম্পদের ভাণ্ডার হতে পারে, আর যাঁরা সেই মেধা-সম্পদকে গ্রন্থে রূপ দিচ্ছেন, তারা? সেই সব ছাপাখানার কর্মী, কম্পোজিটার, প্রুফ রিডার, বাইন্ডার, তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ফসল একটি সুচারু গ্রন্থ। এখনও এখানে প্রেসকর্মীরা খুবই সামান্য বেতনে কাজ করেন। কিন্তু একটি বই পাঠকের দরবারে হাজির করতে তাঁদের নীরব শ্রম, দক্ষতা, অনুভব এবং আন্তরিকতার নিবিড় স্পর্শ মিলে‍‌‍‌মিশে একাকার হয়ে যায়। তাই আলোয় ভরা এই জনকল্লোলে বিশিষ্টজনের বিপুল উপস্থিতি ভরা বহু আকাঙ্ক্ষিত এই বই পার্বণে এই শ্রমজীবী মানুষগুলোও আমাদের ‘হৃদমাঝারে’ মনের মণিকোঠায় জেগে থাকুক।
 

Comments :0

Login to leave a comment