খাদ্যাভ্যাহসের ওপর আক্রমণের নতুন নজির তৈরি হয়েছে রাজধানী দিল্লির মাছবাজারে । পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য থেকে মাছ বিক্রি বন্ধ করতে নেমেছে হিন্দুত্ববাদীরা। কিন্তু এই আক্রমণ আর শুধু মুসলিমদের ওপরে সীমিত নেই, কারণ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের প্রায় সবাই মাছ খেতে ভালোবাসেন। বাঙালি ছাড়াও ভারতের বহু জাতির মানুষই মাছ খেতে ভালোবাসেন। তবে বাঙালির খাদ্য তালিকায় মাছ প্রায় আবশ্যিক, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটিও প্রচলিত। কিন্তু যারা বহু জাতি বহু ভাষী ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের অস্তিত্বই স্বীকার করে না, যারা অভিন্নতা চাপাতে চায় সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের নামে তারা শুধু মুসলিম, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের মানুষের সংস্কৃতিকেই অস্বীকার করে না, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও বহু সংস্কৃতিকে মানতে চায় না। তাই গোরুর মাংস নিষিদ্ধ হচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিভিন্ন কায়দায়। গোরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে, ব্যাগে অথবা ফ্রিজে গোরুর মাংস রাখার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার একের পর এক ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানাতে। এমনকি বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা আক্রমণের শিকার হয়েছে। এখন শুধু গোরুর মাংসের নিষেধাজ্ঞা সীমিত রইলো না, মাছ খাওয়ার ওপরেও আক্রমণ নেমে এসেছে।
কয়েকদিন আগে গেরুয়া পোশাকে কয়েকজন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাঙালিদের কলোনির পার্শ্ববর্তী দোকানিদের হুমকি দিয়ে যায় এই বলে, পাশে কালীমন্দির, অতএব এখানে মাছের দোকান করা চলবে না, কারণ এটা নাকি সনাতন ধর্মের বিরোধী। প্রথমে উপলক্ষ ছিল রামনবমী, কিন্তু তারপরেও দোকান খুলতে দেওয়া হচ্ছে না। মাছের দোকান বন্ধ করতে আসা হিন্দুত্ববাদীদের বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে বাংলায় কালী পুজোয় আমিষ ভোগ দেওয়া হয়, আসামের কামাখ্যা মন্দিরে মাংসও দেওয়া হয়। একথাও বলা হয় যে দোকানদাররাই মন্দিরটা বানিয়েছিল। বাজারটি বেআইনি গজিয়ে ওঠা নয়, দিল্লি উন্নয়ন অথরিটি অনুমোদিত বাজার। অর্থাৎ স্রেফ গায়ের জোরে সাম্প্রদায়িক শক্তি দিল্লিতে মাছ নিষিদ্ধ করতে নেমেছে। বিষয়টিকে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের দমনপীড়ন ছাড়া আর কি বলা চলে ! হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্ব কায়েম করতে উঠেপড়ে লেগেছে ওরা, যেনতেন প্রকারে। হিন্দু ধর্মেও বরাবর বহুত্বের কথা এসেছে কিন্তু এখন তাকে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত করা হচ্ছে। খাদ্যাভ্যা স বজায় রাখার কিংবা পোশাক বেছে নেবার স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত অধিকারও বটে। মাছ বাঙালিদের শুধু খাদ্য নয়, বাঙালির সংস্কৃতিরও প্রতীক। পরিকল্পিতভাবে তাকে হেনস্তা করা কিংবা অপমান করার পিছনে আরএসএস-বিজেপি’র স্পষ্ট ইন্ধন বুঝিয়ে দিচ্ছে বিপদটা অন্যত্র।
মাছের দোকান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি নতুন হলেও রাজধানীর এই সব এলাকায় বেশ কিছু বছর ধরে সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যামসের উপরে আক্রমণ বাড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। দিল্লি-এনসিআর এলাকায় দশেরা, রামনবমী ইত্যাদি পালন করা হলেও বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজোর উৎসবই মুখ্য। দুর্গাপুজোর সময়ে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মতই দিল্লি-এনসিআর’র বাঙালিরাও আমিষ খাবারই পছন্দ করেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এইসব এলাকায় সর্বজনীন পুজো কমিটিগুলিকে পুজোর অনুমোদন দেওয়ার আগে কার্যত মুচলেকা দিতে হচ্ছে যে, পুজোর সময়ে স্টলে তারা আমিষ খাবার রাখতে দেবে না। এই সময়ে মাংসের দোকান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি চলছে। কয়েকদিন আগে নবরাত্রিতে সি আর পার্কের আশপাশের মাছ-মাংসের দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল হিন্দুত্ববাদীরা। মুসলিমদের থেকে হামলা প্রসারিত হয়েছে ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিদের খাদ্যাভ্যা সের ওপরে, সংস্কৃতির ওপরে। সাম্প্রদায়িকতার বিপদ এখানেই, তা কোনো উদারতা ও সহনশীলতা শেখায় না। অপরের সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে আধিপত্য কায়েম করতে শেখায়। বৈচিত্রময় ভারতের বুকে এমন অভিন্নতা চাপানোর চেষ্টা আসলে ভারতবাসীর ঐক্য ভাঙারই প্ররোচনা ।
Comments :0